যিদিন কত্তা আমাদের সবারই লেগে খুব মোটা কাপড় এনে দিলে পরার জন্যে, সিদিন ভারি অবাক হয়েছেলম। খুব দামি কাপড় বাড়িতে আনা হত তা লয়, তবে ওরই মদ্যে এট্টু হালকা-মিহি সুতোর শাড়ি আমরা পরতম। কিন্তুক ই যি ভারী চব্বর, ভিজলে যি গায়ে নিয়ে টানতেই পারব না। কেউ লিকিন আর বিদ্যাশের কুনো জিনিশ ব্যাভার করবে না। কতো জায়গায় বিটিশদের জিনিশ ভঁই করে পুড়িয়ে ফেলছে। এরা বেনে বেসাতির জাত, শ্যাষ পয্যন্ত সব কিছুই উদের ব্যাবসা। সেই ব্যাবসা জব্দ করতে হবে বলে উদের জিনিশ আর কেউ কিনছে না। দিশি জিনিশ খাব, দিশি জিনিশ পরব। মোটা ভাত, মোটা কাপড়। সেই লেগেই এই কাপড়। এই আমাদের পরতে হবে। তা পরছি সেই কাপড়, কত্তারাও পরছে মোটা খদ্দর। তাই বলে বাড়িতে আর চরকায় সুতো কাটতে পারি নাই। যাকগো, কতো হুজুগ দেখলম এই বয়সে।
মাঝে মাঝে মনে করতম, সবকিছু তো আমার লয়, কুনো কুনোটি আমার। সব্বার ছেলে তো আমার লয়, আমারটোই শুদু আমার। আজকাল পেরায়ই মনে হচে কুনো কিছুই শুধু আমার লয়। আমার ছেলেটিও আমার শুদু লয়। ঐ যি মেয়েটি ধরা পড়ার পর মানের ভয়ে কঠিন বিষ খেয়ে মরল, ঐ মেয়েটি কার? উ কি শুদু ওর বাপ-মায়ের? উ কি আমারও মেয়ে লয়? উ আমার হলে দোষ কি। উকেই যেদি জিঙ্গাসা করা হতো, তুমি মেয়েটি কার গো, তাইলে সি মেয়ে কি জবাব দিত? মরবার আগে সি কি বলত, কারু মেয়ে সি লয়, সি ই দ্যাশের সব মানুষের মেয়ে–সি সারা পিথিমির মেয়ে!
ভাবতে ভাবতে কোথা থেকে কোথা চলে অ্যালম, আমার গা শিউরে উঠল। অ্যাতো অস্থির লাগছে ক্যানে? সবকিছু অস্থির। আমাদের গাঁয়ের স্কুলের ছেলেরাও লিকিনি দুদিন পড়া ছেড়ে বেরিয়ে গেয়েছে। দ্যাশে অ্যাকন রাজার আইন না মানা চলছে। স্কুলের কতোটুকুন কতোটুকুন ছেলে–তারাও আইন মানছে না। তাইলে তো শহরেও ইসব হচে। কই কত্তা তো কিছু বললে না। খোঁকা কি তাইলে আবার কত কি ভাবলম। একবার ভাবলাম, খোঁকা এইটুকুন ছেলে, শান্ত–ঠান্ডা। উ আবার কি করতে যাবে? আবার ভাবলম, করলে করুকগো, উ নিয়ে ভাবতে যাই ক্যানে?
তা বললেই কি ভাবনা যায়? দ্যাওর আর ভাইটি অ্যাকন আর শহরে থাকে না। আর ল্যাখাপড়া হলো না তাদের। দ্যাওর বললে, তার আর পড়ায় মন যেচে না, একটো চাকরি-বাকরি পেলে বরং কত্তার পাশে দাঁড়াতে পারবে। সারা জেবন ভাই কি সংসারের বোঝাই শুদু বইবে! সে আর তা হতে দেবে না। এইসব বলে সে। বাড়িতে অ্যাকন বসে আছে। দ্যাওরের এই কথা, কিন্তুক ছোট ভাইটির খুব ইচ্ছা আরও পড়া। তার মাথা ভালো, পড়লে অনেক ওপরে উঠতে পারত। তা হলে হবে কি–খরচ জোগাবে কে? একবার তো এই নিয়ে বাপের সাথে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়েছিল। আর দরকার নাই। তাই সে কত্তার কাছে এসে বললে, কলেজে আর সি ভত্তি হবে না–একটো কুনো চাকরি-বাকরি হয় কিনা চেষ্টা করবে। সি-ও অ্যাকন মামার বাড়িতে ফিরে গেয়েছে।
ঠিক এই সোমায়েই একদিন খবর এল–যা ভয় করেছেলম, তাইখোঁকা স্কুলের আর সব ছেলেদের সাথে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। আইন মানবে না বলে কিসব করতে গিয়েছিল রাস্তায়, সিখান থেকে তাদের দলসুদু ধরে জেলে নিয়ে গেয়েছে!
১৩. ছেলে আনো বাড়িতে, আর পড়তে হবে না
এত কথা ভাবলম কিন্তুক যে-ই শোনলম বড় খোঁকাকে ধরে জেলে নিয়ে গেয়েছে, অমনি সব ওলোট-পালোট হয়ে গেল। ছেলেকে জেলে নিয়ে গেয়েছে, দড়ি দিয়ে বেঁধেছে, না শেকল দিয়ে বেঁধেছেলাঠির বাড়ি মেরে টানতে টানতে নিয়ে গেয়েছে–উ ছেলে কুনোদিন কারু হাতে মার খায় নাই, কেউ ওর গায়ে হাত দেয় নাই কুনোদিন, সেই ছেলে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেচে কি জানি, সারাদিন উপোস করে আছে না কি, ভোক্ সহ্য করতে পারে না সি তো আমি জানি, কেউ হয়তো এট্টু খাবার দেয় নাই তাকে–তবু মুখ ফুটে তো একটি কথা সি বলবে না কখনো এইসব হক না-হক কথা খালি বুকের মদ্যে উথথাল-পাতাল করতে লাগল আর খানিক বাদে বাদে দোম যেন আটকে যেতে লাগল। আমি কেবলই বলতে লাগলম, আমার ছেলে এনে দাও, যেমন করে পারো আমার ছেলে এনে দাও। যেন ছেলে বলতে আমার একটিই। ইদিকে পরের খোঁকাটি আট বছরের হয়েছে, চাঁদের মতুন একটি মেয়েও হয়েছে–অ্যাকন ছ-মাসের সিসব কথা মনে হলো না। উরা যি ছামনেই রয়েছে, তাই খেয়াল হচে না। খালি মনে হচে, আমার নাড়িছেড়া ধনটিই আমার কাছে। নাই–আমার কেউ নাই, আমার বিশ্ব-ভোবন আঁদার।
তবে কত্তা গেয়েছে, আমি একটু নিশ্চিন্তি। উ লোক সামান্য লয়, উ মানুষ বটবিরিক্ষি, তামাম মানুষকে হেঁয়া দিতে পারে। ঠিক তা-ই হলো। তিমি-সাঁঝের বেলা খোঁকাকে নিয়ে ফিরলে কত্তা। অন্য অন্য দিন সে ফিরে নিজের বাইরের ঘরেই থাকে, আমরাই পা-ধোয়ার পানি, শরবত নিয়ে যাই। আর খুব কিছু বেপার হলে সে বাড়ির ভেতর মা-বুনের কাছে আসে। আজ সে তা-ই করলে, ছেলেকে নিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে এসে মায়ের কাছে বড় খোঁকাকে ঠেলে দিয়ে বললে, ছেলে যে পথে যাচ্ছে এই বয়েস থেকে, কেন যাচ্ছে, কি করতে যাচ্ছে–এইসব কথা ওর কাছ থেকেই শোনো। তারপর তুমিই ঠিক করো, ওকে বারণ করবে কি করবে না। নেহাত কম বয়েস, তাই দয়া করে এবার ছেড়ে দিলে–দু-বছর জেলও দিতে পারত। ব্রিটিশদের রাজত্ব, বড় কঠিন শাসন মা। এই শাসন এখন দেশের লোকও আর মানতে চাইছে–ঘর-সংসার বাপ-মা ভাই-বোন লেখাপড়া ছেড়ে দলে দলে সব বেরিয়ে আসছে–এরই মতন খোঁকা সব, কিছুই মানছে না,কারুর বারণ শুনছে না, ঝাঁকে ঝাঁকে মরতে যাচ্ছে। কি এখন বলবে বলো দিকিন। আইন তো ছাড় কথা এখানে বোমা ফাটাচ্ছে, ওখানে সায়েব মারছে আর যতো জেল হচ্ছে, ফাঁসি হচ্ছে, ততো তাদের রাগ বাড়ছে। আগুন জ্বলছে দেশে, কি করা যাবে বলো তো? গিন্নি দেখি চুপ করে আছে, তার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে বেধবা ননদটি। কেউ কুনো কথা বলছে না। বড় খোঁকা কত্তার পাশে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে, তার একটো হাত কত্তার হাতে ধরা। আমি আর থাকতে পারলম না, ছুটে যেয়ে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখি, গা-গরম, জ্বর এয়েছে। আমি চেঁচিয়ে ওঠলম, ই কি, ই-যি অ্যানেক জ্বর! বাপ না ছাই, কত্তা এই ছেলেকে শহর থেকে নিয়ে এয়েছে, কতোবার গায়ে-পিঠে হাত পড়েছে, ছেলের জ্বর সি কিছুই ট্যার পায় নাই।