আবার এই একই গাঁয়ে সকালে কিংবা বৈকালে যাও–কি সোন্দর! মানুষ যেচে-আসচে, কথা বলছে, ছেলে-পিলেরা খিলখিলিয়ে হাসছে, পাড়ার মেয়েগুনো অমনিই কুনো ভিটেতে ঝাল-ঝাপটি খেলছেকোথা ভূত, কোথা জিন? কেউ কোথাও নাই। বিহানবেলায় কোদাল কাধে, গরু-মোষের লাঙল নিয়ে জোয়ান মরদ ছেলে-ছোকরারা মাঠে যেচে, ওস্তাদজি পোক্কার একটো খাটো ধুতি পরে মোটা পাঞ্জাবি গায়ে পাঠশালে যেচে, কচি কচি ছেলেরাও যেচে পাঠশালে। কি সোন্দর! তাই বলছেলম একই গাঁ, তার কতোরকম রূপ।
আমি কিন্তুক একদিনও পাঠশালে যাই নাই। বাপজি যেতে দেয় নাই। মেয়ে আবার পাঠশালে যেয়ে ল্যাখাপড়া শিখে কি করবে? খানিকটো বেয়াদপ হবে, মুখের ওপর কথা বলবে–এই তো? এর লেগে পাঠশালে পড়ার কি দরকার? এইরকম দিন যি ছিল একদিন, অ্যাকন আর আমারও পেত্যয় হয় না। ত্যাকন লোকের কুনো নড়াচড়া ছিল না। কেউ কোথাও যেত না। সারা জেবন সবাই একসাথে থাকত। গাঁ থেকে এক কোশ দূরেও কেউ যেত না। মাঠের জমি, ধান, ফসল, আবাদ, পুকুর ঘুরে যে যেখানেই যাক, ঠিক সাঁঝের বেলায় ফিরে আসবে-ইয়ার কিছুতেই বে-লিয়ম হবে না। ক্যানে যাবে মানুষ! হাটে যেতে হতে পারে কুনোদিন, গরুর গাড়িতে ধান বেচতে যেতে পারে গঞ্জে কিংবা মোকামে, নাহয় কুটুমবাড়ি যেত দু-চার গা পেরিয়ে। ল্যাখাপড়া শিখে কি করবে গাঁয়ের মানুষ? বাপজি তাই মনে করত কার লেগে ল্যাখাপড়া রে বাপু!
তা পাঠশালে তো গ্যালম না, তাই বলে বয়েস কি বসে থাকবে? হঠাৎ একদিন শুনতে প্যালম আমার বিয়ের সম্বন্ধ এয়েছে। ত্যাকন আমার বয়েস চোদ্দ কি পনেরো। ত্যাকনকার দিনের হিসেবে অনেক বয়েস। এই আমাদের বয়সের মেয়েদের কুনো একটা ভুল হয়ে গেলে মা-চাচিরা বলত, শরম লাগে না ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে? বিয়ে হলে এতদিনে যি দুই ছেলের মা হতিস। তাইলে, আমার বিয়ের সম্বন্ধ যি এল তা আর আচ্চয্যির কথা কি? সম্বন্ধ এল, কথাবাত্তা হতে লাগল কিন্তুক আমাকে কেউ একটো কথাও শুদুলে না। শুদুবেই বা ক্যানে? ই ব্যাপারে আমার তো কুনো কথা নাই। মুরব্বিরা যা করবে তা-ই হবে। তারা যেদি মনে করে একটো কলাগাছের সাথে আমার বিয়ে দেবে, আমাকে তাই মানতে হবে। এইরকমই ছিল ত্যাকনকার দিন। ছেলে হয়তো ত্যাতোটা লয়, মেয়ে হলো বাপের আঘিন্নে দায়। বাপ যেদি মনে করে মেয়েকে কেটে পানিতে ভাসিয়ে দেবে, তাতে কারু কিছুই বলার নাই। সেই লেগে বলছি, মেয়ে ই কথা শুদুতেই পারবে না যি কার সাথে তার বিয়ে হচে। রূপ-গুণের কথা দূরে থাক, পাত্তরের বয়েসটোও শুদুতে পারবে না। বুড়ো হোক, ধুরো হোক, মেয়েকে মেনে নিতেই হবে। ষাট বছরের বুড়োর সাথে পনেরো বছরের মেয়ের বিয়ে ত্যাকনকার দিনে আকছার হতো। দোজবরে তেজবরে হেঁপোরুগি মাতাল চোয়ার কাউরির বিয়ে করার লেগে সোন্দর মেয়ের অভাব হতো না। সিদিক থেকে আমার তো মাহা কপালের জোর যি শোনলম, পাত্তরের বয়েস মাত্তর এক কুড়ি আট বছর। ইয়ার চেয়ে ভালো যোগ ত্যাকনকার দিনে আর কিছু ছিল না। হলোই বা আমার দ্বিগুণ বয়েস বিয়ে যে হচে এই পরম ভাগ্য! অ্যাকনকার দিনে ছেলে পেথম বিয়েই করছে দু-কুড়ি বছর বয়েসে। তাতে কুনো দোষ নাই।
শোনলম চার কোশ দূরের এক গা থেকে সম্বন্ধ এয়েছে। একটু দূর হয়ে যেছে বটে তবে মটরে আর র্যালে খানিকটা রাস্তা যাওয়া যায়। শুকনো দ্যাশ তো, গরুর গাড়িতে মাঠে মাঠে একবেলার মদ্যেই যাওয়া যাবে। তা দূরেই হোক আর কাছেই হোক, ই সম্বন্ধ ছাড়া যাবে না। নামজাদা বেরাট বংশ, আবস্তাটো অ্যাকন একটু পড়ে এয়েছে বটে কিন্তুক ভাত-কাপড়ের অভাব কুনোদিন হবে না।
আমি শুদু এইটুকুই শোনলম। পাত্তর কেমন, কি করে ইসব কথা কেউ তুললেও না, আমিও আর কিছু জানতে প্যালম না! ত্যাকন কি আর জানি এমন সোয়ামি আমার কপালে ছিল। ছিপছিপে ছোটখাটো শামলা রঙের মানুষ, আসমানের বাজের মতুন শক্ত। তবু সে সোনার মানুষ। কিন্তুক আমার লেগে মুটেই লয়–আর সবার লেগে। মা-বাবা, ভাই-বুন, আত্মীয়স্বজনের লেগেই শুদু লয়, সারা দিগরের মানুষের লেগে। আমার কথা আর কি বলব? আমাকে সে সারা জেবন হেনস্তা করেছে, কতো কুবাক্যি বলেছে, হাত ধরে ঘর থেকে বার করে দিতে চেয়েছে, তবু আমি মনের ভেতরে ঠিকই জানি ভেতরে ভেতরে কি সনমান সে আমাকে দিয়ে গেয়েছে। কিন্তু সে শুদু ভেতরে ভেতরে, নাইলে তামাম লোকের ভালো করবে, শুদু আমার দিকে চেয়ে দেখবে না।
বিয়ে হয়েছিল বৈকালি। সাঁজ রেতে একসাথ করা হলো। তা শেষ হতে না হতে লোকজন নিয়ে পালকি করে নিজের গাঁয়ে ফিরবে। একবার কি দুবার বলার পর আর কারুর সাধ্যি হলো না রাতটো থেকে যেতে বলতে। হাজার হলেও মাঠ ভেঙে পালকি নিয়ে এই এতটা পথ যেতে হবে। দিনকাল ভালো লয়, সঙ্গে সোনাদানা আছে, বেপদ হতে কতোক্ষণ?কুনো কথাই সে কানে তুললে না। সঙ্গে কজন লেঠেল আছে আর বাউরি কাহাররা তো সবাই লেঠেল। ভাবনা কিছু নাই। মিশমিশে আঁদার রেতে মিশমিশে কালো চার মুশকো বাউরি কাহার বাতাসের বেগে পালকি নিয়ে ছুটল মাঠের ওপর দিয়ে। কাহারদের হাতে এই বড় বড় লাঠি–এক একজনা যমদূতের মতুন। কে তাদের ছামনে দাঁড়াবে? সঙ্গের বরযাত্রী লোক-লস্কর সেই আঁদারেই তাদের সাথে সাথে ছুটল। খালি একজনার হাতে একটা ডেল্লাইটের আলো।
লতুন মায়ের ত্যাকন আবার ছেলেপুলে হবে। এইটুকুনি মানুষ। তেমন লড়তে-চড়তে পারছে না। ইয়ার মদ্যে তার এক খোঁকা হয়েছে। লিয়ম মতুন লতুন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে। আমিও কদলম। এইরকমই লিয়ম ছিল–গলা জড়িয়ে কাঁদতে হবে, নাইলে নিন্দে হবে। তবে কেউ কাঁদত লিয়ম মতুন, একটু হুঁ হুঁ করলে, ফোঁ ফোঁৎ করে মিছে নাক ঝাড়লে, আবার কারু কারু বুকের কবাট ফেটে যেত যেন। আমার ঠিক তা-ই হলো। এই মা, এই ভাই, এই বাড়ি-ঘর, ঘাট-পুকুর, এই আসমান-জমিন–সব ছেড়ে চেরকালের লেগে বিদেয় লিছি। কতো কথা মনে পড়ছে। কোথা থাকল মা, কোথা থাকল বাপ, কোথা থাকল ভাই! লতুন মা আওয়াজ করে কাঁদতেও পারলে না। পেটের ভারে সে ত্যাকন হাঁসফাঁস করছে। গড়গড়িয়ে চোখে পানির ধারা নামল।