যুদ্ধ তো ছিলই, তাতে তেমন কিছু হয় নাই। কিন্তু মাত্র দু-বছরের আকালে দুনিয়া অন্যরকম হয়ে গেল। ভাত-কাপড়ের টান বড় টান। আর একজনার কি হছে তা নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? যার পরনে কাপড় নাই, সে দেখছে সেই-ই ন্যাংটো, আর কেউ ন্যাংটো তা কি সে দেখতে পায়? ছেলে ভুখে কঁদছে তা চোখে দেখতে হয় আর মনে আন্দাজ করতে হয় কিন্তু নিজের প্যাটে আগুন জ্বললে দেখতেও হয় না, আন্দাজ করতেও হয় না। সি আগুনের কি কুনো তুলনা আছে? সি আগুন জ্বললে পেটের সন্তানকেও দেখতে পাওয়া যায় না।
ছেলেপুলেরা বাড়িতে অ্যাকন য্যাকন-ত্যাকন যা খুশি তা-ই খেতে পায় না। বাঁধা তিনবার খাবার। অ্যাকনো ননদই তাদের খেতে দেয়। পেরায়ই দুখে-রাগে তাকে চোখের পানি ফেলতে হয়। যি ছেলেটো বেশি খায় কিংবা কুনো বিশেষ জিনিশ খেতে পছন্দ করে, তার দিকে তাকানোর জো নাই, ননদকে নিক্তিতে মেপে চলতে হয়। একটু ইদিক-ঊদিক হলে–কি শরমের কথা–মুখফেঁড় কুনো ছেলেই হয়তো বলবে, উ বেশি পেচে। একজনার খাবার আর একজনার থালা থেকে তুলে নিতেও দেখছে ননদ। ছেলেরা কেউ দুর্দান্ত, কেউ শান্ত, কেউ হিংসুটে, কেউ সাত চড়ে রা করে না। খাবার সোমায়ে ঘরে হুড়োহুড়ি মারামারি। সব চাইতে খারাবি হচে, সময়ে সময়ে তাদের মা-রাও ঘরে হাজির থাকছে। কিছু বলছে না বটে, একদিষ্টে নিজের নিজের ছেলেমেয়ের থালার দিকে চেয়ে আছে। ননদ কাঁদবে না তো কি করবে? পোঞ্চার বোঝা যেচে, আজ বলছে না কিন্তুক কালকেই কুনো বউ বলবে, তার ছেলেকে কম দেওয়া হচে। ননদ এক দিষ্টিতে দেখছে না সবাইকে, দুই-দুই করছে। কে জানে, হয়তো নিজেরাই নিজের নিজের ছেলেমেয়েকে খাবার খসিয়ে দেবে আর তা করতে গিয়ে নিজেরাই হুড়োহুড়ি করে মরবে। ত্যাকন হয়তো তাদের সোয়ামিরাও এসে হেঁশেলে ঢুকবে, নিজের নিজের ইস্ত্রীর হয়ে লড়াই করবে। ত্যাকন ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি হতে আর বাকি কি থাকবে? বউদের হয়ে ঝগড়া করতে করতেই হয়তো দ্যাওর তার ভাবির গায়ে হাত দেবে কিংবা ভাসুর মারবে ভাদ্দর-বউকে। পোস্কার দেখতে পেচি ইসব হবে, হবে। এর মদ্যেই ছেলেমেয়েরা হাঁড়ি থেকে নিজেরা খাবার তুলে খেতে শিখে ফেলেছে। সারাদিন সবাই নিজের নিজের খাবারের ধান্দায় থাকে। কোথা থেকে একটো মাছ পেলে সেটি পুড়িয়ে খায়, নাইলে তার মা-ই তাকে আলো করে বেঁধে দেয়। ননদই কি সত্যি সবাইকে এক দিষ্টিতে দেখতে পারছে? সেই যি ভাগ্নেদুটিকে কত্তা ই সোংসারে এনেছিল মানুষ করার লেগে, তাদের একজন তো বড়। হয়ে শহরে চাকরি করছে, আর একজন ই বাড়িতে অ্যাকননা আছে। ননদের চোখের মণি এই ছেলেটি। তাকে এট্টু অন্য রকম করে না দেখে কি ননদ পারে? সকলের ছামনে হয়তো ভালো একটু কিছু ননদ তাকে দিয়ে ফেলে, কিম্বা লুকিয়ে-চুরিয়ে কুনো খাবার দেয়। হয়তো নিজের খাবার থেকেই দেয়। তা এমন শিক্ষে হয়েছে। ছেলেমেয়েদের তাদের বাপ-মায়ের কাছ থেকে, তারা চেঁচিয়ে উঠবে, ফুপু ওকে দিলে, আমাকে দিলে না। একদিন চূড়ান্ত হলো, য্যাকন বউদের একজন ছেলেপুলেদের খাবার সোমায় হেঁশেল থেকে উঠে গেল আর একটু বাদে সোয়ামিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। তাপর সেই দ্যাওর সকলের ছামনে, ছেলেমেয়ে-বউ-ঝি সকলের ছামনে, নিজের বুনকে যা লয়, তা-ই বলে রপমান করলে। এমন করলে ই সোংসারে থাকা হবে না তা-ও বললে।
সোংসারের ভেতরটো এইবার তাকিয়ে দেখতে প্যালম আর সোংসারের মধ্যে মানুষ কি, তা-ও দেখলম। কুকুর-বেড়ালের ছেড়াছিড়ি দেখে রাগ করি কিন্তুক মানুষ কুকুর-বেড়ালের চাইতে কিসে ভালো? মূলে টান পড়লে সবাই সমান। সেই মূল হচে প্যাট। এই আমি সার বোঝলম। মূল ঠিক থাকলে সব ঠিক, তাই বলছেলম প্যাটের খোরাকি নাই তো কিছুই নাই, তুমি নাই, আমি নাই, কেউ নাই। এই দ্যাশে সেই মূলের নাম হচে ধান। ঐ ধান থেকেই খাবার, ঐ ধান থেকেই কাপড়, ঐ ধান থেকেই সব। ঐ জিনিশের অভাবেই সব ছত্রখান হয়ে গেল। ঘর ভেঙে গেল, ঘরের চাল হুমড়ি খেয়ে পড়ল, মাটির দেয়াল মাটিতে মিশল, গরু মোষ ছাগল মুরগি সব উধাও হলো, চাকর মাহিন্দার পালিয়ে গেল। ভরাভত্তি পানি সব নেমে গেল, পাঁক আর কাদা বেরিয়ে পড়ল।
একদিন ঠিক ভরাদোপরে দু-ভাই নিজের নিজের ইস্ত্রীর কথা শুনে মারামারি করে দুজনই জখম হলো। সি এমনি জখম যি দুজনার কেউ আর দাঁড়াইতে-বসতে পারলে না। একজনার লাগল কোমরে, কোমর ভাঙল কি না কে জানে আর একজনার মাথায় পড়ল লাঠির বাড়ি। দর দর করে রক্ত ঝরতে লাগল। এইটি ল-দ্যাওর–আমার ভাইয়ের অধিক, ছেলের মতুন ফেনা মেশানো টকটকে লাল তাজা রক্ত মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে যেচে। সে দু-পা ছড়িয়ে দু-হাতে ভর দিয়ে বসে আছে। মুখে কি খারাপ খারাপ কথা! মাঝে মাঝে হুঁ হুঁ করে কোঁকাইছে।
সবাই ছামনে এসে জড়ো হলো। ছোট দাওর নাই তবে তার বউ-ছেলেমেয়ে সব ওখানে। ভাসুরও এল। কিন্তুক কত্তা এল না। হয়তো বাড়িতে নাই, থাকলেও আসবে না, জানা কথা। সবাই এসে দাঁড়িয়ে থাকলে, কারুর মুখে একটো কথা নাই। শুধু হাহাকার করে কেঁদে উঠল ননদ। যে ছোটভাই এত রপমান করেছিল, সেই ছোট ভাইয়ের ব্যাকন রক্ত ঝরল, ত্যাকন তার লেগেই মাথা ঠুকতে লাগল। ননদ, ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্ত–সোংসার আর থাকবে না, থাকবে না।
পড়ে থাকলে দু-ভাই। উঠে দাঁড়িয়ে যি নিজের নিজের ঘরে যাবে সি সাধ্যিও নাই। ঐ উসারাতেই পাশাপাশি দু-ভাইয়ের বিছেনা করে দিলে তাদের বুন। দুর থেকে মনে হতে লাগল তারা দুজনা গলাগলি করে শুয়ে আছে। যি কদিন তারা উঠতে পারবে না, যেমন করে হোক একটু সাবু-বার্লি জোগাড় করে তাই বেঁধে খাওয়াবে ঐ বুন। জা-দের কিছুই করার সাধ্যি নাই, তারা শুদু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। ডাক্তার-বদ্যির কুনো কথা নাই। অ্যাকন অসুখে-বিসুখে জ্বরজারিতে ছেলেমেয়েগুনোই দিনের পর দিন বিছেনায় পড়ে থাকছে, সাবু-বার্লিও জুটছে না, তা এইসব বুড়ো দামড়া জোয়ান মরদুরা মারামারি করে পড়ে আছে–কে দেখবে তাদের?