তা সেই দোপরবেলা–কাকচিলের আওয়াজ নাই, আসমান থেকে আগুন ঝরছে, এমন সোমায় ভাইটি আমার বাড়ি ঢুকে ছামনে এসে দাঁড়ালে। অ্যানেকদিন দেখি নাই, হঠাৎ চিনতে পারলম না। কে এই ছেলেটি? গোরো ধপধপে, গোঁপদাড়ি অ্যাকনো হয় নাই, হবে-হবে করছে, কে গো এই ছেলেটি? পরেই তাকে চিনতে পারলম। দখিন-দুয়োরি উসারায় একটা মোড়ায় তাকে বসালম। মা এল, ভাইবুনেরা এল। মা আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে পাখার বাতাস করতে লাগল। বড় বুনটো শরবত করে আনলে। এই ভাই তত উদের সবারই বড়। শরবত-টরবত খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে সে যা বললে তাতে আমি ভয় পেয়ে গেলম। তার ইশকুলের শ্যাষ ক্লাসের পড়া শ্যাষ, আর কমাস বাদে শ্যাষ পরীক্ষা। সি পরীক্ষা তো গাঁয়ের স্কুলে লয়, সি পরীক্ষা হবে কাটোয়া শহরে। অ্যানেক টাকা লাগবে। কে দেবে এই টাকা? মামুদের তো দুটো টাকা বার করারও খ্যামতা নাই। যি বাড়িতে থাকে, খায়–তারা তো আর টাকা দেবে না।
দামাদ-ভাই এত করেছে, যা করবার সব করেছে, তার কাছেই বা যাব কেমন করে। তাই বাপজির কাছে এয়েছি। বাড়িতে মরাই বাঁধা রয়েছে, একটা নয়, দু-দুটো–ক-মণ ধান বেচলেই তো পরীক্ষার ফি-র টাকা হয়ে যায়।
তা বেশ, বাপজি অ্যাকন বাড়িতে নাই, আসুক, দোপরের ভাত খা, বিছাম কর, তারপর বলিস বাপজিকে।
আমার কথা শুনে সে জোরে মাথা নাড়লে। ভাত দোপরে সে খাবে না। বাপজিকে এগু বলে তাপর অন্য কাজ।
তাকে তো সবাই চেনে, কিছুতেই পয়সা খরচ করতে চায় না। যি লোকের এত বুদ্ধি, দুনিয়ার লোককে বুদ্ধি-ফুদ্ধি দেয়, টাকাপয়সা : খরচের কথা উঠলেই সি লোকের বুদ্ধি কোথা যায় কে জানে! বাড়িসুদু সবাই কাটা হয়ে থাকল, না জানি আজ কি অঘটন ঘটে।
খানিক বাদে বাপজি এল। ত্যাল মেখে গা ধুতে যাবে। অ্যামন সোমায় বড় ছেলে এসে ছামনে দাঁড়িয়ে মাথা হাট করে বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। বাপজি তার দিকে তাকিয়ে ত্যাল মাখা বন্ধ করে ঠান্ডা গলায় শুদুলে, কিছু বলবে? কি বলবে বলো। এই কথা শুনে ভাইয়ের আমার গলা কাঁপতে লাগল, কথা ঠেকে ঠেকে যেতে লাগল। বহুত কষ্ট করে কুনোরকমে কথাগুলিন সে বললে। তাপর যেন তার সাহস এট্টু বাড়ল।
আমার পরীক্ষার ফল খুব ভালো হচ্ছে, এই শেষ পরীক্ষাতেও ফল ভালোই হবে। আমি কলেজে পড়ব, বি এ পাশ করব।
সব কথা শুনে বাপজি অ্যানেকক্ষণ চুপ করে থাকলে। মনে হলো। কুনো কথাই যেন সে শুনতে পায় নাই। ওমা, তাপর সে উঠে দাঁড়িয়ে দড়ি থেকে গামছাটো তুলে কাঁধে ফেলে গা ধুতে যাবার লেগে উসারা থেকে নামতে নামতে বললে, ধান বেচা যাবে না। মরাইয়ে যে কটো ধান আছে তা সবারই মুখের গ্রাস। বেশি যা আছে, তা বেপদ-আপদের লেগে রাখতেই হবে। ধান বেচা যাবে না।
এই কথা বলে বাপজি শা-দিঘিতে গা ধুতে বেরিয়ে গেল। সে-ও গেল আর আমি দেখলম, ভাইয়ের আমার মুখটি লাল টুকটুকে হয়ে উঠল। কদবার পাত্তর সে লয়, ঐ বাপেরই ছেলে তো, আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে একপা-দু-পা করে এনে পেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেচে, আমরা সবাই যেয়ে তাকে ধরলম। মা বললে, আর কিছু হোক আর না হোক, ভাতের ওপর রাগ করিস না, ভাত খেয়ে যা বাপ। মুখ ঘুরিয়ে ভাই ত্যাকন বললে, মা, তোমার ভাত হলে খেতম। এ যে আমার বাপের ভাত-যেদিন খাব জোর করে খাব, না হলে খাব না। এই বলে আমাদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে চলে গেল। কিন্তুক বললে কেউ পেত্যয় যাবে না, গা ধুয়ে এসে সব শুনে বাপজি একটিও কথা না বলে খেতে বসলে আর রোজ যেমন খায়, তেমনিই খেলে। একটি ভাত যি কম খেলে তা লয়।
এই ঘটনার পরে দুটো দিনও পার হয় নাই, একদিন কা এসে হাজির। বাপজি ত্যাকন বাড়িতেই ছিল। সোজা তার কাছে যেয়ে বললে, আপনার বড় ছেলের পরীক্ষার ফি-র টাকা লাগবে। নগদ টাকা আপনার কাছে নাই তা জানি। কিছু ধান বেচেই এই টাকা জোগাড় করতে হবে। বিপদ-আপদের কথা বলেছিলেন, ছেলের এইরকম বিপদের সময়েই তো এই ধান কাজে লাগবে।
কথা শুনে বাপজি চুপ করে রইল, মুনিষ বৈকালি আসবে মোকামে ধান বেচে বেলাবেলিই ফিরবে।
সিদিন দেখেছেলম, বাপের কথায় ছেলের মুখ কেমন রেঙেছিল, আজ দ্যাখলম জামাইয়ের কথায় শ্বশুরের মুখ কেমন রাঙা টুকটুকে হলো। ই যি বাপজির ভায়ানক চাপা রাগ তা বুঝতে আমার বাকি থাকল না। কিন্তুক বাপজি একটি কথা বললে না–হ্যাঁ কি না একটি আওয়াজ বেরুল না তার মুখ থেকে।
বৈকালি লোক এল, মরাই ভাঙলে। গাঁয়ের কয়াল এয়েছিল, সে ধান মাপলে। কত্তা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে আর বাপজি দোপরে খেয়ে ঘরে ঢুকে ঘর আঁদার করে সেই যি শুয়ে থাকলে, একবার বেরিয়ে এল না। আমরা সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলম, কপাল পয্যন্ত লাজ কেড়ে সৎ-মা হেঁশেলের দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলে, সৎ-ভাই আর বুনগুনো ভয়ে কেমনধারা করে চাইতে লাগলে, কত্তা কিন্তু কিছুই গেরাজি করলে না।
গাড়ি বোঝাই করে য্যাখন ধান মোকামে বেচতে নিয়ে যেচে, কত্তাও ত্যাকন আর থাকলে না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মা তাকে কিছুই বলতে পারলে না, রাতটো থেকে যেতে বলবে কি কিছু, সিকথা মুখ দিয়ে বার করতেই পারলে না। অ্যামন রাশভারি মানুষ ছিল উ। কত্তা য্যাকন চলেই গেল, মা ত্যাকন হেঁশেল থেকে বেরিয়ে বাপজির ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলে। আমিও কি মনে করে মায়ের পেচু পেচু আসছেলম। দরজা পয্যন্ত এয়েচি, কানে এল বাপজি বলছে, আমার মরাই ভেঙে আমারই ছেলেকে যখন সে পর করে দিলে, ওর ছেলেকেও আর বেশিদিন স্কুলে যেতে হবে না