যা-ই হোক, পরের দিন বৈকালির টেরেনে ডাক্তার এল। ইস্টেশনে মোষের গাড়ি গেয়েছিল, কত্তা ডাক্তারকে নিয়ে বেলা থাকতে থাকতেই বাড়ি এল। হাত-মুখ ধোবে না, কিছু খাবে না, হ্যাট-কোট পরা ডাক্তার সোজা রুগির ঘরে চলে এল। ঘরের বাইরের উসারা থেকে আমরা সব দেখছি। ডাক্তারের বয়েস খুব বেশি লয়, সোন্দর মুখ, ফরশা চেহারা। অনেক রকম করে রুগি দেখলে, তাপর দেখা হয়ে গেলে এমন চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকলে যি সি দেখে আমার হাত-পা প্যান্টের ভেতর সেঁদিয়ে যেতে লাগল। হ্যাঁ,ই সান্নিপাতিক জ্বরই বটে–এই কথাটি য্যাকন সি উশ্চারণ করলে, মনে হলো আমার কলজেয় যেন একটো কালসাপ ছুবলে দিলে।তাইলে গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তার যা সন্দ করছিল, তা-ই ঠিক? কি হবে অ্যাকন? ই রোগের কি চিকিচ্ছে নাই? শোনলম, ঘরের ভেতর ডাক্তার বলছে, সান্নিপাতিক জ্বরের কুনো চিকিচ্ছে নাই, ই কথা ঠিক লয়। মেয়াদি জ্বর তো-একুশ দিন, আটাশ দিন, কুনো কুনো সোমায় ছাপ্পান্ন দিনও ই জ্বর থাকে, তাপরে ছেড়ে যায়।
জ্বরের মেয়াদের সময়টায় আমরা দেখি রুগির দেহে যেন শক্তি থাকে–জ্বরটা সহ্য করতে পারে। সবচেয়ে দরকার হলো যত্ন আর সেবা। এই দুটোই হলো আসল ওষুধ। মুশকিল হচ্ছে, নাড়ির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। হজম করার ক্ষমতা থাকে না, নাড়িতে দগদগে ঘা তো! আবার। শক্ত খাবার কিংবা পুষ্টিকর খাবারও কিছু দেওয়া যায় না।
ওষুধ যা দেবার আমি দিচ্ছি, ক’রকম বড়ি থাকবে, মিকশ্চার থাকবে। রুগিকে আপনারা ডাবের জল দেবেন। জল দিয়ে রান্না করা সাগু-বার্লি দেবেন–কখনো বেদানার রস দেবেন, তবে বেশি নয়, পেট খারাপ হয়ে। যেতে পারে। মাঝে মাঝে ঠান্ডা জলে মাথা ধুইয়ে দেবেন।
এইসব বলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ঘরের চারিদিকে চেয়ে ডাক্তার বললে, রুগির ঘর একবারে আলাদা হবে, যখন-তখন কেউ ঘরে ঢুকবে না। ঘরে বেশি আলো থাকবে না, আবার হাওয়া চলাচল যেন থাকে, দেখবেন–বলতে বলতে ডাক্তার ঘরের বাইরে এসে সবাইকে সাথে নিয়ে চলে গেল। ত্যাকন গিন্নি আমাকে ডেকে বললে, মানুষের সোংসারে ঝড়-বিষ্টি আপদ-বেপদ আসবেই। চিরকাল কারু সুখেও যায় না, দুখেও যায় না। শোনো মেজ বউ, ছেলের দায়িত্ব তোমার আর মহুদার। ঘর-সোংসারের কাজ যা পারবে করবে, না পারলে করবে না।
এইসব দায়িত্ব নিয়ে লেলম আমি আর আমার বেধবা ননদ। উত্তর-দুয়োরি ঘরটোই বাড়ির সবচেয়ে ভালো ঘর। কারুকাজ করা মেহেগোনি-কাঠের একটি দরজা আর ঐ উত্তরেই একটি বড় জানে। ঘরের ভেতরটো একটু আঁদার-আঁদার পুবে জানেলা নাই। দক্ষিণে টানা দেয়াল, কুনো জানেলা নাই, পশ্চিমেও নাই। তবু এই ঘরটিই সবচাইতে ভালো। সেইখানে লতুন করে বিছেনা পাতলম, সব জোগাড়যন্তর। করলম। ফল-পাকুড় ছেলে যা যা খেতে পারে সব আনা হলো। বেদানা-নাশপাতি, নেবু–এইসব ফল এল, ডাবের পাহাড় জমল। সারা বাড়িতে সাড়া-শব্দ নাই, কেউ কথাবার্তা বলতে চায় না। দু-একটা কথা বলে ফিসফিস করে, ছেলেমেয়েরা পয্যন্ত কঁদতে ভয় পেচে। বাড়িতে অ্যাকন ছেলেমেয়ে তো খুব কম লয়, আমার দুটি–পরের খোঁকা আর মেয়েটি, সেজ বউয়ের দুটি খোঁকা আর ভাগ্নেদুটি আছেই। কখনো কখনো কোলের খুঁকি কিংবা সেজ-র ছোট খোঁকাটি চিচকার করে কেঁদে উঠলে চমকে উঠি। দোপরবেলায় সব শুনশান, বাড়ির লোকজন সব ঘরে, কারু মুখে রা নাই। কানে আসত কা কা কাকের ডাক মনে হতো যেন ই জগতের লয়, অন্য কুনো দুনিয়া থেকে কাক ডেকে যেচে। কুরুর কুরুর করে ঘুঘু ডাকত, তাও মনে হতো অন্য কুনো জগৎ থেকে ডাকছে। গা ত্যাকন শিউরে উঠত, মনে হতো এখুনি একবার খোঁকাকে দেখে আসি। মা নাই, এই ফাঁকে কে না জানি কি করছে! মা হাজির থাকলে আজরাইলও কিছু করতে পারবে না ছেলের। ছুটে চলে য্যাতম রুগির ঘরে। আঁদার ঘরে হঠাৎ ঠাওর হতো না খোঁকা কুত্থানে আছে। তাপর আঁদার চোখে সয়ে এলে দেখতে প্যাতম ঘরের এক কোণে বিছেনায় শুয়ে আছে খোঁকা। বিছেনায় যেন মিশে গেয়েছে ছেলে, মুখ শুকনো, শুদু চোখদুটি টকটক করছে। কিছু খাবে বাপ? না। মাথা টিপে দেব? না। যা শুদুই তাতেইনা। কাউকে তো কুনোদিন বেস্ত করতে শেখে নাই। নিজের লেগে কিছুই যি চায় না সে। তবু মাথায় হাত দি। জ্বর অল্পই, কিন্তুক এট্টু না এট্টু লেগেই আছে।
এমনি করে একটি একটি দিন পার হতে লাগল। অ্যাকটো করে দিন যেচে, না অ্যাকটো করে যুগ কেটে যেচে। সকালে সুয্যি উঠে দিন শুরু হলে মনে হচে, এই দিন আর শ্যাষ হবে না, সুয্যি আর ডুববে না। আবার সাঁঝবেলায় আঁদার নেমে রাত অরম্ব হলে মনে হচে, ই রাত বোধায় আর কাটবে না।
সকাল দোপর রেতে রাঁধা আছে, খাওয়া আছে। বাড়ির লোক আসচে-যেচে, খেচে–সবই করছে। জন-মুনিষরাও কাজকম্ম করতে যেচে। তবু মনে হচে সব চুপ, সব থম মেরে আছে। বাড়িতে হাসি নাই, গান নাই, কথা নাই। বাপ-চাচাদের দেখে মনে হচে তারা যি জানে ধরে বেঁচে আছে, ই বড় শরমের কথা। মনে হচে কতো অপরাদই তারা করছে, লুকিয়ে লুকিয়ে চুরি করে অ্যাকনো বেঁচে আছে! বংশের বড় ছেলে, মোলো বছর চলছে, মানুষের মতুন মানুষ হয়ে গেয়েছে, সি ছেলে মরণরোগে পড়ে আছে, তাইলে তারা ক্যানে বেঁচে থাকবে? খানিক বাদে বাদে একজন করে খোঁকার বিছেনার কাচে আসছে, চুপ করে খানিক দাঁড়িয়ে থাকছে, তাপর কথাটি না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেচে। অ্যাকন দেখছি, ই-বাড়ি উ-বাড়ি থেকেও লোক আসচে খোঁকাকে দেখতে। হিঁদুপাড়া থেকেও লোক আসছে। শুদু যি কত্তাকে তারা চেনে, মান্যিগন্যি করে, সেই লেগেই যি আসচে তা তো নয়, আমার উ ছেলে সারা গাঁয়ের পিয়, সেই লেগেই তারা সব না এসে পারছে না। একদিন কত্তামা-ও পালকি করে এসে দেখে গেল। য্যাতো লোক আসে, ত্যাতো আমার কলজে খামচে খামচে ধরে। তাইলে কি খোঁকা আমার ই দুনিয়ায় থাকবে না?ই তাইলে কি মিত্যুরোগ-ই কি হলো গো! আবার এক-এক সোমায় ভাবি, আমি মা, আমি বাঘিনি, কই, কে নিবে–নিয়ে যাক তো আমার ছেলে আমার ছামনে থেকে!