শেষতক বাপজিকে আবার বিয়ে করতে হলো। লতুন মা এল ঘরে। পাতলা কালো মেয়ে, আমার চেয়ে সাত বছর বড় হবে। মাথায় লম্বা কালো চুল, হেঁটোর নীচে পড়ছে। বড় বড় চোখদুটিতে ভারি মায়া। নিজের মা গেলে কি আর মা পাওয়া যায়! সি কথা সত্যি বটে। মা ফিরে প্যালম না ঠিকই, তবে মায়েরই মতুন আর সেই সাথে সখির মতুন একজনকে প্যালম। সংসারে আবার ছিরি ফিরল।
কিন্তুক ভাইটি আমাকে ছাড়লে, আঁকড়ে ধরে থাকলে। কোল থেকে তাকে আর নামাইতে পারি না। নতুন মা অ্যানেক চেষ্টা করলে ওকে কাছে টানতে। সে কিন্তুক হরগেজ আমাকে ছাড়বে না। খাবে আমার কাছে, শোবে আমার কাছে। আমার কাকালে সে যেন সব সোমায়ে একটো পুঁটুলি!
০২. বিছেনা ছেড়ে একদিন আর উঠলে না
দাদি আমার বাপজিকে একটুকুনি ভয়ই করত। যেদি কিছু খেতে দেবে, একটো লাড়ু, বাতাসা কি পাটালি কিংবা চিনির কদমা, আড়ালে ডেকে নিয়ে যেয়ে লুকিয়ে দিত। লতুন মা য্যাতোদিন ছিল না, বাপজি ত্যাতোটো খেয়াল করত না। সারাদিন বাড়িতেই থাকত না, তা খেয়াল করবে কি? লতুন মা এলে বাড়ি আবার ঠিকঠাক হলো, ঘর-দুয়ারে ঝট পড়তে লাগল, ঘরের মেজে-দেয়ালে আবার লাতা দেয়া হতে লাগল। লিয়ম ধরে রাঁধা-বাড়া চলল। সসাংসার আবার ঠিক হলে আমাদের হাতে দাদির দেওয়া খাবার-দাবার দেখলে বাপজি যেন অখুশি হতো। তবে ঠান্ডা মানুষ তো! য্যাতেই রাশভারি হোক, চ্যাঁচামেচি কুনোদিন করত না। কিন্তু তার অখুশির কথা বুক যেন ছাদা করে দিত। তা সহ্যি করা খুব কঠিন। আমি জানতম বলেই দাদিকে বলতম, সবকিছু আমাদের দিতে যাস ক্যানে দাদি?
তু যি আমার জান বুন। ই দুনিয়ায় আর থাকা কিসের লেগে? তিন কুলে আমার কেউ নাই। সোয়ামি নাই, পুত নাই, মেয়ে নাই, ভাই নাই। খালি তুই আছিস। আল্লা জানে, তুই আছিস তাই আমার দুনিয়ায় থাকা।
ই কথার কি কুনো জবাব আছে? দাদি যি বলত আমার যা আছে সব তোর–তা আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখতম দাদির কি আছে। ঐ কেঁদাকাটা আঁদার ঘর আর কালো কালো মাটির হাঁড়ির সার আর তো কিছু দেখি নাই দাদির। তবে দাদি য্যাকন আমাকে বলত, আমার জানের জান, ত্যাকন বোঝতম দাদির জান আছে। ঐ একটো জিনিসই আছে, আর সেটা আমার। আঃ, হায়রে–সেই জানটো কি আমার।
একদিন ঠিক সকালবেলায়, কাক ত্যাকন ডেকেছে কি ডাকে নাই, আমি যেয়ে দেখি দাদি ত্যাকননা ওঠে নাই। আমকাঠের ভাঙা দুয়োরটো ঠেসানো। ভাবলম এমন তো কুনোদিন হয় না! দাদি ওঠে সুয্যি ওঠার আগে আঁদার থাকতে। ই কেমন কথা হলো? আমি যেয়ে দরজাটো ঠেলা দিয়ে খোললম। ঘর আঁদার। ঘরের ভেতরে কিছুই দেখা যেছে না। তাপর একটু একটু আবছা দেখলম খেজুরপাটির ওপর কাঁথার বিছেনায় দাদি শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে ডাকলম, ঠ্যাললম, সাড়া দিলে না। ত্যাকন আমি চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠলম। দাদি আর বিছেনা ছেড়ে উঠলে না। মরে কাঠ হয়ে আছে!
বাপজির খালা য্যাকন, ত্যাকন দাদির লিশ্চয় অ্যানেক বয়েস। তা কতে হবে? কে বলবে সি কথা? ত্যাকনকার দিনে লোকে নিজের বয়েস জানত না। মরা নিয়ে কারও কুনো ভাবনা ছিল না। মওত ত্যাকনকার জ্যান্ত মানুষের পেছু পেছু ঘুরে বেড়াত। বয়েসের কথা ভেবে আর কি হবে? তবে মনে হয়, অ্যানেক বয়েস হয়েছিল দাদির। চার-কুড়ি বছরেরও বেশি হবে।
দাদি চলে গেল যেন দুনিয়ার সব গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে গেল। আবার দাদি নিজেও কতোদিন বাদে শুকনো পাতার মতুনই কোথা হারিয়ে গেল! অ্যাকন আর কিছুই মনে পড়ে না। তবে বুকটোকে চিরলে সোনার পিতিমে আমার দাদিকে আজও দেখতে পাওয়া যাবে লিশ্চয়। কোথা দাদির কবর অ্যাকন আর কেউ জানে না। আমিও জানি না। অথচ আমি ঠিক জানতম কবরটো কোথা। কিন্তুক সি জায়গায় গেলেও অ্যাকন আর বলতে পারব না।
বাপজি ছেলেমেয়ে ঘর-সংসার কুনো কিছুকে যি ভালোবাসত তা চোখে দেখতে পাবার উপয় ছিল না। কুনোদিন বাপজির কোলে উঠেছি বলে মনে পড়ে না। গায়ে মাথায় হাত দিলে কি দুটো মিষ্টি কথা বললে, কখনো এমন দেখি নাই! কথাই তো বলত কম। মা য্যাকন গেল ত্যাকন তো আমি বেশ বড় হয়েছি–কই বাপজি তো একবারও কাঁদলে না, চোখ থেকে দু-ফোটা পানি ফেললে না? ত্যাকনকার ভাবই ছিল এইরকম। বউ মরলে কাদলে সেই পুরুষের খুব নিন্দে।
মনে পড়ে, ঘরের ভেতর ছেঁয়া-ছেঁয়া আঁদারে বাপজি খালি গায়ে খেতে বসেছে। পরনে শুদু একটো ধুতি পরা। বেরাট মানুষ, ফরশা ধপধপে গায়ের রঙ। বেরাট কাঁসার থালায় ঝিঙেশাল চালের ভাত, বড় বড় কঁসার বাটিতে নানারকম তরকারি। মাছ-গোশতো ত্যাতে লয় কিন্তুক। সব শ্যাষে জামবাটি ভরা ঘন দুধ, কলা আর আখের গুড়। বাপজির গায়ের বলও ছিল তেমনি। এই নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে কতো গপ্পো! অত বল, কিন্তুক কুনোদিন একটি লোকের গায়ে হাত তোলে নাই। জেনে-শুনে একটি পিপড়ের ক্ষেতিও করে নাই। কুনোদিন কুনো মানুষকে একটো অকথা-কুকথাও বলে নাই। তবু কত যি কথা ছিল তাকে নিয়ে। একবার একটো আখমাড়াইয়ের কল দশজনা মিলে সরাইতে পারছে না। যিখানে আখমাড়াই হবে, সাল হবে, গুড় উঠবেসি তত বছরের একটো উচ্ছবই বটে–কলটোকে গরুর গাড়িতে তুলে সিখানে নিয়ে যেতে হবে। ঐ কল পুরোটা লোহা দিয়ে তৈরি। চার ধারে শুদু চারটে শালকাঠের পায়া। দশজনায় সি কলটোকে কিছুতেই জুৎ করতে পারছে না। দেখতে দেখতে বাপজির কি যি হলো, আস্তে আস্তে বললে, সন্ দিকিনি তোরা। এই বলে একাই সেই লোহার কল সাপুটে ধরে মাটি থেকে চাগিয়ে তুলে ফেললে। এই আচ্চয্যির কথা এখনো সবাই বলে।