এই যি জ্বর এল আর ছাড়লে। সকালবেলাটোয় কম, মনে হতো বুঝিন গেয়েছে, পেথম দিন যেমন মনে হয়েছিল। কিন্তুক ঐ জ্বরকাঠি দিতেই দেখা যেত জ্বর আছে, ছাড়ে নাই। তিন-চার দিন এই রকম গেল, সকালে কম, রেতে অ্যানেক জ্বর। খাওয়ারও রুচি নাই, তা-বাদে, এই কদিন পাইখানা বন্ধ ছিল, একদিন খুব শক্ত পাইখানা হলো, তাপর ঘন ঘন লরম বাজি আর প্যাটে যন্তন্না। কত্তা গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তারকেই আগে ডাকলে।
জ্বরটো যাচ্ছে না কেন, তিন-চার দিন হয়ে গেল–কত্তা শুদুইলে ডাক্তারকে। লাঙলা চাষার মতুন চেহারা ডাক্তারের, দেখলে পছন্দ হয় না। তা মিছে লয়, নিজের হাতে চাষবাস করে ডাক্তার, দরকার হলে লাঙলের মুটোও ধরে। দুই পায়ের আঙুলে হাজা, হাতের আঙুলগুলিনও এই মোটা মোটা! কি করে পছন্দ হবে এমন ডাক্তার? খানিকক্ষণ সে খোঁকার নাড়ি টিপে চোক বুজে থাকলে, তারপর বললে, জিভ বার করে অ্যা অ্যা করো। সব দেখে শুনে শ্যাষে বললে, হাঁ জ্বর আছে–কিসের জ্বর তা তো এখন বলতে পারা যাচ্ছে না। জিবে ময়লা পড়ে রয়েছে। যা-ই হোক, টাইফয়েড সন্দেহ করছিআর দু-চার দিন যাক, রোগ ঠিক বেরিয়ে পড়বে। ওষুধপত্তর কিছু দিচ্ছি। শক্ত খাবার একদম বন্ধ, সা-বালি খাবে, তাতে দুধ দেওয়া চলবে না, জল দিয়ে রান্না করতে হবে। ডাবের জলটা খেতে পারবে আর বেদানার রস। এইরকম চলুক।
এইসব বলে চার আনা ভিজিট নিয়ে ডাক্তার চলে গেল। কথা শুনে কত্তা লিশ্চিন্ত হতে পারলে না, হেমাপ্যাথি ডাক্তারটি বন্ধু লোক, তাকে ডেকে নিয়ে এল। ই ডাক্তারের পরনে একটো হেঁটো ধুতি, কাঁধে একটো মোটা চাদর। সি যি কতো কথা শুদুইলে তার আর অন্ত নাই। অত কথার জবাব খোঁকা আর কি দেবে? ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা শোনছেলম। কত্তাই সব কথার জবাব দিচে, শেষে সে বললে, তোমার কি মনে হচ্ছে? ডাক্তার বললে, সর্বাংশে কিছু নয়–আমি তিনটি পুরিয়া দেব–বাস, আর কিছু লাগবে না।
ঐরকম করে কথা বললে কি কিছু বোঝা যায়। আমি কিছু বুঝতে পারলম না। আরও দুটো দিন গেল কিন্তুক জ্বর একবারও ছাড়লে না। সকালের দিকটোয় একটু কম থাকে, গায়ে-মাথায় হাত দিয়ে মনে হয়, জ্বর নাই আর জ্বরকাঠি বগলে দিলেই দেখা যায় এট্টু জ্বর লেগেই আছে। ক্যানে জানি না, আমার মন খুব কু ডাক ডাকতে লাগল। কিন্তুক কাকে কি বলব বেশি কিছু বলতে গেলেই লোকে বলবে মেতর-বউ বাড়াবাড়ি করছে। অসুখ-বিসুখ যি মানুষের গা-সওয়া। সবাই জানে অসুখ আছে চিকিচ্ছে নাই-সেই লোগে অসুখে কেউ গা করত না। বলত উ কিছু লয়, গা-গরম, এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। ভালো কি আর হতো? হাজার কিসিমের রোগ-বালাইয়ে হর-হামেশা লোক মরত। কতোরকম অসুখই না ছিল–ঝি-বউদের সূতিকা রোগ, ছোট ছোট ছেলেমেয়ের পুঁয়ে-লাগা রোগ–দিন দিন শুকিয়ে যেচে, শুকিয়ে যেচে, শেষে একদিন মরে গেল, আর একটা রোগ হুপিং কাশি, বাবা রে কি কাশি, কাশতে কাশতে চোখে রক্ত পয্যন্ত জমে যেত, তাপর বড়দের হাঁপানির ব্যায়রাম-ইসব রোগের কুনো চিকিচ্ছে ত্যাকন হতো না। ওগুনো যেন রোগই লয়। দু-একটো মরে গেলেও কুনো শিক্ষে নাই। তেমনি বাতাস লেগে মওত, বাণ মেরে মানুষ মারা ইসবও ছিল। আর ছিল দুটি অসুখ–সি হলে কেউ চিকিচ্ছে করাত না, কুনো চিকিচ্ছে ছিলও না। একটি হলো কুট–হাতে-পায়ে কুটই ভালো হবার লয়, কুনো চিকিচ্ছে নাই। সবচাইতে খারাপ শাপ হচে তোর মুখে কুট হোক। আর একটো হচে ক্ষয়-কাশি, উ হলে মওত আসবেই, চিকিচ্ছে কিছুই নাই। সব শ্যাষে আর ছিল দুটি রোগহুড়মুড়িয়ে এসে পড়ত। একটি হলো নামুনে-কলেরা আর একটি গুটি-বসন্ত। এই দুটি রোগ আপনা-আপনি হতো না। দুই হারামজাদি মাগী এক গাঁ থেকে আর গাঁয়ে নিয়ে যেত। এক মাগীর নাম মা-শেতলা, আর এক মাগী ওলা-বিবি। একজনা বসন্তের, আর একজনা নামুনের, একজন হিঁদু, আর একজনা মোসলমান। দুজনায় মিলে কি মাহা-কাজই না করত! ত্যাখন আর হিঁদু-মোসলমান বাছত না। এক-একটো গাঁয়ে দশ-পনেরোদিন থাকত। কতো বংশ যি নিব্বংশ হতো! বিরান হয়ে যেত গাঁ-কে গাঁ। পরে আর একটি গায়ে যেত। এই দুটি মাহামারী রোগ এলে লোকে চিকিচ্ছে আর কি করাবেদু-হাতে মাথা চাপড়াত।
আমিও খোঁকার অসুখটোকে মনে করেছেলম এমনি জ্বর। দু-দিন বাদেই সেরে যাবে। অ্যাকনো তা-ই মনে হচে। যি রোগের কথা ঐ হেঁটো-ধুতি পরা বামুনটো বলে গেল, সি লোগ আমার ছেলের হতে যাবে ক্যানে? কার কাছে কি দোষ আমি করেছি, কার কি শাপ আমি কুড়িয়েছি যি আমার বড় খোঁকার উ রোগ হতে যাবে? উ কি য্যাকন-ত্যাকন যার-তার হয়? জাতসাপের কামড়ের মতুন উ হলো কালরোগ। পাড়াগাঁয়েরও সব লোক জানে সান্নিপাতিক জ্বর হলে রুগি বাঁচে না। ঐ একজ্বরী সান্নিপাতিক এমনি জ্বর যি একনাগাড়ে একুশ দিন, না-হয় আটাশ দিন, না-হয় ছাপ্পান্ন দিন গায়ে লেগে থাকবে, কিছুতেই ছাড়বে না–শত ওষুধ-পত্তরে কুনো কাজ হবে না। ঐ মেয়াদের মদ্যে রুগি মরে গেল তো গেল, মেয়াদ পয্যন্ত যেদি বেঁচে থাকে তত সুস্থ হবে বটে কিন্তুক একটি অঙ্গ হয় একটি চোখ, না-হয় একটি হাত কিংবা একটি পা লষ্ট হবেই হবে। এমনি কঠিন রোগ! আমার ছেলের কি সেই রোগ হয়েছে? তা ক্যানে হবে? এই দিন-দুনিয়ার সব মানুষ ভালো থাকুক–সব মায়ের পুত!
কিন্তুক সাত দিন পেরিয়ে গেল, ছেলের জ্বর ক্যানে যেচে না? প্যাটটোও খারাপ হলো, তলপেটে দরদও খুব। কত্তা বরং একবার শহর থেকে ডাক্তার নিয়ে আসুক। আমি আর থির থাকতে পারছি না।
১৪. যা ভয় করেছেলম তা-ই হলো, ই সান্নিপাতিক জ্বর
কি করে শহর থেকে বড় ডাক্তার আনা সোম্ভাব হলো, আমি জানি না। বোধায় জমিই খানিকটা বেচতে হলো। দ্যাওর-রা সব ঘেঁকে ধরলে কত্তাকে।গিন্নি আর ননদও দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিলে তাকে। ছেলেই যদি চলে গেল, সম্পত্তি ধুয়ে কি পানি খাবে কত্তা? ছোট দ্যাওর তো কেঁদেই ফেললে। গলা তুলে একটি কথা কুনোদিন সে বলে না কত্তার কাছে, সিদিন কঁদতে কাঁদতে বললে, দু-দিনের মধ্যে শহর থেকে বড় ডাক্তার যদি তুমি না আনো, আমি বিষ খাব বলে দিচ্ছি, এই সংসারের ভাত আমার হারাম হয়ে যাবে।