আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রয়লম। আঁদারে মিলিয়ে যেতে লাগল দলটো, আঁদারেই গোটা দলটো জড়া-পুটুলি পাকিয়ে একটা বড় হেঁয়া হয়ে গেল। তা-বাদে আর তাদের দেখতে প্যালম না।
দুই চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে বসলম। ওরে, অ্যাকন কাকে ডাকি? কার সাথে দুটো কথা বলি? বাড়ি খাঁ-খাঁ করছেএত লোক বাড়িতে কিন্তুক অ্যাকন কেউ নাই, একটি ছেলেমেয়েও দেখতে পেচি না। নিজেরগুনো বড় হয়েছে। তারা মায়ের কাছে অতো আসে না। তাইলে এইবার কি আমাদেরও নিজের নিজের প্যাটের ভেতরে সেঁদোনর সোমায় হলো? শ্যাষ যি মরাইটো ছিল, তার আর আধখানা বাকি আছে। এইমাত্তর খামারে তা দেখে অ্যালম। তা ভালো। এখনো আমরা দোকান করতে যাই, গামছার কোণে দুটো চাল বাঁধা থাকে। ঐ চাল দোকানদারকে বেচে ত্যাল-নুন ট্যানাকাঠি মশলাপাতি কিনি, দু-বেলা চুলো জ্বলে, ভাতের চাল ফোটে। তবে সি আর কদিন কে জানে! আমার বুক ফেটে যেতে লাগল। উসারার খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে একা বসে থাকলম। গিন্নির ঘর ফাঁকা–সি ঘরে কো-কাপ আঁদার। এই তো কদিন হলো চলে গেয়েছে, মওতার ঘরে আলো জ্বালানোর নিয়ম। কিন্তুক আলো জ্বালাব কোথা থেকে?
যুদ্ধ নিয়ে অ্যাকন আর কেউ ভাবে না। যা হবে হোক। দিনে রেতে কতোবার কতো উড়োজাহাজ আসছে-যেচে, কেউ তাকিয়েও দেখে না। বোধায় বোমা ফেললেও কেউ গা করবে না। বোমাতে আর কতোজনা মরবে? আর মরলে সাথে সাথে মরবে। ভুখের জ্বালায় এমন করে ধুকে ধুকে তো মরতে হবে না! বউ-মেয়ে-পুতের মরণও দেখতে হবে না।
গাঁয়ে অ্যাকন কন্টোলের দোকান হয়েছে। কটো বাঁধাবাঁধি জিনিশ সিখানে পাওয়া যায়। শাড়ি এলে শাড়ি পাওয়া যায়। সবুজ বা নীল পাড়ওয়ালা মোটা, মিলের শাড়ি। আজকাল তা-ই পরছি। আর পাওয়া যায় মোটা মার্কিন কাপড়। ছেলেদের জামা তৈরির লেগে পাওয়া যায় লংক্লথ বলে আর একরকম কাপড়। মিলের শাড়ি এমন মোটা যি, ভেজালে ভারি চব্বর হয়ে যায়। তোলে কার সাধ্যি। এমন মোটা কাপড় কুনোদিন পরি নাই। ননদ পরত মিহি ধূতি। অ্যাকন সবাই ঐ মোটা মিলের শাড়ি পরছি। পাওয়া যে যেচে, সেই কত! ই কাপড়ও কন্টোলের দোকানে সব সোমায় আসে না। য্যাতো দরকার ত্যাত কুনোদিনই মেলে না। সবাই যেদি কিনতে পারত, তাইলে কন্টোলের দোকানে য্যাতোই শাড়ি আসুক সবাই পেত না। বাজারের দিষ্টে দাম বেশ কমই বটে। তা য্যাততই কম হোক, দাম দিয়ে শাড়ি কেনার লোক আর কজনা? কন্টোলের দোকানে জিনিশ পেতে গেলে রেশন কাট করতে হতো। তাতেই সব জিনিশের নাম লেখা থাকত। কাপড় ছাড়া পাওয়া যেত চিনি, ট্যানাকাটি, কেরাসিন এসব। আরও অনেক জিনিসের নাম লেখা থাকত। ঐ নাম পয্যন্তই সারা বেশিরভাগ জিনিশই থাকত না–যা বা থাকত তা কখন পাওয়া যাবে, কতোটো পাওয়া যাবে, তা বলবার জো ছিল না।
বাড়িতে কন্টোলের শাড়ি এল। শাশুড়ি নাই। তাই ননদ জা-দের সবাইকে ডাকলে, নিজের হাতে এক-এক জনের হাতে কাপড় তুলে দিলে। কিন্তু পেত্যেকে দেখলম কাপড়-হাতে মুখ নামিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে। কাপড় কি পছন্দ হয় নাই? ননদ কিছুই বুঝতে পারে না। এতকাল ইসব কাজ গিন্নি নিজে করত, তা সে চলে গেয়েছে দুনিয়া ছেড়ে। অ্যাকন ননদের ওপরেই সব দায় পড়েছে। সে বুঝতেই পারছে না, কাপড়-হাতে সব মুখ বেজার করে দাঁড়িয়ে আছে কেনে। ননদ এই কথা দু-একবার শুদুইতেই আসল কথাটো বেরিয়ে এল। কাপড় পছন্দ হয় নাই। সবই তো এক কাপড়, শুদু পাড়ের রঙ আলাদা, তাইলে পছন্দ না হওয়ার কি আছে? আমরা পাঁচ বউ সিখানে হাজির। ছোট দ্যাওরের সোংসার শহরে–তা সে-ও পরিবার অ্যাকন গাঁয়ে রেখে গেয়েছে শহরের আবস্থা দেখে। তাই আমরা পাঁচ বউ-ই হাজির। মনের কথাটি কেউ ভেঙে বললে না বটে কিন্তুক কথায় কথায় বুঝতে পারা গেল, নিজের কাপড়টোই কারুর পছন্দ লয়, অন্য জনার হাতে যি কাপড়টো সেইটো পছন্দ। কি আচ্চয্যির কথা–ননদ বলেই ফেললে, একই কাপড়, তফাত কিছুই নাই, শুদু পাড়ের রঙের তফাত। এরই জন্যে নিজের কাপড়টি পছন্দ নয়, আরেকজনারটি পছন্দ? না, এ ভালো কথা নয়, ভালো কথা নয়।
আমি তো কিছুই করি নাই, মায়ের আমল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। মেতর-ভাই শুধু মায়ের ইচ্ছার দাম দিয়েছিল। দু-বছরও হয় নাই, মা দুনিয়া ছেড়ে গেয়েছে, এর মধ্যেই সব নিয়ম পাল্টে যাবে? তা যাকগো, এই নিয়ে আমি অশান্তি করতে পারব না। শাড়ি সব এই রইল, যার যেমন মন হয়, তুলে নাও।
সিদিন এর বেশি আর কিছু হলো না। যার হাতে যি শাড়ি ছিল, সে সিটিই নিলে কুনো কথা না বলে, কিন্তুক হাসিমুখে লয়। যেমন বেজার মুখে ছিল, তেমনি বেজার মুখেই নিজের নিজের কাপড় নিয়ে গেল। কি মনে করে রেতে এই কথা কত্তাকে বলতে গ্যালম। রাগ করে বলি নাই, আমার ভালো লাগছিল না বলেই বলতে গ্যালম। তা এমন করে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে–উঃ, সি যি কি চাউনি আমার জানের ভেতরটা পয্যন্ত দেখে নিলে–আমি কথাটো আধখানা বলেই থেমে গ্যালম। এই পেথম কত্তা আমাকে যেন দেখলে, আমিও তেমনি দেখতে প্যালম কত্তাকে। কত্তার সেই চাউনির ভেতরে রাগ ছিল না। মনে হছিল কষ্টে আর দুঃখে সে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বে।
তাইলে সব্বোনাশ কি এমনি করেই শুরু হয়? চুলের মতন সরু একটো চিড় কোথা যেন ছিল, চোখে দেখতেই পাওয়া যেত না। পেথম দিন দেখে মনে হলো, কই, আগে কুনোদিন দেখি নাই তো, পরের দিন দেখছি, ওমা, তার পাশে আর একটো চিড়, তাপর দেখতে দেখতে অ্যানেক অ্যানেক চিড় সব জায়গায় কখন হলো, কি হলো, কেমন করে হলো ভালো করে কিছু বোঝার আগেই একদিন বড় বড় ফাটল ধরে জিনিশটো চৌচির হয়ে ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সোংসারেও কি তাই হতে যেচে? হঠাৎ খেয়াল করলম, আমাদের বড় সোংসার অ্যাকন কত বড় হয়ে গেয়েছে! এ তো একটো সোংসার লয়, পাঁচটা সোংসার; এ তো ডালপালা বাড়া নয়, ই বটগাছের মতুন। আলেদা আলেদা ঝুরি নেমে আলেদা আলেদা বটগাছ হয়েছে আর মূল গুঁড়িটো