এমন ঘটনা ঘটে গেল সোংসারে, তবু একটো দিন কি থেমে থাকলে? দিন ঠিকই চলে গেল। মানুষের সয় না কি? সোমায়ে সবই সয়। দুনিয়াদারির দায় কি ঠেকানো যেচে? সেই কাজ করতে হবে, খেতে হবে, শুতে হবে, ঘুমুতে হবে। কোটো বাদ যেচে? শোক একটু সয়ে এলে মাস তিনেক বাদে কত্তা দুই ভাগ্নেকে ই সোংসারে চেয়ে নিয়ে এল। বুন গেয়েছে, গেয়েছে, তার তো আর কুনো চারা নাই। ভাগ্নেদুটির একটি পাঁচ বছরের আর একটি দ্যাড় বছরের। দুটিই খোঁকা। ফুটফুটে রাজপুত্তুরের মতোন এই দুই খোঁকাই হলো বুনের চেহ্ন এই দুনিয়ায়। চোখ-মুখ চেহারায় বুনের কথাটি মনে পড়ে। অ্যাকন থেকে ওরা ই বাড়িতেই মানুষ হবে। বড় হলে যা তাদের মন চায়, তারা তাই করবে। যেতে চাইলে নিজেদের সোংসারে ফিরে যাবে।
ছেলেদুটিকে আনতে তেমন কুনো বাধা হয় নাই। বিরাট আবস্তা হলেও বুনটির শ্বশুরবাড়িতে লোকজন তেমন নাই। ছোট ভাই নিঃসন্তান। জানাই গেয়েছে আর ছেলেপুলে হবে না। ইদিকে দুই সন্তান রেখে বড় বউ চলে গেয়েছে দুনিয়া ছেড়ে। লতুন করে আবার বিয়ে-থা সোংসার করার কুনো ইচ্ছা নাই বড় ভাইয়ের। তাইলে নাবালক ছেলেদুটিকে দেখে কে? কত্তা বাপ-চাচাকে এইসব বুঝিয়ে ভাগ্নে-দুটিকে এনে নিজের সোংসারের বিধবা-বুন, আমার মেজ ননদের কাছে ফেলে দিলে। বললে, এরাই এখন তোর দুই ছেলে। এদের তুই মানুষ কর। কথা শুনে বিধবা-বুন–কতো ভুক-পিয়াসি ছিল–ছেলেদুটিকে বুকে টেনে নিলে। ই বাড়ির আর সব ছেলেপুলের মতো তারাও বড় হতে লাগল।
১১. সব গোলমাল লেগে যেচে
সোয়ামি পুত্তুর ননদ শাশুড়ি দ্যাওর ভাশুর ইদের নিয়ে সোংসার করি। সেই ভোর ভোর ঝুঝকিবেলায় উঠি, সুয্যি ত্যাকনো দেখা দেয় নাই। সেই শুরু, সারা দিনে একবার কামাই নাই। কাজ কাজ। রেগেমেগে বলি রাবণের গুষ্টি। ঘর-দুয়োর পোষ্কার রাখো, কুটনো কোটো, বাটনা বাটো, রাজ্যের রাঁধন রাঁধো, চাকর মুনিষ মাহিন্দার সবাইকে খাওয়াও। ই আবার এক সুখও বটে! আমরা বউ-ঝিরা য্যাকন খেতে বসছি, সুয্যি ত্যাকন পাটে বসতে যেচে, রোদ লি লি করচে। এমনি করে দিন কাটে, দ্যাশ-দুনিয়ার আর কি খবর রাখব? নিজের দুটো ছেলের একটো শহরে বোডিংয়ে থাকে, তাকে ন-মাস ছ-মাসেও একবার দেখতে পাই না, আর একটো যে কখন খেচে, কখন ঘুমুইচে তার কিছুই জানি না, সি জানে তার ফুপু। বাড়িতে অ্যাকন ছেলেপুলে বেড়েছে। মনে হচে সেজ বউয়ের আবার ছেলেপুলে হবে। আমার ননদটির হাত এতদিন ফাঁকাই ছিল, তার কাজ ছিল হালকা। অ্যাকন আর তা লয়, তার বুনপেপাদুটো সোংসারে এয়েছে, আমার খোঁকা রয়েছে, সেজর খোঁকা রয়েছে–সব অ্যাকন ঐ ননদকেই দেখতে হবে। কেউ বসে নাই, সবারই কাজ।
সব কাজ সেরে য্যাকন শুতে যাই, কত্তা দ্যাশ-ঘরের কথা দু-চারটে বলে বটে, তার কিছুই বুঝতে পারি না। অক্ষর শিখেছেলম, বই পড়তে শিখেছেলম, বানান করে খবরের কাগজ পড়তে পারতম, বুঝতেও পারতম, অ্যাকন মনে হচে সব ভুলে গেয়েছি। মনে করেছেলম কত্তাকে একদিন শুদোব সেই কুন দ্যাশের খলিফার চাকরি অ্যাকনো আছে না গেয়েছে, সি আর শুদননা হয় নাই। বিছেনায় শুই আর মরার মতুন ঘুমিয়ে পড়ি। কখন শুদোব!
ইদিকে কত্তার গতিক সুবিধে মনে হচে না। পেরায় দিন শহরে যায়। ভোরবেলায় যায় আর এক দণ্ড রেতে ফেরে। গাঁয়ে খুব কমই থাকে। ইশকুলে যাওয়া কি ছাড়লে? আর কত্তামার বাড়ি যি কমই যাওয়া হচে সি তো দেখাই যেচে। বাড়িতে আকা লোকজন আসা অ্যাকন অনেক বেড়েছে। কত্তা আগে কথাবার্তা ত্যাতো বলত না, বরং কিছু শুদুলেই কেমন খেকিয়ে উঠত। অ্যাকন দেখছি নিজে থেকেই এটো-ওটো কথা বলে। যিদিন যিদিন লোক আসে বাড়িতে সিদিন শহরে যায় না। তাইলে লোকজন নিশ্চয় বলে-কয়েই আসে আর যারা আসে তারা যে-সে লোক লয়, তা তাদের চেহেরা, জামা কাপড়, পোশাকআশাক দেখেই বোঝা যায়। আড়াল থেকে অনেকদিন দেখেচি, খাবার বানিয়ে কাউরির হাতে পাঠিয়ে দিতে যেয়ে চোখে পড়েছে উসব মানুষদের। হিঁদু ভদ্দরলোক তো আসেই, আজকাল দেখি যেন মোসলমান মিয়ে-মোকাদিম এট্টু বেশি বেশি আসছে। বড় বড় পাগড়ি দেখতে পাই, হেঁটো পয্যন্ত আলখেল্লা গায়ে দিয়ে আসে কেউ, কারু কারু নোম্বা দাড়ি, বাবরি চুল। কারা ইয়ারা? কি করছে, কাদের নিয়ে আছে কত্তা–এইসব কথা ভেবে ভেবে মরি।
একদিন হঠাৎ কত্তা আমাকে শুদুইলে, আচ্ছা, হিঁদু-মুসলমানে তফাত কি বলো তো শুনি। ই আবার কি কথা? ইসব তো কুনোদিন ভাবি নাই, ভাবতে হবে বলে কুনোদিন মনেও করি নাই। কত্তার কথা শুনে আমি ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলম। দেখি সে মিটি মিটি হাসছে। কত্তার ই রূপ তো কুনোদিন দেখি নাই। একটু পরে সে বললে, এত কষ্ট করে যে পড়তে লিখতে শিখলে তা দিয়ে কি তোমার কোনো কাজই হবে না?
কথা শুনে আমার রাগ-ও হলো দুঃখ-ও হলো। কি কথা বলছে এই মানুষ? সকাল থেকে রেতে বিছানায় শোয়া পয্যন্ত তার সোংসারের ঘানি টানছি, চোখে বেঁধেচি ঠুলি, কানে দিয়েচি তুলো, পিঠে বেঁধেচি কুলো, দোপরের খাওয়া খেতে বসি সাঁঝবেলায় আর সে কিনা বলে লেখাপড়া শিখে আমি কি করলম! রাগে আমি গুম মেরে থাকলম, অ্যাকটো কথা বললম না। একটু সোমায় যেতে কত্তা বললে, হিঁদু-মুসলমান সব এক হয়ে এই একবারই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেমেছিল। মোসলেম জাহানের খলিফাঁকে তাড়ানো যাবে না বলে কত কি করেছিল! শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে জানো? ব্রিটিশদের কিছুই করতে হয় নাই। সে দেশের মুসলমানদের এক নেতাই খলিফাগিরি খতম করে দিয়েছে। এখন এ দেশের হিঁদু-মুসলমান এক হয়ে যাই করুক সব বেকার। দাবিই তো আর কিছু নাই। সব ছত্রখান হয়ে গেল। আবার সেই হিঁদু-মুসলমানের নিজের নিজের দাবি নিয়ে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়েছে। তাতে তো বিদেশীদেরই পোয়াবারো। সেইজন্যে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, হিঁদু-মুসলমানে তফাত কি? এইবার বুঝতে পেরেছ?