সেই যে পরপর দু-বছর একটি দানা ফলল না, যুদ্বুও পেলয়-আকার নিলে, কলকাতা বন্দোয়ান আর কুন কুন্ শহরে জাপানিরা বোমা ফেললে, সেই সোমায় ধানচাল একদম গরমিল হয়েছিল, পয়সা তো দূরের কথা সোনার অলংকারগয়না দিয়েও একমুঠো চাল পাবার উপয় ছিল না। শহরেও পাওয়া যেছিল না, আবার দামেও আগুন লেগেছিল ধান-চালের বাজারে। কত্তাও ত্যাকন বলেছিল চালের এত দাম সি-ও লিকিনি বাপের জম্মে দেখে নাই। তবে গাঁয়ের কথা আলেদা, গাঁয়ের লোকে তো আর চাল কিনে খেত না। তাদের কাছে চালের দাম বাড়লেই কি, কমলেই বা কি? তারা পরপর দু-সন ধান পায় নাই একটো। তাদের তো ঠারো দাঁড়িয়ে মরতে হবে–শুয়ে-বসে আয়েস করে মরার ভাগ্যও তাদের নাই।
ত্যান দেখেছেলম, মানুষরা সব এক জায়গায় বসে না, কেউ কারুর সাথে কথা বলে না, দুটো গল্পগাছাও করে না। কিসের লেগে দিনরাত কুকুরের মতুন হাঁ হাঁ করে ঘুরে বেড়াইছে। এমনিতে কথা নাই, কিন্তুক আবার কথা মানেই মারামারি। উপোসি মানুষ মারামারিই বা করে কেমন করে? খানিক বাদেই হাঁফিয়ে যেয়ে একজনা আর একজনার দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকে যেন পারলে কাঁচা চিবিয়ে খায়। আমাদের বাড়ির খামারে দেখেছি একগাদা লোক পাঁচিলের ছোয়ায় বসে আছে কিন্তুক কেউ একটি কথা বলছে না। গাঁয়ের রাস্তায় রাস্তায় হন হন করে হেঁটে চষে বেড়াইছে মানুষ, কুনো কাজ নাই। শুদু আনাগোনা-ত্যানা, তাঁত বোনাবুনি করছে। কি করবে, কোথা যাবে কিছুই যি ঠিক নাই। আদুরে আদুরে ছেলে সব দল বেঁধে মাঠের দিকে চলে যেচে, সারা দিনে আর বাড়ি আসে না। এসে কি করবে? বাড়িতে চুলো জ্বলে নাই, হাঁড়ি চড়ে নাই–তাইলে বাড়ি এসে কি করবে? ঘাটে মাঠের পুকুরে যেদি দুটো বনকুল কি শেয়ার্কুল পায়, গাছে একটো কয়েতবেল পায় কিম্বা শালুক, পদ্মর উঁটা ঘাটা খাঝার মতুন কিছু পায় তা-ই চিবিয়ে পেটে দেবে। গাঁয়ের ইস্কুল খোলাও নাই, বন্ধও হয় নাই। যার মন হয় যায়, যার মন হয় না, যায় না। মাস্টাররাও কেউ আসে, কেউ আসে না।
নাই, নাই, কিছুই নাই। হেলেঞ্চা শাক, কলমি শাক, শুষুনি শাক যা সব যেখানে সেখানে পাওয়া যেত, যে খুশি নিয়ে যেত। অ্যাকন সিসব সারা গা খুঁজে কোথাও পাবার উপয় নাই! আচ্চয্যির কথাগাধাপুইনি, খইলুটি শাক যি শাক, যা কেউ খেত না, গরু-ছাগলেও না, সেই শাকও গরমিল। যার সজনে কি একটো ডুমুর গাছ আছে, সে অ্যাকন একটো শজনের পাতা, একটো ডুমুরও কাউকে দেয় না।
আকালের মদ্যে মানুষ কি মানুষ ছিল? পুরুষরা নাইলে প্যাটে কাপড় বেঁধে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াইত, বউ-ঝি-শাশুড়ি যারা তারা নাইলে ঘরের ভেতর মুখ বুজে বসে থাকত, জোয়ান জোয়ান বিটিছেলেগুলিন কি করে? তারা সব লোকের বাড়ি বাড়ি দাদুরে বেড়াইতে লাগল। আমি মেয়েমানুষ, তবু তাদের দিকে তাকাইতে পারতম না। ময়লা চেকট ত্যানাকানি পরে আছে। তার ভেতর দিয়ে সব দেখা যেচে, কিছুই ঢাকা পড়ে নাই। তা ঢাকা পড়বেই বা কি? না খেয়ে খেয়ে দ্যাহে কিছু নাই, ঢাকা দিলেও যা, না দিলেও তাই। সবার আবার ত্যানাকানিও জোটে নাই। কেউ এক টুকরো পচা চট জড়িয়েছে কোমরে। আর এক টুকরো জড়িয়েছে বুকে! কাকে শরম করবে, কি করে শরম করবে? এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াইছে ভূতের মতুন, গাছপালার আড়ালে আড়ালে। জট পাকিয়ে আছে চুল, ডাইনির মতন সেই চুল চুলকোতে চুলকোতে ছিড়ে ফেলছে। খারাপ কিছু তারা করে নাই। তবে খিদের জ্বালা এমমি জ্বালা লোকে করতে চাইলে কি তাদের নিয়ে খারাপ কাজ করতে পারত না? তা তেমন কিছু হয় নাই। গাঁয়ে ঘরে সবাই আকালে মরছে, ফুত্তি করার মানুষ কোথা?
গাঁ থেকে কুনো মেয়ে যায় নাই। কটো পরিবার, তা দশ ঘর হবে, গাঁ থেকে চলে গেয়েছে। ঐ দশটো বাড়ি বাগদিপাড়ার দু-ঘর, হাঁড়ি-ডোমপাড়ার তিন ঘর আর হিঁদু-মোসলমানপাড়ার চার-পাঁচ ঘর শ্যাষ পয্যন্ত গাঁয়ে আর থাকতে পারলে না। কারুর সাধ্যি হলো না যি তাদের বলে, যেয়ো না। রাত আঁদার থাকতে থাকতে কাউকে কিছু না বলে ওরা গা ছেড়ে চলে গেল। শহরে গেলে লিকিনি কাজ পাবে, কাজ খুঁজে নেবে। আমরা ভাবতম, আকাল পেরুইলে গাঁয়ে ফিরবে বোধায়। কেউ ফেরে নাই। ঘর-বাড়ির চাল গলে-পচে ভেঙে পড়েছে, ন্যাংটো দেয়ালগুলিন অ্যাকনও আছে।
একদিন সাঁঝরেতে, ত্যাখনো ভালো করে আঁদার নামে নাই, কি মনে করে বাড়ির বাইরে এসে খামারে দাঁড়িয়েছেলম। খামারের পচ্চিমদিকের দুই বাড়ির ছামনের গলি দিয়ে তামিল পুকুরের পাড় আর মাঠ দেখা যেচে। দেখি কি, পুকুরের ঢাল ধরে কারা সব মাঠে এসে নামল। ঐ তিমি-সাঁঝের আঁদারে সব ছেয়া হেঁয়া মানুষ তাদের গায়ে জামাকাপড় আছে কি নাই, এতদূর থেকে বুঝতে পারলম না। বোধায় নাই, থাকলেও ছেড়া ত্যানাকানির বেশি কিছু নাই, রেতে বেরিয়েছে য্যাকন। যেচে কোথা ওরা? ই গাঁয়ের মানুষ যি লয়, সি তোবোঝাই যেচে। তাইলে কি আশেপাশের এলেকা থেকে এসে ওরা এই গাঁয়ের ঝোপ-জঙ্গলে এসে লুকিয়ে ছিল? হায়, রেতের আঁদারও যে মানুষের এত দরকার, তা কি কুনোদিন ভেবেছি! মানুষগুলিন দূরে চলে যেচে, তা দেখতে পেচি। মেয়ে-মরদ বালবাচ্চা সব আছে ঐ দলে। সব ভূতের মতুন, সব ছেয়া ঘেঁয়া। ভাত নাই, কাপড় নাই–জেবনটো এসে ঢুকেছে প্যাটের চুলোয়। সিখান তুষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে–কিছুই চোখে দেখতে পেচে না। ইজ্জত-শরম তো দূরের কথা, সন্তানটোকেও দেখতে পেচে না। ভিটেমাটি ছেড়ে সব বেরিয়ে পড়েছে। ই গাঁয়ে এসে যি বাড়ি বাড়ি ভিখ মাঙবে তারও উপয় নাই। আধ-উদম মেয়ে-পুরুষ সব–যেদি কেউ চিনে ফেলে। দূরে যেয়ে যা খুশি তাই করবে–কে আর চিনবে?