কত্তা ফিরে এল সেইদিনই অ্যানেক রেতে। এমন আঁদার রেতে ইস্টিশন থেকে এক কোশ পথ হেঁটে কেমন করে যি বাড়ি এল, সি সেই-ই জানে। রাস্তা নাই, মাঠঘাট ভেঙে আসতে হয়। সাপ-খোপে ভরা ই জায়গা। কিন্তু কুনো ভয়-ভিত ছিল না উ মানুষের। হেরিকেন নিয়ে কেউ এগিয়ে আনতেও তো যেতে পারত ইস্টিশনে! তা-ও কাউকে করতে দেবে না।
বড় খোঁকা সিদিনই স্কুলে ভত্তি হয়ে গেয়েছে। বোডিংয়ে থাকার বেবস্থা-ও হয়েছে। বড় খোঁকার চাচা, আমার ছোট দ্যাওর, অ্যাকন-ও তো রয়েছে, তার পরীক্ষা শ্যাষ হয় নাই, শ্যাষ হলে তার জায়গাতেই থাকবে ছেলে–এইসব ঠিক করে এয়েছে কক্স। দেখলম, তার মনে খুব আনন্দ। ছেলের ল্যাখাপড়ার ভালো বেবস্থা হয়েছে। সে একদিন নিশ্চয় জজ-ম্যাজিস্টেট হবে! ইদিকে আমি কি করি, কি করে থাকি, কি করে বাঁচি! সারা দিনে যেদি একবারও তার মুখটো দেখতে না পাই, তাইলে কি বাঁচতে পারি, হায়!
কেমন কপাল, ঠিক পরের দিনই দোপরের আগে লোক এসে খবর দিলে আমার ছোট ননদের সংকট-ব্যায়রাম। আবস্তা খুব খারাপ হয়েছে। এই খবর নিয়ে রাত থাকতে থাকতে গাঁ থেকে রওনা হয়েছিল লোক। পড়ি-মরি পাঁচ কোশ রাস্তা এসে খবরটো কুনো পেরকারে দিতে পারলে। আমার এই ছোট ননদটি যেমন সোন্দরী, তেমনি ভালোমানুষ। ভারি মিষ্টি স্বভাব আর কি সেবা যি করতে পারত মানুষের! সি আবস্তাপন্ন বড় ঘরেই পড়েছিল। আমার পরের খোঁকার জন্মের দু-এক বছর আগেই তার একটি খোঁকা হয়েছে, আর এই বছরটাক আগে আরও একটি খোঁকা এয়েছে তার কোল জুড়ে। ভরা সুখের সংসার–ইয়ার মদ্যে এই মরণ-অসুখের খবর!
খবর শুনে কত্তা কি যি অস্থির হয়ে পড়ল সি আর কি বলব। বড় বড় আপদ-বেপদেও যি লোক স্থির থাকে, মাহা ভয় পেলেও যি লোককে দেখে সবাই সাওস পায় সেই লোক কি যি খ্যাপাখেপি করতে লাগল।
আমি এখুনি যাব, আমার ঘোড়া ঠিক করতে বলো, এক কাপড়ে যাব।
কথা বলতে বলতে কত্তা ছুটে বাড়ির মদ্যে ঢুকে মা-বুনকে শুদু যেচে এই কথাটি জানালে। শাশুড়ি ননদ পাথরের মতুন দাঁড়িয়ে থাকলে, ভাইরা যারা বাড়িতে ছিল, একটি কথাও কেউ বলতে পারলে না–কত্তা শুদু ধুতি-জামাটো বদলে আর মনে হলো বাসো খুলে য্যাতো জমা টাকা ছিল সব বার করে নিয়ে খামারে যেয়ে দাঁড়াইলে। ত্যাতোক্ষণে ঘোড়ায় জিন পরানো হয়ে গেয়েছে, মাহিন্দারটি লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর কুনো কথা না বলে কত্তা যেয়ে ঘোড়ায় উঠল। ঘরের ভেতর থেকে শুদু ঘোড়া ছোটার আওয়াজ প্যালম।
ওমা, ই কি কাণ্ড, সিদিনই রাত দোপরে দেখি কত্তাকে নিয়ে ঘোড়া ফিরে এয়েছে। খামারের দিকে পরচালির ছামনে ঘোড়াটো কখন দাঁড়ালে তা কিছুই বুঝতে পারি নাই। একবার যেন অ্যাকটো হি হি আওয়াজ প্যালম। দরজা খুলে বেরিয়ে আঁদারের মদ্যে দেখি, ঘোড়া কেমন ছটফট করছে আর তার পিঠে বসে মাতালের মতুন দুলছে অ্যাকটো মানুষ। সাথে সাথে আমি বুঝতে পেরেছি আমার সব্বোনাশ হয়েছে। ত্যাকন একবার এমন চেঁচিয়েছেলম যি বাড়ির সবাই হাউমাউ শোর করে জেগে উঠল। ঘরের হেরিকেন হাতে নিয়ে বাইরে এসে দেখি সবাই খামারে এসে গেয়েছে। ঘোড়া আর ঘোড়ার পিঠে সওয়ারি ত্যাকননা টলমল করে দুলছে। দ্যাওর-রা সব ছিল, ভাশুরও রয়েছেসবাই ছুটে যেয়ে কত্তাকে ধরলে। ঘোড়া ত্যাকন হাঁটু দুমড়ে বসে। পড়েছে। কত্তার জামা-কাপড় ছেড়া, সারা গায়ে ধুলো-কাদা, শরীরের নানা জায়গা ছিড়ে ফেটে গেয়েছে, সেইসব জায়গা থেকে রক্ত ঝুঁঝিয়ে পড়ছে। ঘোড়ার আবস্তা আরও কাহিল। তারও সারা গায়ে কাদা মাখা, ইখানে-ওখানে রোঁয়া উঠে গেয়েছে, রক্ত ঝরছে তারও দ্যাহ থেকে। তা-পরে যা ঘটল সি কথা মনে হলো আকননা আমার সারা গায়ে কাঁটা দেয়, দমটো আটকে আসে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলম, বেশি সোমায় গেল না ছটফট করতে করতে মুখ দিয়ে গাজলা তুলে ঘোড়াটা যেন কলজে ফেটে মরে গেল। কিন্তুক ত্যাকন তাকে নিয়ে কে ভাবে। কত্তাকে নিয়েই তো কান্নাকাটা পড়ে গেল।
কত্তা শ্যাষ পয্যন্ত সুস্থির হলো বটে কিন্তুক আজও জানি না কেমন করে এই মাহাবেপদ পার হয়েছেলম। যাবার পথে ঘোড়াকে একবার থামতে দেয় নাই কত্ত। সপাৎ সপাৎ করে খালি চাবুক মেরেছে, আর গাঁয়ের ভেতর দিয়ে, মাঠের ভেতর দিয়ে, আমবাগান কলাবাগানের মদ্যে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়েছে। থামতেও দেয় নাই, মাঠের পুকুরে পানি খেতেও দেয় নাই, একবার কুনো বটপাকুড়ের হেঁয়ায় দাঁড়ায়ও নাই। এই করে ঠিক বৈকালবেলায় বুনের শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ে বড় দিঘির উঁচু পাড়ে যেয়ে সে দাঁড়ালেবাড়িটোকে ওখান থেকে দেখা যায়। দোতলা মাঠকোটাটো-ও দেখা যেছিল। গাঁয়ের একমাত্র টিনের চালের বাড়ি। ঘোড়া থামিয়ে একদিষ্টে কত্তা চেয়েছিল জানের জান ছোট বুনের বাড়ির দিকে। ত্যাকন বহু লোক যেছিল সিদিকে। শুদু একজন এয়েছিল কত্তার কাছে। কত্তা তাকে কিছুই শুদোয় নাই, তবু সে বলেছিল, উদিকে তাকিয়ে কি দেখছেন–উ বাড়ির বড় বউটি এই খানিক এগু মারা গেয়েছে।
কত্তা আমাকে পরে বলেছিল, লোকটোর একটা কথাও ত্যাকন সি বুঝতে পারে নাই। চুপ করে তার দিকে এমন করে চেয়েছিল যি, সে ভয় খেয়ে গেল আর যি কথা বলেছিল, সি কথাটো আরও একবার বলেছিল। কত্তা তেমনি করেই দাঁড়িয়ে। তা-বাদে কেমন করে কি কথা মাথায় ঢুকল সে বলতে পারবে না, শুদু একটো কথা মাথায় যেন চিরিক করে উঠল, ইখানে আর লয়, উ বাড়িতে যাব না, যাব না, হরগিজ যাব না, বুনের মরামুখ আমি দেখতে পারব না। ঘোড়ার মুখটি ফিরিয়ে চাবুক কষে তাকে ছুটিয়ে দিয়েছিল কত্তা।