লতুন মায়ের খোঁকাটি জন্মানোর পরেই দু-কোশ দূরের আমার নানার বাড়ির গাঁ থেকে মামুরা এসে বললে, এক মেয়ে এক ছেলে রেখে আমাদের বুন মরতে না মরতে দামাদ-ভাই আবার বিয়ে করেছে। সি ভালো কথা, লতুন খোঁকার জন্ম হয়েছে, সি-ও ভালো কথা, তবে আমরা আমাদের ভাগ্নেকে নিয়ে যাব, তাকে মানুষ করব। ভাগ্নিটো এখানে থাক্। তার মানে হচে, আমার মায়ের প্যাটের ভাইটোকে মামুরা নিয়ে যাবে, আমি বাপের সোংসারেই থাকব। আমার দু-তিন মামু ত্যাকন বেঁচে, খালারাও আছে, নিজের নানা আর ত্যাকন বেঁচে নাই। তাদের আবস্তা তেমন ভালোও লয়, মন্দও লয়। বরং এট্টু গরিবই বটে। তবে নামকরা বড় বংশ, চাষাভুষাে লয়। নিজের হাতে চাষবাস কেউ করে না। কেউ পাঠশালে মাস্টার, কেউ মক্তবে ওস্তাদজিবিদ্বেনবংশ আর কি! কেউ কেউ ছিল অকম্মা, ই গাঁ উ গাঁয়ের দিঘিতে মাছ ধরে বেড়াত সারা বছর, কেউ পুঁথি লিখত, কারুর শখ ছিল নানারকম তামুক খাবার। কতরকম তামুক আর কতোরকম তার সরঞ্জাম, সি আর কি বলব! মেয়েদের তো রাঁধাবাড়া আর ছেলে মানুষ করা ছাড়া আর কুনো কাজ ছিল না। বিয়ে আবার সব ঘরে ঘরে মেয়েরা কেউ বংশের বাইরে যায় না। বাইরের মেয়ে কেউ আসেও তেমন। মোসলমান মিয়ে মোকাদিমদের মদ্যে এইরকমই চল ছিল।
তা আমার ভাইটিকে নিয়ে যাবার পেস্তাব য্যাকন করলে, বাপজি একটো কথা বললে না। তার স্বভাবই ছিল ঐরকম। ছেলে নিয়ে যাবি যা। আমার সোংসারে মানুষ হবে না, খেতে পাবে না মনে করছিস, কর গা। এমন চাপা মানুষ, এ কথাগুনোও বললে না। শুদু বললে, আমার ইখানে কুনোদিন ভাতের অভাব হবে না। তবে সৎ-মায়ের কাছে ভাগ্নেকে রাখতে চাও না, আমি কিছু বলব না। যা করার তোমরাই করবে, ছেলের কাছ থেকে আমার কুনো পিত্যেশ নাই।
সত্যিই আমার কাকাল থেকে ভাইটিকে ছিড়ে নিয়ে চলে গেল মামুরা। বাপজি ঘর থেকে কোলে নিয়ে ঝর ঝর করে চোখের পানি ফেললে।
ভাইকে নিয়ে মামুরা চলে গেল।
০৩. আমার বিয়ের ফুল ফুটল
দাদি ত্যাকন আর নাই। ভাইটিও কাছে নাই। লতুন মা-ই তার নিজের খোঁকাটিকে দেখে, আমাকে তেমন আর ওকে নিয়ে বেড়াতে হয় না। এই করতে করতে একদিন আমি হঠাৎ কেমন করে যি বড় হলোম, তা নিজেই জানতে পারি নাই। কবে একদিন ফালি ছেড়ে মোটা তাঁতের শাড়ি ধরেছি। তাঁতিবাড়ি থেকেই পাওয়া যেত ত্যাকনকার দিনে শাড়ি ধুতি। শাড়ি ধরার পর আর তেমন বাড়ির বাইরে যাই না।
পুকুর-ডোবা গাছপালা আর পাঁজর-বেরুনো মাটির বাড়ি দেখে বোঝা যেত আমাদের গাঁ-টো খুব পুরনো। পাকা সয়রান হয়েছিল এই সিদিন যুদ্ধর সোমায়। দিনে দুটো, সকালে একটো আর সাঁঝবেলায় একটো-এই দুটো মটরগাড়ি যেত ঐ পাকা রাস্তা দিয়ে।ইছাড়া সারাদিন শুনশান–গাঁ-টোকে মনে হতো ই দুনিয়ার লয়। আমি তো চিনি গাঁ-টোকে! গেরস্ত বাড়ির ছামনে অত বড় পাকুড়গাছ, ই কি অলক্ষুনে লয়? পাকুড়গাছ থাকবে মাঠের মাঝখানে, নাহয় গাঁয়ের মাঝখানটোয়, যেখানে লোকজন এসে বসবে, তামুক খাবে–তা লয়–পাকুড়গাছ, মাহারুহ গাছ, বাড়ির এগৃনের ওপর। ই অলক্ষুনে লয়? কাকচিল তো বসছেই,শকুনিও এসে বসছে। মরা গরু-বাছুরের হাড়, বেড়াল-কুকুরের ছেড়া চামড়া এইসব পড়ছে বাড়ির এগনেয়। ভিন পাড়ায় যাবার সোমায় বেলগাছের মাথায় দুটো শাকচুন্নিকে আমি অ্যানেকদিন দোপরবেলায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। কারুর বাড়ির মাছভাজা খাবার যুক্তি। ই গাঁয়ের বাতাসটোই এমনি। মাঠের বড় পুকুরটোর ধারে প্যাক্তা তত যে খুশি দেখতে পেত সাঁঝবেলাটা পার হলেই। লোকে ইসব জানত। তবে এদের ঘরের লোক বলেই মনে করত। লোকে যেন মনে করত মানুষ দুরকম–মরা মানুষ আর জ্যান্ত মানুষ। একসাথে তো থাকবেই। যেসব জ্যান্ত মানুষ ঘরে-বাইরে ঘুরে বেড়াইছে, তাদের মদ্যে দু-একটো মরা মানুষ যি নাই তা কে বলবে? চেনবার তো বাগ নাই। কি রূপ নিয়ে কার ভ্যাকে জ্যান্ত মানুষের সাথেই যি জিন-ভূত আছে তা কেউ বলতে পারবে না। আমার ছোট মামুর ঘরেই একটো জিন থাকত, তার কথা আমি নিজের কানে শুনেছি। সে ছিল ভালো জিন, বাড়িতে হঠাৎ মেহমান এলে সরু গলায় ক্যান ক্যান করে বলত, উসারায় তক্তপোশে মিষ্টি আছে দ্যাখো গা। বাড়িতে অমুক এয়েছে, মিষ্টি লাগবে না?
মিষ্টি লাগবে তো আপনি আনতে গেলেন কেন? মামু জিজ্ঞাসা করলে।
বাড়িতে মেহমান এলে মেহমানদারি করতে হয়, মেহমানের খেদমত করতে হয়।
তা তো হয়, তা আপনি কোথা থেকে কার মিষ্টি নিয়ে এলেন?
আমরা জিন, আমরা সব পারি।
কার না কার মিষ্টি এনেছেন, দাম দিয়েছেন?
আমাদের দাম দিতে হয় না।
মামু মক্তবের ওস্তাদজি, এট্টু রাগ করে বললে, আর কোনোদিন আনবেন না।
টিনের চালে ত্যাকন খুব শব্দ হতে লাগল, জিন-ও রেগেছে বুঝতে পারা গেল। তা সি যাকগো, লোকে জানে না, আমরা জানি যি রাতদোপর আর দিনদোপর একরকম, কুনো তফাত নাই। নিশুতি রাতদোপর যেমন ছমছম ছমছম করে, দিনদোপরও তেমনি। পেত্যয় হলে জষ্টি মাসের দোপরবেলায় ত্যাকনকার দিনের গাঁয়ের ভেতরে ঢুকতে হবে। দোপর ঠিক নিশুত রেতের মতুন। সারা গাঁ খাঁ খাঁ করছে, রাস্তায় একটি লোক নাই, কুনো পেরানির সাড়া-শব্দ নাই–গরুর গোয়ালের আঁদার মাচান থেকে উই যি গাওড়া খটাশটো রাস্তায় গরম ধুলোর ওপর দিয়ে বাপ বাপ বলে ডাকতে ডাকতে যেচে কে বলবে ওটো খটাশ লয় আর কিছু? আর ঐ যি গাঁয়ের ই কোণে উ কোণে একটো-দুটো পুরনো মাটির ঘর ছিল যিগুনোয় কুনো মানুষ বাস করত না, আলকাতরা মাখানো আমকাঠের দুয়োর শেকল-তালা দেওয়া থাকত, ঐ ঘরগুনো কি একদম ফঁকা? দেয়ালঘেরা এগনে, ঘরের পিড়ে কি একদম শুন্যি? তা লয়, তা লয়। ঐসব ভিটে ঐসব ঘর ক্যানে ছেড়ে যেত লোকে? তা কেউ বলতে পারবে না।