হায় কি বললে, হায় কি বললে, ওগো, হায় কি বললে–দড়াম করে আমি মাটিতে আছড়ে পড়লম, হায়, ই কি বললে? কই, আমার মানিকরা কই, আমার জাদুরা কই! ওমা, আমি এখুনি বাড়ি যাব, আমার বুকের ধন মানিকদের নিয়ে এখুনি বাড়ি যাব। ই বাড়িতে আর এক দণ্ড লয়। এই রেতেই যাব।
সেই রেতে কি আর আসা হয়? সারারাত কিছুই খ্যালম না, পানি পয্যন্ত লয়, কারও সঙ্গে একটি কথা বললম না, দু-চোখের পাতা একবার এক করলম না, দুই ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ধরে রাতটো কাটিয়ে সকালবেলাতেই শ্বশুরবাড়িতে ফিরে অ্যালম। মা ভাই বুন সব আসার সোমায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে কিন্তুক একটি কথা কেউ উশ্চারণ করতে পারলে না।
১০. ছেলে চলে গেল শহরে
ফিরে এসে শ্বশুরবাড়িতে কাউকে কিন্তুক সিসব কথা কিছুই বলি নাই। শুদু বললম, ছেলেদের আর মন টিকছিল না, স্কুলও খুলবে তাই চলে অ্যালম। কত্তা কিছু বুঝেছিল কিনা জানি না। কিছুই শুদোয় নাই আমাকে। উ তো কিছু শুদোবার মানুষ লয়! শাশুড়ি-ননদও কোনো কথা বললে না।
বাড়ি এসে শোনলম, বড় খোঁকার গাঁয়ের স্কুলে ল্যাখাপড়া ভালো হচে না। উকে শহরের বড় স্কুলে নিয়ে যেয়ে ভত্তি করা হবে। আমার ছোট দ্যাওরটো পড়েছিল শহরের যি স্কুলে সিখানেই পড়তে যাবে খোঁকা। দ্যাওরের ত্যাকন স্কুলের পড়া শ্যাষ হয়েছে। সে আর আমার ছোট ভাইটি তো একসাথেই শ্যাষ পরীক্ষা দেবে। মেট্রিক না এনট্যান্স কি পরীক্ষা যেন। আর এই পরীক্ষার লেগেই আমার বাপের বাড়িতে এত ধুন্দুমার কাণ্ড হয়েছিল। সেই পরীক্ষা হয়ে গেলেই দ্যাওর চলে আসবে বাড়িতে। তা বাদে পাশ যেদি দিতে পারে, তাইলে কলেজে পড়বে। স্কুলের কাছে যে বোডিংয়ে থাকত, সেই জায়গাটো খালি ইচে। বড় খোঁকা সেইখানে থাকবে আর সেই স্কুলে পড়বে।
খরবটো শোনা অবদি কি যি হতে লাগল বুকের মদ্যে! সি আর কাকে বলব? পাখি এইবার বাসা ছেড়ে উড়ে যেচে। আর কি বাসায় ফিরবে মায়ের বুকের তলায়, আর কি নিশ্চিন্তে ঘুমুবে? কিন্তু আমার বড় খোঁকা উড়বে কি, তার তো অ্যাকনো পাখাই হয় নাই। অত বড় ছেলে, অ্যাকনো খাইয়ে দিতে হয়। আমি না দিলেও দাদি, ফুফু, নাইলে কুনো চাচি খাইয়ে দেয়। আজকাল কারু কাচে খেতে চাইছে না কিন্তুক নিজে খেতে গেলে ফেলে ছড়িয়ে একাকার। উ ছেলে কি সত্যি বড় হয়েছে, কেউ কাছে ডাকলে একেবারে বুকের কাছে চলে যায়, কেউ অ্যাকটো ধমক দিলে মুখটো শুকিয়ে কেমন হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি কুনো কাজ করতে বললে এমন হাঁপুচাপু করে যি দেখলে মায়া হয়। ছেলে যেন দুনিয়ার সবার কাছে অপরাধী হয়ে আছে। মুখে কথা নাই, দু-একটো কথা যা বলে তা আবার শোনাই যায় না। ই ছেলে কি করে বিদ্যাশ-বিভুঁইয়ে থাকবে? মাথায় নোম্বা অ্যানেকটো হয়েছে বটে, দীঘল শরীল, কাচ-পরানি গায়ের রঙ, টানা দুটি চোখ যেন ঘুমিয়ে থাকার মতুন।
কেউ কি উকে বড় হতে দ্যাখে? একটু একটু করে কেমন বাড়ছে? পিতি রেতে চাদের বাড়ার মতুন। জামা-পেন্টুলুন ছোট হয়ে যেচে, খালি গায়ের পাঁজর বোঝা যেচে ইসব কি কেউ দ্যাখে? আমি যি দেখি। দূর থেকে দেখি, কাছ থেকে দেখি। খোঁকা কুনোদিন জানতেই পারে না। উসারার এক কোণে জানেলার ধারে বসে একমনে বই পড়ছে, কাজ করতে করতে একবার একবার থেমে আমি একদিষ্টে খোঁকার মুখের দিকে দেখি। চোরের মতুন দেখি। যেই বই থেকে মুখ তুলে ইদিকপানে তাকিয়েছে, অমনি আমি যেন কতোই না কাজে মন দিয়েছি!
বড় খোঁকা য্যাতোদিন ছোট ছিল, কুনোদিন দেখি নাই যি কত্তা ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখলে। ছোট ছেলেমেয়ে, কি আমার কি অন্য মানুষের, সে কুনোদিন ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারত না। আমি মনে করতম, মানুষটো কি পাষাণ! তা সেই কত্তাই আমার কাছে একদিন ধরা পড়ে গেল। দেখলম, আড়াল থেকে ছেলেকে দেখছে। সি যি এমনি দেখা লয়, তা আমি কত্তার দু-চোখের তাকানো দেখেই বোঝলম।
তা যাকগো, ইসব কথা আর বলে কি হবে। ছেলের শহরে যাবার দিন এগিয়ে এল। পরীক্ষা লিকিনি দ্যাওর আর আমার ভাই একসাথেই। দেবে। আজকালেই বড় খোঁকাকে স্কুলে ভত্তি করে দিয়ে আসতে হবে। দেরি হলে হবে না।
যিদিন সকালে যাবে সিদিন আর হেঁটে ইস্টিশনে যাবে না। এমনিতে কত্তা হেঁটে যেয়েই ইস্টিশনে টেরেন ধরে, আজ ছেলে নিয়ে বিশেষ কাজে যেচে, সেই লেগে মোষের গাড়ি করে যাবে। ছেলের লতুন জামা-পন্টুলুন হয়েছে, সকালেই গা-ধোয়া হয়েছে, জামা-কাপড় পরা হলে, ওর বাপ মাথা আঁচুড়ে দিলে। আমার কি যি মন হতে লাগল ছেলের চোখে কাজল দিয়ে দি, তা ধমক খাবার ভয়ে সি কথা বলতেই পারলাম না।
যাবার সময় হলে দাদি, ফুফু, চাচা, চাচিরা এল, সবাই খোঁকার মাথায় হাত দিলে, কপালে চুমু খেলে, দাদি-ফুফুর চোখে পানি এল কিন্তুক আমি কিছুই করতে পারলম না। বুকে কি যেন আটকে গেয়েছে। পাথর লিকিনি, কই কঁদতেও যি পারছি না! চারদিকে কি। হচে কিছুই বুঝতে পারছি না, সব ছেয়া হেঁয়া। কত্তা খুব তাড়া দিতে লাগল। এও তার ছল। কেঁদেকেটে একাকার করে যাবার সোমায়টো না লষ্ট করে ফেলে কেউ, এই লেগে সে অমন তাড়া দেয়। খোঁকাকে নিয়ে সবাই ঘর থেকে বেরুবে, এমন সোমায় খোঁকা টুক করে আমার কাছে এল। একদম বুকের কাছে এসে বললে, যেচি। চোখের পানিতে সব এমন ছয়লাপ হয়ে গেল যি, হ্যাঁ বাপ, যাও, ই কথাটিও বলতে পারলম না।
গাড়ি খামার পেরিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলে একটো তরাস এসে বুকে ঢুকল। কিসের যি তরাস তা জানি না। কিন্তুক শুনলে কেউ পেত্যয় যাবে না, সেই তরাস আমার সারা জেবনেও আর গেল না।