অ্যাকন আর মুটেই নাই, ফোপরা হয়ে কবে শ্যাষ হয়ে গেয়েছে। গিন্নি ছিল মূল গুঁড়ি, সে থাকতে থাকতেই যার যার ঝুরি নামছিল। অ্যাকন আর সি গুঁড়িই নাই, মূল গাছটো থাকবে কি করে?
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটো ভায়ানক কথা মাথায় এল। আমিও কি তাইলে এত দিন তলায় তলায় ঝুরি নামিয়েছি? সবাইকে বাদ দিয়ে আমার নিজের সোংসারের একটো আলেদা বটগাছের ঝুরি কি পুঁতিছি? একবার ভেবে দেখি তো! নিজের মন নিজের কাছে বিচের করলে দোষ কিছুই নাই। নিজের য্যাতো খারাপই বেরুক কে আর তা জানতে পারছে? সেই লেগে খুব চেষ্টা করলম জা-দের কথা না ভেবে নিজের মনের উলুক-শুলুক খুঁজে দেখতে। বড় খোঁকা মারা গেয়েছে তেরো-চোদ্দ বছর। সে আজ বেঁচে থাকলে মনের আবস্তা কি হতো জানি না, হয়তো জা-দের চেয়েও দশকাঠি সরেস স্বাস্থপর হতোম। কিন্তুক সে নাই, সে চলে যাবার পর আর আমার জেবনে জেবন নাই, কোথাও খুঁটি পুঁতি নাই, কোথাও ঝুরি নামাই নাই। আমার, এই কথা কেউ জানে না, কত্তাও জানে না। ছেলেমেয়ে আজ যারা আছে, বড় হয়ে গেয়েছে, তারাও কেউ জানে না। আমার ঝুরি মাটিতে নাই, বাতাসে আলগ ঝুলছে।
তাই বলে আমার কপাল দিয়ে সবাইকে বিচের করতে যাব ক্যানে? দুষবই বা ক্যানে? সিদিন আর কিছু হয় নাই, ঝগড়াঝাটি না, কথা-কাটাকাটি না, ননদের দিকে চোখ তুলে কেউ একটো কথাও বলে নাই। তবু ক্যানে আমার মনে হলো, এই শুরু–সোংসারের ভাঙনের এই হলো গোড়াপত্তন? সুখের দিনে কিছু হয় নাই, সবাই হেসেছে, খেলেছে, সবাই সবাইকে দেখেছে, দুখে দুখি, সুখে সুখী হয়েছে আর অ্যাকন য্যাকন কাল খারাপ পড়েছে, অভাব দেখা দিতে। শুরু করেছে, সবকিছুই ভাগে কম পড়ছে, অমনি কোথা থেকে বিষের মতুন গল গল করে হিংসে বেরিয়ে আসতে অরম্ব হয়ে গেয়েছে।
অভাব যি অমনি করে আস্তে আস্তে হাঁ করে, কুনোদিন জানতম। ধানের শেষ মরাইটো খালি ছোট হছিল। অত বড় পেল্লায় মরাইমনে হতো, অত ধান খেয়ে কে ফুরুইতে পারবে–সেই মরাই হঠাৎ একদিন দেখলম কেমন এতটুকুনি হয়ে গেয়েছে। তারপর দেখলম ল-দাওর একদিন মুখটো হাঁড়ি করে মরাই ভেঙে সব ধান বার করে ফেললে। পোষ-মাঘ ত্যাকননা অনেক দেরি। দ্যাওরকে শুধুইতে সে মুখ কালো করে বললে, এই ধানকটির চাল ফুরুলেই বাড়ির খোরাকি ধান আর কোথাও নাই। তার কথাটো নিয়ে ত্যাকন তেমন ভাবি নাই। ওমা, ওর কথার মানে হচে এই বাড়িতে উপোস অরম্ব হবে আর দু-তিন মাসে বাদে? সিদিন কি সত্যিই আসবে? কত্তা কিছু করবে না? এই সোংসার তো তার। সেই-ই তিলে তিলে গড়েছে, সেই অ্যাকন এই খেলাপাতি ভেঙে দেবে? তার পক্ষে সবই সম্ভাব, দিতেও পারে। সিদিন রেতে একবারের লেগে দেখে ফেলেছেলম তার ভায়ানক দুঃখ আর কষ্টের মুখ! তবু কি শক্ত সেই মুখ, যেন লোহা পুড়ে গনগন করছে। ঐ মুখটিকে আমি খুব ভয় করি।
এই গরমকালেও কোথা থেকে আসছে এই হাঁড়কাপুনি ঠান্ডা বাতাস? সব একদম কালিয়ে জমে যেচে। আগে আগে সোংসারে সব জিনিশ খালি বেড়ে যেত। সব কিছুতেই ছিল বরকত, কিছুতেই কুনো কিছু শ্যাষ হতো না। অ্যানেক জিনিশই ফেলে দিতে হতো। কতবার গুড় আলু পেঁয়াজ পচে গেল, নষ্ট হয়ে গেল, সব ফেলে দিতে হলো। কখনো কখনো ভাবতে হতে এত ফলে ক্যানে? সব ল্যাজোবরা হয়ে থাকে। হাতের কাজ আর শেষ হতে চায় না। এইবার দেখছি সবকিছুতে ভাটার টান। সেই যি দু-বছর আগে ফাঁপা সমুদুরের মতুন। পানি উথাল-পাথাল হাওয়ায় দু-দিনে হুড় হুড় করে নেমে গেল, ঠিক তেমনি এক হাড়কাপুনি হাওয়ায় বাড়ির সব জিনিশ যেন উধাও হয়ে যেতে লাগল! এই ছিল, আর নাই। ভরা ছিল সকালে, বৈকালে খালি। একটু বেলা হলে গাই দুইয়ে দুধ আনা হয় বাড়িতে। অতো দুধ কোথা রাখব, কি করব, আগে এই ভাবনা হতো। কতদিন দুধ নষ্ট হয়েছে। বলে গিন্নির ধমকানি খেয়েছি। অ্যাকন দেখি, সেই দুধ এক বলকা করে রেখে দিলে ঠান্ডা হওয়ারও সময় হয় না। জা-রা সব তক্কে তক্কে থাকছে। ঘটি-বাটি-গেলাসে সবাই নিজের নিজের ছেলেমেয়ের দুধ ঢেলে নিয়ে নিজের নিজের ঘরে চলে যেচে। ননদ যি ছেলেপিলেদের ডেকে ডেকে দুধ খাওয়াত, অ্যাকন আর তার কুনো উপয় নাই। আগে দুধ ফুরুইত না, অ্যাকন সবার কুলুইচে না। ননদ দুধ দিতে যেয়ে দেখছে দু-একজনকে বাদ দিতে হচে। যারা বড় হয়েছে, তারাই কেউ কেউ হয়তো বাদ পড়ছে। জা-রা বাছাবাছির কুনো ধার ধারছে না, যে যেমন পারছে দুধ ঢেলে নিয়ে চলে যেচে। কত্তা বরাবরই রেতের বেলা এট্টু দুধ খায়। আমি তো আর কত্তার দুধ ঢেলে আনার লেগে বাটি নিয়ে জায়েদের সাথে দাঁড়াইতে পারি না। শরমে মাথা হেঁট হয়ে যেতে লাগল। আমার রকম দেখে ননদ-ই বা আর কি বলবে–চুপ করেই থাকছে। এক-একদিন দুধের কমবেশি নিয়ে জায়েদের মধ্যে লেগে যেচে তুলকালাম কাণ্ড। চিকার চেঁচামেচি শুনে কত্তা একদিন বাড়িতে ঢুকেছিল। আগে তাকে দেখলে জা-রা ভয়ে শরমে পাথর হয়ে যেত। সিদিন কেউ গেরাহ্যি করলে না। একটু দাঁড়িয়ে থেকে কত্ত আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
ভরা গোয়াল কবে খালি হলো কেউ জানে না। মাহিন্দার দুটো বিদায় হয়েছে। পাড়ার এক ছোঁড়া মাঠে গরু চরাতে নিয়ে যায়। গাইগুলিন কি দড়ি ছিড়ে ছিড়ে গোয়াল থেকে লাপাত্তা হয়েছে? কোথা গেল ঐসব বড় বড় দুধেল গাই? ক-বছর আগে মড়কে মরেছিল তিনটো, গেমার বিষ খেয়ে ধড়ফড় করে মরল সিন্দিটো। অনেক কটো বকনের বাছুর হলো না। মোষও অ্যাকন আদ্দেক। পেয়ালা রঙের একটো বুড়ি ঘুড়ী আছে অ্যাকনো। কত্তা ঘোড়ায় চাপা ছেড়েছে অ্যানেকদিন। কেউ কিনতে আসে না বলেই ঘুড়ীটো অ্যাকনো বাড়িতে রয়েছে।