ইদিকে ল্যাখাপড়া জানা মানুষ–বাংলা জানত, ফারসি জানত। গাঁয়ে ত্যাকন পাঠশালা হয়েছে বটে কিন্তুক বাপজি কোথা থেকে ওসব শিখেছিল, তা জানি না। ল্যাখাপড়া শেখার লেগে ত্যাকনকার দিনের মানুষ কোথা কোথা সব চলে যেত। বাপজি-ও লিশ্চয় কোথাও যেয়ে শিখেছিল ল্যাখাপড়া। ফারসি বয়েত বলত মাঝে মাঝে আর একটো বাংলা শুভঙ্করি বই লিখেছিল। ইসব অ্যানেকদিন দখিন-দুয়োরি ঘরের চ্যাঙরিতে টাঙানো ছিল। পরে আর দেখি নাই।
জমিজমা আমাদের বেশ ছিল। খাওয়া-পরার অভাব হতো না। কিন্তুক ঐ জমিই সব–আর কিছু নাই। কঠিন চুম না করলে কিছুই পাবার উপয় ত্যাকন ছিল না। জান-পরান দিয়ে খাটলে ভাতের অভাব নাই। নিজে খাও, গরিব-দুখিকে দাও। নুন আর মশলাপাতি ছাড়া কিছুই তো কিনতে হতো না। পরের কালে দেখলম কেরাসিন কয়লা আর মিলের শাড়ি কিনতে হতো।
আমাদের ছেলেবেলায় ধুতি আর শাড়িও কিন্তুক তাঁতিবাড়িতে কিনতে পাওয়া যেত। ই কথার মানে হচে, কম-বেশি জমি যার আছে তার সব আছে, তার আর কুনো ভাবনা নাই। সবরকম আনাজপাতি, চাল-গম-আটা, তেল-ডাল-গুড়, মিষ্টি-দুধ-দই-ছানা কিছুর অভাব নাই। তবে গরিবের অভাব সব কালে। জমি-জিরেত না থাকলে উপোস না করে কি উপয়? তবে একটা কথা না খাটতে পারলে তোমার শত জমিজমা থেকে কিন্তু কিছু পাবে না। তা তুমি নিজেই খাটো কি মুনিষ-মাহিন্দার খাটাও।
বাপজি সব কাজ জানত। এমন কাজের লোক আমি জেবনে দেখি নাই। ই কি আচ্চয্যি–হ্যানো কুনো কাজ নাই যা বাপজি পারত না। চাষবাসের য্যাতো কাজ, জমি চষা, রোয়া, নিড়ননা, ধান কাটা, গম কাটা, ঝাড়া, মরাই তৈরি করা, ইসব কাজ তো বটেই, জাল বোনা, মাছ ধরা, বাঁশের কাজ, কাঠের কাজ–বিশ্বসসাংসারের সব কাজ তার জানা ছিল। তা বলে সব কাজ কি নিজে নিজে করত, তা লয়। বরঞ্চ আয়েশিই ছিল খানিকটা। ডালপালায় বড় বংশ, আদ্দেকটো গাঁই আমাদের জ্ঞাতিগুষ্টি ভাই-ভায়াদে ভরা। আর তেমনি দাপট। জমিসম্পত্তি বিস্তর। বড় বড় পুকুর, দিঘি ইসব ছিল। সব জমি চাষ হতো না, পড়ে থাকত। গরু-মোষ চরার লেগে জমি, ভাগাড়ের লেগে আলাদা জমি সব ছিল।
বাপজির ভাইদের সব আলো আলেদা সংসার, আলো আলেদা বাড়ি। দলিজ খামার সব আলেদা ইয়াদের মধ্যে বাপজির বড় ভাই, আমাদের দেড়েল চাচার কুনো সংসার-ছেলেমেয়ে ছিল না। তার কি নোম্বা-চওড়া চেহারা! ভয়ে মুখের দিকে চাইতে পারতম না। মুখভত্তি সফেদ পাকা দাড়ি নাভির নীচে এসে পড়ত আৰু তেমনি ঘের সেই দাড়ির। চোখ আর কপাল বাদ দিলে মুখের! কুনো জায়গা বাদ ছিল না আর তেমনি ঘন নোম্বা গোঁফ। হাঁ-মুখটা দেখতেই পাওয়া যেত। বাঘের মতুন গলার আওয়াজ। আমরা ভেজা দুরের কথা, গাঁয়ের কুনো মানুষ তার ছামুতে দাঁড়াইতে পারত না। তা দেড়েল চাচাও কম কথার মানুষ, চিৎকার চ্যাঁচামেচি কুনোদিন করে নাই। বুজুর্গ মানুষ, কটো পুঁথিও লিকিনি লিখেছিল। তাকে আমরা দেড়েল চাচা কলতম ক্যানে? চাচা য্যাকন পেশাব করতে বসন্ত, দাড়ি এসে পড়ত ডুয়ে। সেই লেগে দু-হাতে দাড়ি গোছ করে ধরে ডান বগলে ভরে তবে পেশাব করতে বসতে পারত।
দেড়েল চাচা কুনোদিন বাড়িতে ঢুকত না। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে মসিদ দিঘির দখিন পাড়ে আমাদের দলিজ ছিল। সেই দলিজেই থাকত চাচা। দলিজটো উত্তফ্র-দক্ষিণে নোম্বা। মাটির দেয়াল আর টিনের চাল। তাতে তিটো ঘর। দখিন দিকের ঘরটো এমনি পড়ে থাকত। বাকি ঘরটোয় মেহমান কিংবা বিদেশী কেউ এলে থাকতা; আর উত্তর দিকের ঘরটোয় থাকত দেড়েল চাচা। একটো তক্তপোেশ”চাচার বিছেনা, বালিশ। এক পাশে কাঠের চৌপাইয়ের ওপর ফরসিকো। ইয়া নোম্বা তার নল। ভুরভুরে গন্ধময়লা অম্বুরি তামুক দিয়ে কঙ্কে সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে সেই ফরসি দেওয়া হতো দেড়েল চাচার হাতে। দেড়েল চাচা রাত-দিন ভুরুক ভুরুক তামুক টানত, ম-ম গন্ধোয় ভরে যেত খানকা। খানকার বাঁ দিকে বেরাট মসিদ দিঘি, তার পচ্চিম-পাড়ে ভাঙা কিন্তুক পাকা মসিদ। পুবদিকটো একদম খোলা। বাঁ দিকে খানিকটা দূরে খাঁ-দের খামারের ঘরদুয়োর খানিকটো দেখা যেত।
ঘরের ভেতর পুবমুখো বসে দেড়েল চাচা ফরসিতে তামুক টানছে। দোপরবেলায় দস্তরখানা কাঁধে ফেলে খাঞ্চা করে ভাত-তরকারি নিয়ে যেছে আব্যশ চাকর। রেতে খাবার নিয়ে যেচে ঐ আব্যশই। দিনে-রেতে আর কুনো লোকই চাচার কাছ ঘেঁসতে সাহস পেত না। সি একটু কেমন বেপার না? আবার কথা শোনো। ক ক রোদে কাকপক্ষী নাই, গরম হাওয়ায় ধুলোয় দম আটকিয়ে যায়, এমন সোমায় কোন্ গাঁয়ের কোন্ বেল্লিক ছাতা মাথায় দিয়ে দলিজের ছামনে দিয়ে যেছে। দেড়েল চাচা শুদু হেঁকে উঠলে, কে? কে যায়? আবশ, ধরে নিয়ে আয় তো! দেখি কোন্ লায়েক ছাতা মাথায় আমার খানকার সামনে দিয়ে যায়। বেয়াদপ!
আর বলতে হতো না, ছাতামাতা গুটিয়ে সি লোক তো ভয়ে কাপতে শুরু করত। লোকে বলত, আমাদের দেড়েল চাচা কামেল মানুষ ছিল। কেউ বলত, দু-দুটো জিন তার ফরমাশ খাটত। আমরা সিসব জানি না। তার ছামনে পড়তম না কিছুতেই। দেড়েল চাচার মওত হলে ঐ দলিজের উত্তর দিকেই পুকুরের পাড়ে তার মাটি হয়েছিল। কেন যে গোরস্থানে হয় নাই তা আমরা কেউ জানি না।
যাকগো, ভাই-বেরাদরে বিরাট এই বংশ। কাউরির সাহস ছিল না একটো কথা বলে। কিন্তু বাপজি নিজে কাউরির সাথে মাখামাখি পছন্দ করত না। ভাই, চাচাতো ভাইদের সাথেও না। মা মরার পরে বিয়ে আবার করলে বটে তবে ঐ একলা স্বভাবটা ঠিকই রইল। বিয়ের কিছুদিন পর লতুন মায়ের প্যাটে আবার একটো ভাই হলো আমাদের। তারপরে হয়েছিল আরও তিন বুন। লতুন মায়ের মতুন ভালো মানুষ দুনিয়ায় দেখা যাবে না। সব দিকে নজর তার। তবে সবচাইতে বেশি নজর আমার আর আমার ছোট ভাইটোর দিকে, তার পরে তার নিজের ছেলেমেয়ে। কালোপানা মানুষটির চেহারা-ছবি যেন পটে আঁকা। আর কি যি তার হাতের গুণ! ঐ হাতের রাঁধা যে একবার খেয়েছে, সে কুনোদিন ভুলতে পারবে না। মাটির ঘরের দেয়াল কেমন করে যি লেপত, সি আর কেউ পারবে না। গরুর গাড়ি করে লাল মাটি আনিয়ে রাখত এরোলের মাঠ থেকে। সেই মাটি দিয়ে ছোট ছোট ম্যাঘের গায়ে ম্যাঘের মতুন দেয়াল লেপত। ঠিক যেন লাল কোদালে কুড়ুলে ম্যাঘের আসমান।