মাঝখানে দু-বছর যাই নাই। যাই নাই কিন্তুক ইবার যেই যাবার কথা হলো, কত্তাও মত দিলে, ত্যাকন জান যেন ছেড়ে যেতে লাগল। কি করে ভুলে ছেলম মা! কোন্ নিব্বাসনে পড়ে আছি? কাদের নিয়ে কি করতে সোদর ছেড়ে এত দূরে আছি? কোথা রইল মা-বাপ, কোথা রইল ভাই-বুন, কোথা রইল গাঁ-ঘর–এইসব মনে করে বুকের মদ্যে হু হু করতে লাগল।
আমি বাপের বাড়ি য্যাতম আমাদের নিজেদের মোষের গাড়িতে আর ফিরে আসতম বাপের বাড়ির গরুর গাড়িতে। গাড়ি বিহানবেলায় যাবার লেগে তৈরি হলো। গাড়িতে খ্যাড় বিছিয়ে তার ওপর মোটা মোটা চারটো ফুল-তোলা কাঁথা বিছিয়ে বিছেনা তৈরি হলো। নতুন টপ্পরের পেছনের মুখ শাড়ি দিয়ে বাঁধা, ছামনের মুখ-ও শাড়ি দিয়ে বাঁধা। একবার ভেতরে ঢুকলে আর কিছুই দেখবার উপয় নাই। মাহিন্দার ছোঁড়াটো গাড়ি ডাকিয়ে নিয়ে যাবে, পাকা বাঁশের লাঠি নিয়ে পেছু পেছু হেঁটে যাবে হলা বাগদি। পৌছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরে আসবে।
দুই ছেলে সাথে করে গাড়িতে উঠে টপ্পরের ভেতরে ঢোকলম,, কবরের ভেতরে ঢোকলম! বড় খোঁকা ত্যাকন অ্যানেকটো সেয়ানা হয়েছে। সে ভেতরে থাকবে ক্যানে, গাড়োয়ানের কাছে যেয়ে বসবে। আমি খালি ভাবচি পাড়াটো শুধু পেরুইলে হয়, মাঠে যেয়ে পড়তে বাকি, টপ্পরের ছামনের শাড়িটো তুলে দোব। গাড়ির কাঁচ কাঁচ আওয়াজ হচে, টপ্পর লতুন রঙ করা হয়েছে, তার গন্দো আসছে, টপ্পরের সরু একটো ফাঁক দিয়ে রাস্তার লাল ধুলো দেখতে পেচি। বোঝলম, পাড়াটো পেরিয়ে এসে গাঁয়ের ঠিক বাইরে বড় দিঘিটোর দখিন পাড় দিয়ে যেচি। শুকনো ডহরে হড় হড় করে গাড়ি নেমে আবার রাস্তায় উঠতেই আমি খোঁকাকে বললম, ছামনের কাপড়টো সরিয়ে দে তো বাপ।
কাপড় সরিয়ে দিতেই এমন ভালো লাগল সি আর কি বলব! সকালবেলার হাওয়া এসে গায়ে লাগল, জানটো যেন তর হয়ে গেল। ইদিকে নদীনালা তেমন নাই, শুদু ধানের জমি। বিরাম জমি লয়, সেই লেগে মাঠ ধু ধু করে না। ফসলি ধানের জমির মাঠ, তার কি অরম্ব, শ্যাষ নাই? যিদিকে তাকাই, চোখ যেচে যেচে যেচে, কোথাও আটকাবে না। উঁচু-নামো-ও নাই কোথাও। শ্যাষে অ্যানেক দূরে চোখ যেয়ে ঠেকছে কুনো একটো গায়ে। মাথার ওপরের আসমানের মতনই মাঠের আসমান।
সেই সোমায় রাস্তাঘাট তেমন ছিল না। পাকা রাস্তা তো লয়-ই, কাচা সরান-ও লয়। মাঠের ওপর দিয়ে পায়ে-চলার রাস্তা চ্যাওড়া আলের ওপর দিয়ে। লোকে বলে পথ-আল। আর আছে গরু-মোযের গাড়ি চলার অনেক অ্যানেক রাস্তা। কিলবিল করছে। এঁকে-বেঁকে হয়তো দশটো রাস্তার একটো যেয়ে গাঁয়ে ঢুকেছে। ইসব রাস্তা ধান-কাটার সোমায় জাড়কালে খুব ব্যবহার হয়েছে। অ্যাকন খরানির কালে আস্তে আস্তে ঘাসে ঢেকে যেচে। শুদু একটো-দুটো রাস্তা এক গাঁ থেকে আর এক গাঁ হয়ে মাঠের বুক চিরে কোথা গেয়েছে কে জানে! গাড়ি যেয়ে যেয়ে সিসব রাস্তায় খুব ধুলো। বাতাসে উড়ছে, আর বেশি বাতাস হলে ধুলোয় ধুলিষ্কার শাদা মেঘ হয়ে উড়ে বেড়াইচে।
মাঠের মাঝে এসে দেখলম, কুনোদিকে লোকজন দেখা যেচে না। অ্যাকন থাকবেই বা ক্যানে লোক? সেই মাঘ-ফাগুনে ধান কাটা হয়ে গেয়েছে। সব একফসলা বোয়া আমন ধানের জমি, ধান ছাড়া আর কিছু হয় না। ধান কাটার পরে জমি সব অ্যাকন ফাঁকা পড়ে আছে, নাড়াগুলিনও ধুলোয় ঢেকে গেয়েছে। আবার জষ্টি মাসে পানি হয়ে জমিতে বাত না হলে গরু-মোষের নাঙল নিয়ে মানুষ মাঠে নামবে না।
আমি তাই টপ্পরের দু-মুখের শাড়িই খুলে দিতে বললম। কে আর দেখছে? দুই পুত নিয়ে বাপের বাড়ি যেচি, ভয় তো কিছু নাই! সঙ্গে লোকও আছে। গাছপালা ইদিকে তেমন নাই বটে, তাই বলে বনকুল শেয়াকুল, র্যালপাতি ইসবের ঝোপ-ঝাড় কি নাই? আর আছে যিখানে সিখানে থ্যালানে থ্যালানে পুকুর। অ্যাকন শুকিয়ে কাঠ। দু-একটোয় সামান্য পানি আছে, অ্যাকটো-দুটো আছে বেশ পানিতে ভরা। সি পানি খাওয়া-ও যায়। ইসব মেঠো দিঘির পাড়ে বেরাট বেরাট বট-পাকুড় গাছ। তাদের হেঁয়ায় খানিকক্ষণের লেগে গাড়ি থামিয়ে গরু-মোষের বিঘ্রাম হয়। উদের পানি খাওয়ানো-ও হয়।
আমরা তা-ই করলম, অ্যাকটো বড় পাকুড় গাছের তলায় গাড়ি থামিয়ে গাড়োয়ান মোষদুটোকে পানি খাওয়াইতে নিয়ে গেল। আমি-ও কঁকালটো একটু ছাড়ানোর লেগে ছেলেদুটোকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলম। দ্যাখলম, হলা বাগদি ত্যাল-চুকচুকে পাকা বাঁশের লাঠিটি বগলে রেখে দু-হাত জোড় করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয় কিছু নাই। জানি যি হলা বাগদি কুনো বেপদ এলে জানকে জান করবে না, তাকে না মেরে আমার কি আমার সন্তানদের গায়ে কেউ একটো আঁচড় পয্যন্ত দিতে পারবে না।
আমি এট্টু ইদিক-ওদিক হাঁটছি, বড় খোঁকা বটগাছটোকে ঘুরে ঘুরে দেখছে কি কি পাখি আছে। দোপরবেলা, তাই পাখি ডাকছে না বটে কিন্তুক অত বড় গাছে অনেক পাখি নড়েচড়ে বেড়াইছে বেশ বোঝা যেচে। গাছটো মনে হচে জ্যান্ত, কথা বলছে। গাছতলায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলম। হ্যাঁ, অ্যাকন মনে হচে, মাঠের ঠিক মাঝখানে এয়েছি। কুন্ দিকে কুন্ গাঁ তা আর বোঝা যেচে না। ধুলোয় লেপুটে গেয়েছে। অ্যাকন আসমানও লাগছে গোল, মাঠও লাগছে গোল। একটু ভয় লাগল, ক্যানে তা জানি না। খালি মনে হতে লাগল কুনো রাস্তাই আর শ্যাষ হবে না। কি করে কোথা শ্যাষ হবে কে বলতে পারবে? মনে হচে, ঘরবাড়ি পুকুরঘাট সবুজবন আর কি দেখতে পাওয়া যাবে! ইকথা মনে করে নিজের মনেই হাসলম। কতোবার ই পথ দিয়ে বাপের বাড়ি গেয়েছি। যতোদূরই হোক, পথ কি ফুরোয় নাই, মায়ের কাছে কি যাই নাই?