বেপদের ছোঁয়া কি চেরকাল থাকে? ই বাড়িতেও থাকল না। একদিন খবর পাওয়া গেল ছোট যে বুনটির বিয়ে হয়েছিল দশ কোশ দূরের এক গাঁয়ে, সেই বুনের একটি খোঁকা হয়েছে। যেদিও সি অন্য বংশের বেপার, তাদের বাড়িতে পেথম বংশধর এয়েছে, তবু মেয়ে তো ই বংশের! সেই লেগে ই বাড়ি আনন্দের সাগরে ভাসতে লাগল। কত্তা তার ছোট বুনদের কি চোখে দেখত সিকথা আগে বলেছি। বিশেষ, তার এই ছোট বুনটিকে ভারি ভালোবাসত! সোম্বাদ পেয়েই কতো কি সামিগ্রি দিয়ে ঝুড়ি বাঁক ভরে লোক রওনা করিয়ে দিলে আর নিজে ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটল ছোট বুনের বাড়ি। গাঁয়েই যে বড় বুনের বিয়ে হয়েছিল, তার ত্যাকন বেশ কটো ছেলেমেয়ে হয়েছে, দুটি ভাগ্নে তো ত্যাকন বেশ ডাগরই হয়েছে, তবু ভিনগাঁয়ে ছোট বুনের খোঁকা হবার খবরে কত্তা কি খুশি যি হলো সি আমার অ্যাকনো মনে পড়ে।
আস্তে আস্তে সব আবার আগে অ্যাকন জোয়ান মরদ হয়ে উঠেছে। দুজনাই বড় স্কুলে পড়ছিল। সেজ-জনা তো ল্যাখাপড়া করলে না, আমার বিয়ের আগেই বোধায় স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। অ্যাকন দেখছি ল-দ্যাওরের-ও মতিগতি ভালো লয়, স্কুল মনে হয় ছেড়েই দেবে। কত্তার কাছে এসে মাথা নামিয়ে দাঁড়ায়, পায়ের নোখ দিয়ে মাটি খোঁড়ে আর ব্যাবসা-ট্যাবসা করা যায় কিনা ভয়ে ভয়ে ভাইকে সেই কথা শুদোয়। তবে ছোট দ্যাওরটি মন দিয়ে স্কুলে পড়ছে। আমার খোঁকাও কালা ওস্তাদজির কাছ থেকে ছাড়ান পেয়ে স্কুলে ভত্তি হবে হবে করছে। এই সোমায়ে য্যাকন। সবারই মনে হছিল সোংসারে শিগগিরি আর কুনো ছেলেমেয়ে আসবে না, সেইরকম সোমায় আমারই আর একটি খোঁকা হলো। বড় খোঁকার বয়েস ত্যাকন আট বছর।
বড় খোঁকা ছিল শামলা, সি রঙ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত, জানে শান্তি হতো। গরমকালে গাছের ছোঁয়ায় বসার মতুন মনে হতো। আর ই লতুন খোঁকার রঙ হলো গোয়রা ধপধপে। বড় খোঁকা হলো ঠিক তার বাপের মতুন–কৰ্ত্তার গায়ের রঙ-ও ছিল শামলা–লতুন খোঁকা হলো তার মামার মতো।
তাইলে সোংসারে ত্যাকননা পয্যন্ত ছেলেপুলে বলতে হলো আমার দুটি খোঁকাই। সেই কালে ছেলেমেয়ে কমবেশি নিয়ে কেউ কিছু ভাবত না। চাকরি করে কঁচা টাকা আয় করে সবকিছু কিনে খাওয়া তো ত্যাকন ছিল না। সবাই গাঁয়ে-ঘরে থাকে, বাইরে আর কে যেচে? বাড়ির খেচে, বাড়ির মাখছে। শুদু কি মানুষ? গরু ছাগল কুকুর বেড়াল সবারই হক আছে। বলতে গেলে এক থালাতেই সবাই খেচে। পগারে, জমিতে, ড্যাঙ্গায় যিখানে ঘাস হয়েছে, সি ঘাস দুটো ছাগলে খেলেও যা, দশটো ছাগলে খেলেও তা-ই। ঘাস কি ফুরিয়ে যেচে? সব্বারই গরুছাগলে সি ঘাস খেতে পারবে। বাড়িতে একটো ছেলে, না দুটো ছেলে, না দশটো ছেলে সি হিসেব ক্যানে করবে লোকে? খাক না সবাই মিলে য্যাতোক্ষণ আছে। তাই দেখতম পেরায় সব বাড়িতেই পাঁচটো-ছটো ছেলেমেয়ে আছেই। দশ-বারোটো, পনেরোটা পয্যন্ত ছেলেমেয়ে হত কারু কারু। তবু গাঁ-ঘর ফাঁকাই লাগত, অ্যাকনকার মতুন গিগি করত না।
লতুন খোঁকার জন্ম হলো বলে বাড়িতে তাই আনন্দ বাড়ল বই কমল না। শাশুড়ি ননদ আমাকে নিয়েই বড়াং করতে লাগল। তারা বলত মেতর বউয়ের পয়েই সব হচে। আয়-সম্পত্তি বাড়ছে, আবার দ্যাখো ক্যানে, বংশও বাড়ছে।
এই করতে করতে দিন পেরুইচে, মাস পেরুইচে, বছর পেরুইচে, শ্যাষে দু-বছর গেলে, আমার পরের খোঁকাটি দু-বছরেরটি হলে, একদিন জানা গেল সেজ বউ বারদার। এই কথা জেনে আমার আনন্দ হলো সবচেয়ে বেশি। এতদিন পেরায়ই মনে হতো সবারই সব সুখ যেন আমি একাই কেড়ে নিয়েছি। সুখ যি ভাগ করে নিতে হয়। নিজের সুখ কম করে নিলে তবে সেই সুখ বাড়ে। আমি সেজ বউয়ের খুব আদর-যত্ন করতে লাগলম। অনেক কাজ আর আমি তাকে করতে দেতম না, নিজেই করতম।
গাঁয়ের খাওয়াদাওয়া ত্যাকন খুব শাদামাটা, একইরকম খাবার-দাবার সব বাড়িতে। সেই ভাত ডাল তরিতরকারি! মাছ গোশতো খুব কম। মাছ যেদি বা মিলত, গোশত খাওয়া খুবই কম। হিঁদুরা বোধায় সারা বছরেও একদিন গোশতো খেত না। মোসলমানরা মুরগি পুষত বলে ডিম আর মুরগির গোশতোটো কখনো কখনো খেতে পেত। সেজ বউয়ের খাওয়াটো যাতে ওরই মদ্যে একটু ভালো হয়, আমি সেই চেষ্টা করতাম। তবে সে খুব সামান্য। কারও লেগে, কুনো কারণে আলাদা খাবার-দাবারের কথা ত্যাকন কেউ ভাবত না। ছেলেমেয়ে হবে, না হবে, ভূ-ভারতে রাতদিন হচে, ইয়ার লেগে আবার হ্যানো লয় ত্যানো করতে হবে ক্যানে। সি যা-ই হোক, দুধ আর ডিমটো আমি আলাদা করে সেজ বউকে জোর করে খাওয়াতম। দশ মাস। দশ দিনের মাথায়, কে জানে দশ মাস, না ন-মাস–সবাই দশ মাস দশ দিনই বলত, তাই বলছি, দশ মাস দশ দিনের মাথায় সেজ বউয়ের একটো মোটাসোটা খোঁকা হলো। আপনাআপনিই হলো। দাইবউ এসে দেখে খোঁকা হয়ে গেয়েছে। মাটিতে পড়ে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে। আমরা সবাই মজাক করে হেসে হেসে বললম, দাইবউ, তোমার ইবার আর কুনো পাওনা নাই, আঁতুড়ঘরে ঢুকতেও হলো না। ই ছেলে তোমাকে কি দাই-মা বলে ডাকবে?
কথা শুনে দাইবউ লথ নেড়ে নেড়ে কি হাসতেই না লাগল। ইয়ার পরের কথাটো এইখানেই বলে দিছি। সেজ বউ আর কুনো সোমায় নিলে না–পরের বছর, এক বছর হয়েছে কি হয় নাই, তার আর একটো খোঁকা হলো।
০৯. ও মা, মাগো, কতোদিন যাই নাই, এইবার বাপের বাড়ি যাব
দুই ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি যেচি। ছোট ছেলেটো ত্যাকন একটু ভঁটো হয়েছে। মাঝখানে পরপর দু-বছর বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নাই সাংসারের হ্যাঙ্গামে। বিয়ের পর থেকে পিতিবারেই গরমকালে বাপের বাড়ি যাওয়া হয়েছে। আবার পিতি বছরেই বাপের বাড়ি থেকে ভাদর মাসের শেষে, নাহয় আশিন মাসে মা কতো যি খাবার-দাবার, পিঠেপুলি, ফলমূল, কাপড়-জামা পাঠাইত তার সীমা নাই। সৎ-মা বলে যি কোথাও গাফিলি হবে, তার জো ছিল না। ভারা কাঁধে নিয়ে লোক আসত, সঙ্গে আসত বাগদিবউ। অ্যানেকরকম জিনিশ আসত। কুনো কুনো বছর আবার বড় মিরিক লয়তো রুই মাছও আসত। শাশুড়ি ইসব যেমন খুব পছন্দ করত, তেমনি নিজের কত্তব্যও করত। ফেরত যাবার সোমায় বাগদিবউকে খুশি করে দিত। ভারাটো-ও ফাঁকা যেত না। আমি বাপের বাড়ি যাই আর না যাই মায়ের কিন্তুক উসব পাঠানোর কুনোবছর কামাই ছিল না।