আমার চিচকার শুনে গিন্নি এগিয়ে এসে খোঁকার কপালে হাত রাখলে। সে তো অস্থির হবার মানুষ লয়, যাতে বেপদই হোক, মাথা তার ঠান্ডা। কপালে একবার, বুকে একবার হাত দিয়ে গিন্নি আমার দিকে চেয়ে বললে, হা, জ্বর অনেক। তা এত হ্যাঙ্গামা-হুঙ্কুতে জ্বর আসবে না! কেন ভাই, এসবের মধ্যে থাকছ তুমি? তা যাক, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এয়েছে, জ্বর নিয়ে ভাবতে হবে না, আপনা-আপনিই চলে যাবে। যাও, মেজ বউ, উত্তর-দুয়োর ঘরে বিছেনা করে দাও।
সাঁঝবেলার আঁদারে সব ভূতের মতুন দাঁড়িয়ে আছে।পিদিম কিল কিছুই ত্যাকননা জ্বালানো হয় নাই। তখন-তখুনি বিছেনা করব কিআগে একটো রেড়ির ত্যালের পিদিম জ্বালিয়ে উত্তর-দুয়োরি ঘরে ঢোকলম। এমন লাগচে ক্যানে মা! এত আঁদার লাগচে ক্যানে। ঘরের এক কোণেপিদিমটো রাখলম–সারা ঘর যেমনকার তেমনি আঁদার। শুদু পিদিমটো মিটমিট করে জ্বলতে লাগল এক কোণে। খুঁজে খুঁজে বারুণ আনলম, তিমি-সাঁঝে ঝট দিতে নাই। তবু ঘরটো একবার ঝট দেলম, খেজুর পাতার নকশা করা শেতল পাটিটো পাতলম, তাপর হাতের আন্দাজে খুঁজে খুঁজে সিন্দুকের ভেতর থেকে সুজনিটো বার করে পাটির ওপর পাতলম–আহা ত্যাকননা জানি না, জাদু আমার কি কষ্ট করে ঘরের ভেতরে আঁদারের মদ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যি ছেলে সহজে নিজের কষ্টের কথা বলে না, সেই ছেলে য্যাকন বললে, মা, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, ত্যাকন আমার হুশ হলো। এই যি বাপ, এই হয়ে গেল বলে তাড়াতাড়ি করে আমি খোঁকাকে ধরে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিতে দিতে বললম, হ্যাঁ বাপ, পুলিশ কি তুকে মেরেছে? আমার কথা শুনে খোঁকা হাসলে, আবছা আঁদারে তার হাসিটি আমি দেখতে প্যালম না। ঐরকম করে হাসতে হাসতেই সে বললে, না না, গায়ে হাত দেবে কেন? গায়ে। হাত দেয় নাই। এক পুলিশের অফিসার আমাকে বললে, তাড়াতাড়ি ছাড়া যদি পাও, ঘরের ছেলে ঘরে যাও–এ পথে থাকলে মরবে–যারা তোমাদের এসব কাজে লাগাচ্ছে তাদের কিছুই হবে না। মাঝখান থেকে তোমরাই মারা যাবে।
খোঁকাকে বিছেনায় শুইয়ে পিদিমটো এনে তার মাথার কাছে রাখতে যেয়ে দেখলম, চোখদুটি তার লাল টকটকে। কপালে হাত দিয়ে দেখলম, জ্বর হু হু করে বাড়ছে। গিন্নি এসে সব দেখেশুনে বললে, খোঁকার মাথাটো একবার ঠান্ডা পানিতে ধুইয়ে দাও মেজ বউ, দিয়ে খানিকক্ষণ কপালে জলপটি দাও। তাইলে জ্বর কমে যাবে।
তা-ই করলম। চাচারা সব এল-গেল, কতো কথা বললে খোঁকাকে, কতো আদর করে কতো কথা বললে, বারে বারে গিন্নি আর বুবু এসে খোঁকার কাছে বসলে। তা-বাদে বাড়ির সব লোকদের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে আমাকে গিন্নি কতোবার বললে রেতের ভাত খেতে! আমি খোঁকার শিয়র থেকে নড়লম না, জলপটি দিতে দিতে আমার কতোবার ঝিমুনি এল, ঝুঁকে ঝুঁকে পড়তে লাগলম, তবু খোঁকার কাছ থেকে যেতে পারলম না। অ্যানেক রেতে মনে হলো, জ্বরটো যেন এট্টু কম হয়ে এয়েছে। খোঁকা আর ত্যাতটো অস্থিরও করছে না। একটু বাদে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
সকালবেলায় মনে হলো জ্বরটো আর নাই, ছেলেকেও অ্যানেকটো চনমনে লাগছে! কাল রেতে কিছুই খায় নাই। তাকে ধরে আস্তে আস্তে পিঁড়েয় নিয়ে বসিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে দেলম। কাল রেতে ছেলের লাল টকটকে চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেয়েছেলম। অ্যাকন দেখলম, মুখচোখ শুকিয়ে গেয়েছে বটে, তবে চোখের সেই লাল টকটকে ভাবটো আর নাই।
লিশ্চিন্ত হয়ে আছি–যাকগো, জ্বরটো খারাপ জ্বর লয়। ত্যাকনকার ডাক্তার-বদ্যি খুব কম, লোকে সহজে তাদের ডাকতে যেত না। আর ডাকতে চাইলেই বা পাবে কোথা। পাশ করা কুনো ডাক্তার দশ গাঁয়ে খুঁজলেও পাওয়া যেত না, দু-একজনা যা থাকত সি শহরে। গাঁয়ের মানুষ কি তাদের কাছে যেতে পারে? ই গাঁয়ে উ গাঁয়ে হয়তো বদ্যি দু-একজনা ছিল, ডাক্তার বোধায় একটোও লয়। কেউ হয়তো কুনোদিন কুনো ডাক্তারের কাছে দিনকতক ছিল, এটো-ওটো নাড়াচাড়া করেছে, কষ্টমষ্ট করে ইঞ্জিশন খুঁড়তে পারে, নাইলে দু-দাগ মিকচার বানিয়ে দিতে পারে–সে-ই হলো ডাক্তার। তা ইসব ডাক্তারও কি সব গাঁয়ে আছে? তা নাই। আমার বাপের গাঁয়ে কুনো ডাক্তার-কবরেজ ছিল না। তিন কোশ দূরের গাঁয়ে একজনা ছিল, সকালে তাকে ডাকতে গেলে বৈকালি বা সাঁঝবেলায় একটো বুড়ো ঘোড়ায় চেপে হটর হটর করে সে আসত। তা সে-ই হলো যেয়ে বড় ডাক্তার। আমার শ্বশুরবাড়ির গাঁ ইদিক থেকে খুব ভালো। আছে একজন অ্যালাপ্যাথি, পাশ-টাশ দেয় নাই, তবে খুঁড়তে পারে, বড়ি-মিকচার দিতে পারে। আর একজন হলো হেমাপ্যাথি, শিশিতে পানি ভরে দু-ফোটা করে ওষুধ দিত। এক-আধ আনা পয়সা কেউ তাকে দিত, কেউ দিত না। ইদিকে অসুখ-বিসুখ রাতদিন লেগে আছে, কে আর অত ডাক্তারের কাছে যায় জ্বরজ্বারি নিয়ে? দু-চার দিন বাদে আপনিই চলে যাবে। সর্দি-কাশিতে জ্বর, ফেঁড়ার তাড়সে জ্বর, বদহজমে প্যাটে যন্তন্না, উসব কিছু ধত্যবের লয়, গা-গরম। তবে কঠিন কিছু হলে কি আর করবে মানুষ, রুগির ঘরে যেয়ে চেয়ে চেয়ে দেখত। অসুখ-বিসুখ হামেশা হচে, আপনা-আপনি সেরেও যেচে, আবার মরেও যেচে অ্যানেক মানুষ।
অসুখ কঠিন না সহজ, বোঝবার বাগ ছিল না সি-সময়ে। বড় খোঁকা সকালে কিছু খেলে না। বললে মুখে মজা নাই। অত জ্বর ছিল রেতে, মুখে কি মজা থাকে? তবু সকালে খই-মুড়কি খেলে, দোপরবেলায় ভাতও দুটি খেলে। আমি লিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজকৰ্ম্ম করছি, বাড়ির আর সবাইও লিশ্চিন্ত— সাঁঝবেলার খানিক এণ্ড ঘরে যেয়ে দেখি, খোঁকা বিছেনায় শুয়ে আছে। বললম, এই অবেলায় শুয়ে ক্যানে খোঁকা, একটু উঠে হেঁটে বেড়াও–বলতে বলতে দেখি, বলব কি, তার মুখের দিকে চাওয়া যেচে না, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে–ছেলে খুব হাঁসফাস করছে। ঠিক, অ্যানেক জ্বর গায়ে। আবার ক্যানে জ্বর এল–মনে একটু ভাবনা হলো, বাড়ির সবাইকে জানালম। খবর পেয়ে কত্তা জ্বরকাঠি নিয়ে ঘরে এল। বগলের তলায় জ্বরকাঠি দিয়ে দেখলে, হ্যাঁ অ্যানেক জ্বর।