আমি দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেজ দ্যাওরটো একটু আখচোটা রকম, ভালো করে কারুর সাথে আলাপ করতে পারে না, কাজকম্ম গোঁয়ারগোবিন্দের মতুন কিন্তুক মানুষটি সে খারাপ লয়। আর ল-দ্যাওরকে নিয়ে তো কুনো কথা নাই! রাজপুত্তুরের মতুন চেহারা। অবশ্য আর আগের চেহারা নাই, তবু সে এখনো সোন্দর। বিয়ে হয়ে আমি য্যাকন ই সোংসারে আসি, ঐ দ্যাওর ভাইয়ের মতুন, ছেলের মতুন কাছে কাছে থাকত, যা ফরমাশ করতম তাই শুনত। আমার বড় খোঁকাটি হয়েছিল তার জানের জান। দাদির দেওয়া জমির বদলে ইখানে য্যাকন জমি কেনা হলো, সেই জমির ধান নিয়ে কত্তাকে বলে আলেদা একটো মরাই বাঁধলে। আমাকে এসে বললে, তোমার ধান আলাদা করে রাখা হলো।
আমার আবার ধান কি, সবই সোংসারের এই কথা তাকে বলেছেলম আমি। কতদিন আগের কথা! ওর কি মনে আছে সি কথা? উসব কথা কারুর মনে থাকে না। মাটি থেকে ওঠা ভাপের মতুন কোথা উড়ে যায়।
দুজনাই আবার উঠে দাঁড়াইলে বটে কিন্তুক দুই ভাই লয়, ঠিক যেন একে আরেকের দুশমন। কুনোই কারণ নাই, তবু ওদের দুই বউ-ও একে আরেকজনার দুশমন। আর এ কথা কে পেত্যয় যাবে যি দু-ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাও হলো ঠিক তাই।
খামার অ্যাকন ফাঁকা! শ্যাষ মরাইটোর শ্যাষ কটি ধানও বার করে নেওয়া হয়েছে, খামারবাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। আর কদিন চলবে? যিদিন তা বন্ধ হবে, সিদিন থেকে কি হবে? কি বেবস্থা হবে এতগুলিন পেরানির? কত্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কি কঠিন সেই মুখ, যেন পাথরের। তাকে একটো কথা বলতে সাহসও হয় না, ইচ্ছাও হয় না।
আমার এত কথা, কার কাছে বলি? কেউ নাই। গিন্নি য্যাতোদিন ছিল, তার কাছে যেয়ে চুপ করে দাঁড়াইলেই হতো, কুনো কথার দরকারই হতো না। আপনা-আপনিই মন শান্ত হতো। ননদের কাছে তো সিটি হবার উপয় নাই, তারই বরং কত কথা বলার লেগে বুক ফেটে যেচে। আর আছে ঐ কত্তা। কিন্তুক উ মানুয অ্যাকন মানুষই লয়, পাষাণ। তাকে আমার চিকার করে শুদুতে মন যায়, দু-বছরের। মদ্যে সব এমন ছারেখারে গেল ক্যানে? কেমন দেখেছেলম ই সংসার, আর অ্যাকন কেমন দেখছি? অমন সোংসার তো সেই-ই দিয়েছিল, অ্যাকন সব দেখে চুপ করে আছে কেন? জানি, যেদি তাকে এই কথা শুধুই তার কুনো জবাব সে দেবে না, বড় জোর সব কথার এক কথা বলবে, সারা দুনিয়া ছারেখারে গিয়েছে, তোমার আমার সংসারও ঐ এক পথে যাচ্ছে। তবে কি লোকটো একবারে হেরে গেল?
পরপর দুবার মারা গেলেও মাঠে কিন্তুক ইবার ধান আছে। ই বাড়ির ঘেরাটোপ থেকে দেখতে পাই না, মনে ইচ্ছা হয় একবার যাই, দেখে আসি আর কত দূর? বাড়িতে বসে মনে হয়, এখনো অনেক দূর। এখনো অনেক দিন বাকি।
উত্তর-দুয়ারি ঘরের আঁদার কোণে মাটির বেরাট এক পয়ায়। ভাতের চাল থাকে। ওখান থেকেই পেত্যেক দিন খরচ হয়। উত্তরপাড়ায় দুই বেধবা বুন আছে। তাদের কাছে লোকে ধান ভঁচা দেয়। সেই ধান তারা সিজোয়, শুকোয়, তাপর টিকিতে পাড় দিয়ে। চাল বানায়। এই তাদের পেশা, এই করেই তারা খায়। আমাদের ধানও ওদেরই কাছে ভঁচা দেওয়া থাকে। ধান যায় ওদের কাছে, তাপর চাল আসে। সি চাল খরচ হয়ে গেলে আবার আসে। এই চেরকাল চলছে। পয়ায় চাল শেষ হতে না হতে আবার ‘য়া চালে ভরা হয়। এই পেথম দেখছি পয়া আধেক খালি হয়ে গেয়েছে। ভেতরটো আঁদার, উকি দিয়েও বোঝা যেচে না চাল আর কতোটো আছে। দিনের বেলা লম্ফ জ্বালিয়ে পয়াল ভেতরটা দেখলম। একদম তলায় সেরদশেক চাল কুনো পেরকারে থাকতে পারে। লম্ফর আলোয় পুরনো চাল কটো দেখে আমার যি কেমন মনে হতে লাগল কি বলব? মনে হচে সাত রাজার ধন এই চাল। চালের রঙ কি অত সোন্দর হয়?
কিন্তু বাড়িতে আর চাল এল না। ল-দ্যাওরের ওপর ছিল সব দেখার দায়িত্ব। তা সে চুপ করে থাকে। ননদ পেত্যেক দিন তাকে বলছে, চাল কিন্তুক শ্যাষ, আর দিন দুয়েক পরে বাড়িতে চুলো জ্বলবে না। কদিন চুপ করে থেকে থেকে একদিন সে বললে, ভঁচা দেওয়া ধানের আর কুনো চাল পাওনা নাই। ননদ এই কথা শুনে বললে, তাইলে কি হবে? ছেলেপুলে না খেয়ে মরবে? যিখান থেকে হোক ধান জোগাড় করতে হবে না? সে ত্যাকন কাঠ-কাঠ গলায় জবাব দিলে, আমি কোথা থেকে ধান জোগাড় করব? চুরি করব, না ডাকাতি করব? বাড়িতে ভাত না হলে শুধু কি আমার ছেলেমেয়ে উপোস করবে? সবাই করবে। আমি কিছু জানি না।
ধানের কথা, চালের কথা, সংসারের কথা ভাশুরকে বলা বেথা। তার নিজের কুনো ছেলেপুলে নাই, অমন সোজা মানুষের কিছু করার খ্যামতাও নাই। সেজ দ্যাওরকে তো এসব কথা বলার আরও কুনো মানে নাই। সে এমন গোঁয়ারগোবিন্দ যি এসব শুনলে হয়তো আবার কার সাথে মারামারি-ফ্যাসাদ লাগিয়ে দেবে। আর থাকল ছোট দ্যাওর। তারও কুনো ভরসা নাই। এমন দিন পড়েছে যি সে অ্যাকন চাকরির কটো টাকা বাঁচাবার লেগে শহরে একা থাকে। বউ আর পাঁচটা বাচ্চা সে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।
কাউকে কিছু বলার নাই। ননদ কাকে কিছুই বলবে না। কত্তা যেদি নিজে থেকে কিছু না করে, তাইলে শত বললেও কারুর কথায় কিছু করবে না। তাকে বলার কিছু নাই, তার অজানা কি আছে? ইদিকে জা দের দেখে মনে হচে তারা যেন কিছুই জানে না। কুনো কাজকৰ্ম্ম নাই, মনে কুনো দুচ্চিন্তা নাই, ঘর-দুয়োরে ঝটপাট নাই, কোথাও কুনো ছিরিছাঁদ নাই। তারা সবাই সারা বাড়ি ছিরফুটি করে বেড়াইছে আর কথায় কথায় কুঁদুল অর করছে। মনে হচে, সোংসারের এই আবস্তা দেখে তারা ব্যাজায় খুশি। এমনি চললে আর কিছুদিন বাদে তাদের নিজের নিজের সোংসার হবে।