দোপর গড়িয়ে পেরায় বৈকালবেলায় একটো চটিতে পৌছুলম। আর গাঁ দূরে লয়। কিন্তুক চটিটো তেপান্তর মাঠের মাঝখানেই। ইদিকে-উদিকে দু-চারটো মেটেঘর। মোটে একটো-দুটো ভদ্রাসন। এমন জায়গায় কুনো গেরস্ত কি নিয়ে থাকতে পারে? তবু এই তেপান্তরে বাস করছে দু-একটো পরিবার। আর মেটে ঘরগুলিন হচে দোকান–মুদির দোকান, হাঁড়িকুড়ির দোকান আর মিষ্টির দোকান। যতোবার আসি মিষ্টির দোকানে একবার গাড়ি থামে। ভাইবুনদের লেগে মিষ্টি লি, ছেলেপুলেরা খায়। মিষ্টি কি-ই বা আর পাওয়া যায়। রসগোল্লা, মন্ডা, জিবে-গজা, চিনির ছাঁচ, কদমা-বাতাসা এইসব। ছেনার মিষ্টি-রসগোল্লা আর মন্ডা খুব ভালো হয়। কুনো ভ্যাজাল থাকে না। উপয় থাকলে ময়রা লিশ্চয় ভ্যাজাল দিত, নিরুপায় হয়েই ভ্যাজাল দেয় না। ছেনা আর চিনি দিয়ে মিষ্টি, ভ্যাজালটো কি দেবে? খুব বেশি হলে ছেনায় সুজি দিতে পারে। তা কতোটেই বা দিতে পারে আর সুজি তো খারাপ কিছু লয়। যাই হোক, ছেলেরা, গাড়োয়ান আর হলা বাগদি মিষ্টি খেলে। আমি রাস্তাঘাটে কিছু খাই না। ভাইবুনদের লেগে মিষ্টি নেওয়া হলো শালপাতার বড় বড় ঠোঙায়!
সাঁঝবেলায় মুখ-আঁধারি রেতে বাপের বাড়ি পৌছুলম। সাঁঝ বেলাটোর মুখে কুথাও যেয়ে পৌছুইতে আমার ভালো লাগে না। পিদিম ঘরে ঘরে, নাইলে হেরিকেন জ্বালাইচে, মিটমিট করে আলো জ্বলছে–কিছুই ভালো দেখা যেচে না, মনটো খারাপ লাগে, বৈকালি এসে পেঁৗছুতে পারলে আমি ছেলেদুটিকে তাদের নানি-খালার কাছে রেখে পাড়া বেড়াইতে চলে য্যাতম, নাইলে পাড়ার লোকেরাই আসত বাড়িতে দেখা করতে অ্যাকন আর তা হবার বাগ নাই।
বাড়িতে মা বাপজি ছাড়া এক ভাই, তিন বুন রয়েছে। সৎ-ভাইটো বেশ বড়সড়ো হয়েছে, দুটি বুনও অ্যানেকটো ডাগর হয়েছে। শুদু একটা বুন দুধের শিশু। আমার মা মরে গেলে কি হাল হয়েছিল ই সসাংসারের সব পেরায় ভেসে গেয়েছিল। সৎ-মা এসে আবার ভর-ভরন্ত সোনার সোংসার করেছে। শুদু একটো কথা আচ্চয্যি! বাপজি সি কালের হিসেবে বিদ্বেন লোক, বাংলা জানে, ফারসি জানে, ফারসি বয়েত পয্যন্ত লিখতে পারে, নিজে একটো শুভঙ্করি বই লিখেছে কিন্তুক ছেলেমেয়েদের ল্যাখাপড়ার দিকে ক্যানে তার মন নাই কে জানে! আমাকে নাহয় পাঠশালে পাঠায় নাই, মা মরেছে, ছোট ভাইটো কোলের, সোংসারে বেপৰ্য্যয় বেপদ, মেয়ের ল্যাখাপড়া না হয় না-ই হলো। তা বাদে মেয়েমানুষের আবার ল্যাখাপড়া কি, বারো হাত শাড়িতে মেয়েমানুষ লিকিনি ল্যাংটো, ইসব পাড়াগাঁয়ের মেয়ে কুনোদিন তো জজ-ব্যালেস্টার হবে না, তাইলে তাদের আবার ল্যাখাপড়া শেখার কি দরকার? হ্যাঁ, বোঝলম ইকথা। কিন্তুক ভাইটো কি দোষ করলে? বড়টোর দায়ভার তো নিতে হয় নাই, আমার মামারাই সি ভার নিয়েছে। তাইলে ই ভাইটো ক্যানে ল্যাখাপড়া শিখবে না? দেখলম সে আর স্কুলে যায় না। কুনোমতে পাঠশালের পড়া শ্যাষ করেছে। স্কুলে আর যায় নাই। তাকে শুদিয়ে জানতে পারলম, স্কুলে ভত্তি হতে টাকা লাগবে। বাপজি বলেছে টাকা আসবে কোথা থেকে! স্কুলে পড়ে কাজ নাই।
হঠাৎ একদিন ঠিক দোপরবেলায় ক-ক রোদে আমার ছোট ভাইটি এসে হাজির হলো। অ্যানেকদিন থেকে দেখি নাই। ইয়াকেই দুবছরেরটি রেখে আমার মা দুনিয়া থেকে চলে গেয়েছিল। তাপর বেশিদিন আর বাপজির সোংসারে থাকতে হয় নাই তাকে। মামুরা এসে নিয়ে গেয়েছিল। তারাই তাকে বড় করবে, মানুষ করবে, যা যা করার সবই করবে। আপন লোকদের কাছেই গেল বটে ভাইটো কিন্তুক বাপজি ক্যানে ছেলে ছেড়ে দিলে, সি আমি ত্যাকননা বুঝি নাই, অ্যাকনো বুঝি নাই। অভাবের সোংসার লয়, কিছু লয়। লতুন সোংসার হয়েছে তাতেই বা কি, আমি বড় বুনটা তো আছি ভাইকে দেখার লেগে! তাইলে ছেলে দিয়ে দিলে ক্যানে? সে মামুদের কাছে চলে যাবার পরে আমার সাথে কমই দেখা হয়েছে, মামুদের গাঁয়ের পাঠশালে ভত্তি হয়েছিল। সেখানকার পড়া শ্যাষ হলে আমার শ্বশুরবাড়িতে কত্তার কাছে এয়েছিল। আমার কাছেই আসলে এয়েছিল। বললে, মামুরা তো আর পড়াইতে পারবে না। সে সোমায়ে উ গাঁয়ে বড় স্কুল ছিল না। ত্যাকনকার দিনে বড় স্কুল আর কটো ছিল? খুবই কম আর যে কটোই ছিল, অ্যানেক দূরে দূরে। সেই লেগে দূরের কুনো গাঁয়ে থাকা-খাওয়া থেকে স্কুলের মাইনে পয্যন্ত যি খরচ হবে তার জোগান দেবার শ্যামতা মামুদের নাই। তারা আর কিছু করতে পারবে না। ইসব কথা শুনে আমি কিন্তু কিছুই বলি নাই। হোক মায়ের পেটের ভাই, তবু বাপের বাড়ির আত্মীয়। তার লেগে বলতে যেয়ে আমি ক্যানে শ্বশুরবাড়িতে দোষের ভাগী হব! শাশুড়ি-ননদ য্যাকন বেঁচে আছে। তা আমাকে কিন্তু কিছুই বলতে হলো না। কত্তাই বললে, বেশি কথার লোক লয়, একটো কথাই বললে, আমি দেখছি।
তার পরের দিনই ভাইটিকে নিয়ে কত্ত বেরিয়ে গেল আর সেইদিনই অ্যানেক রাতে একা ফিরে এসে বললে, ট্রেনে কাটোয়া যেয়ে সেখান থেকে দু-কোশ দূরের একটো গাঁয়ের এক নামজাদা ইশকুলে ওকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে আর এক মোকাদিম মোসলমানের বাড়িতে তার জায়গিরের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে। সে ঐ বাড়িতে থাকবে, খাবে, ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াবে আর ইশকুলে নিজের পড়া পড়বে।
সেই থেকে সে ঐ ইশকুলেই পড়ছিল। কেমন আছে, কি খেচে আমি যি তার খুব খবর লেতম তা নয়। আমার শ্বশুরবাড়িতে সে আসত কমই। য্যাকন আসত সুবিদা-অসুবিদার কথা বলতেই আসত কত্তাকে। তাকে বাপের মতুনই মান্যি করত, ঠিক যেন বটবিরিক্ষের ছোয়ায় বসে আছে। ইশকুলের ছুটি হলে নানার বাড়িতেই চলে যেত বেশিরভাগ সোমায় বলতে গেলে সিটোই তার নিজের বাড়ি। বাপজির কাছে বোধায় তেমন যেত না। সৎ-মা আছে বলে লয় কিন্তুক, বাপজির কারণেই মনে হয় তার উ বাড়ি যেতে মন করত না। সি যি মামুদের কাছে থাকে সিটি বাপজির পছন্দ লয়। সি যি এত কষ্ট করে ল্যাখাপড়া শিখচে সিটিও তার পছন্দ লয় অথচ নিজে কিছু করবে তার লেগে।