কদিন বাদে, এক-দু-মাস হবে, কত্তা একদিন ঠিক দোপরবেলায় বাড়ির ভেতরে এসে মাকে বললে, ঘোড়া একটি কেনা হয়েছে, আমাদের খামারে বাঁধা আছে। আড়াল থেকে দেখবে চলো।
শাশুড়ির বাইরে আসার মন ছিল না। কিন্তুক ছেলে বললে আর কি করবে। বউ-ঝি বিধবা ননদ সবাইকে সাথে যেতে বললে। কত্তার ভাইরা কেউ ছিল কি না মনে পড়ছে না। পরচালির দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলম, এই বড় একটো সর্ষে-সর্ষে রঙের ঘোড়া খুঁটিতে বাঁধা আছে, মাহিন্দার ছোঁড়াটো একবার কাছে যেচে, আবার ভয়ে পিছিয়ে আসছে। ঘোড়ার লতুন সাজ, নতুন চামড়ার জিন, ইসব কেনা হয়েছে–সি-সবের গন্ধ পেচি, চামড়ার ক্যাচম্যাচ আওয়াজও পেচি। শাশুড়ি এট্টুখন দাঁড়িয়ে থাকলে, তাপর বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
আর কি, সব তো মোলোকলায় পুন্ন হলো। সবাই এমন ভাব করতে লাগলে যেন সব গরবই আমার। মিছে বলব না, সি আমার খুব ভালো লাগত। তাই বলে দেমাগ আর গরব দেখানোর কুনো বাগ নাই। আমি জানতম, উসব করতে গেলে কত্তা আমার নতিজার বাকি রাখবে না। চিনি তো উ মানুষকে। তা আমারও কুনোদিন উসব করতে মন যায় নাই। আমি ছেলের মা, আমার তো আর কুনো গরব নাই। এক এই গরবই য্যাথেষ্ট!
০৮. সোংসার সুখ-দুখের দুই সুতোয় বোনা বই-তো লয়
বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার খোঁকা হয়েছিল। তাপর আট বছরের মধ্যে আমাদের সোংসারে আর কুনো ছেলেপুলে হয় নাই। ভাশুরের বিয়ে কত্তার বিয়ের ক-বছর আগেই হয়েছিল। পেথম পেথম মনে হতো, বড় বউয়ের ছেলেমেয়ে হতে একটু সোমায় লাগছে। তা-পর এক বছর যায়, দু-বছর যায়, তিন বছর যায়, য্যান ছেলেপুলে হলো না, ত্যাকন বোঝা গেল উয়াদের আর সন্তান হবে না। ওষুধ-পত্তর করা হয়েছিল বৈকি। কিন্তুক কেরমে কেরমে সবাই আশা ছেড়ে দিলে। বড় বউ তাইলে বাঁজা। আর বড়কত্তা, আমার আলাভুলো ভাশুর, উ নিয়ে কুনোদিনই মাথা ঘামাইলে না। সে তো সংসারের কুনো কিছুতেই থাকত না!
সেজ দ্যাওরের বিয়েটা হলো অ্যানেক পরে। তার বিয়ের বয়েস পেরিয়ে গেয়েছিল। তবে এট্টু দেরি হলেও কত্তাই উদযুগ করে বিয়ে দিলে। কিন্তু বিয়ের তিন-চার বছর পরেও তার ছেলেপুলে কিছু হলো না। সেই লেগেই বলছেলম আট বছর ধরে সোংসারে ছেলে বলতে আমার ঐ খোঁকা। তা এই আবস্তায় সে আর একা আমার খোঁকা হয়ে ক্যানে থাকবে? সে হলো সবার চোখের মণি জানের জান। একা সোংসারে দিন দিন ছিরিবৃদ্ধি। সবাই মনে করতে লাগল ঐ খোঁকাই এত সুখের মূল। তাকে নিয়ে কি যে করবে সি আর কেউ খুঁজে পেত না। সবকিছুতে আগে বড় খোঁকার কথা। বাড়িতে মন্ডা মিঠাই এলে বড় খোঁকা কই? যে য্যাকন বাইরে যেচে, কিছু একটো হাতে করে আনছে বড় খোঁকার লেগে। কত্তাই বরঞ্চ খোঁকার দিকে তেমন নজর দেয় না। সে হয়তো সোমায়ই পায় না। হয়তো ভাবত, ছেলে তো সবারই, আমি না দেখলেই বা কি, দেখার লোকের কি অভাব? ছোট বুনটির ত্যাতোদিনে বিয়ে হয়ে গেয়েছিল বটে; তবে তারপরের ছোট ভাই দুটির ত্যাকননা বিয়ে হয় নাই। এই ল আর ছোট দ্যাওর দুটি আমার দুটি ভাই-ই ছিল, যা বলতম তা-ই শুনত আর খোঁকাকে খানিকক্ষণ না দেখলেই চোখে যেন আঁদার দেখত।
এই করতে করতে আট বছর কেটে গেল। কি আচ্চয্যি মা, চোখের ছামনে আমার শামলা রঙের খোঁকা আট বছরেরটি হয়ে গেল। কি তার চোখে মায়া কি তার, মুখে লাজুক হাসি! সি আর কুনোদিন দেখলম না! ঠিক সোমায়ে তার হাতেখড়ি হলো। কত্তা নিজেই হাতেখড়ি দিলে। এই সোমায়ে, কি করে আমার মনে নাই, গাঁয়ে এক ওস্তাদজি এল। তাকে গাঁয়ে আনা হলো, নাকি সে নিজেই এল, অ্যাকন আর বলতে পারব না। তার কাজ হলো খোঁকাকেই পড়ানো। গাঁয়ে, মোসলমান পাড়ায় তো পড়ার মতুন আর একটি ছেলেও ছিল না। কত্তা মাটির পাঁচির দিয়ে ঘেরা একটো বড় ভিটে কিনেছিল। একটি মাত্তর ছোট মেটে ঘর ছিল সিখানে, তাতে কুনো জানেলা নাই। আলকাতরা মাখানো একটিমাত্র দরজা ছিল। সেই ঘরে হলো ওস্তাদজির আস্তানা আর মোটে একজনা পোড়ো আমার খোঁকা। সবাই বলত কালা ওস্তাদজি, কানে সে কিছুই শুনতে পেত না। ভারি ভালো লোক, তিন-বেলা তার খাবার যেত আমাদের বাড়ি থেকে।
খোঁকার জন্মের চার বছর পর আমার একটা সন্তান লষ্ট হলো। সে-ও খোঁকা ছিল। পেট থেকে মরাই জন্মাইছিল। কে আর কি করবে? দু-দিন বাড়িটো থম ধরে থাকল, শুদু শাশুড়িকে মুখ ফুটে আহাজারি করতে শুনেছেলম। ত্যাকন দুনিয়া কঁকা ছিল, গভভভ লষ্ট হলে সবারই খুব গায়ে বাজত। ই ক্যানে হলো, ই ক্যানে হলো, এমন দুর্দৈব ক্যানে–শাশুড়ির খালি এই আপসোস! ইদিকে ছেলে হতে যেয়ে আমার পেরায় সব রক্ত বেরিয়ে গেল, মরার মতুন হলোম। শরীর শুকিয়ে কাটি হলো। মরা ছেলের মুখটো একবারই দেখেছেলম। সি না দেখাই ভালো ছিল। সোমায়ের অনেক আগেই সে দুনিয়াতে আসতে চেয়েছিল। যিদিন বাড়িতে এই বেপদ ঘটে, সিদিন কত্তা বাড়িতে ছিল কি না মনে করতে পারছি না। বোধায় ছিল না। বাড়ির বউয়ের সন্তান হবে ই ছিল মেয়েলি বেপার, বাড়ির পুরুষদের ইনিয়ে নিয়ে কুনো ভাবনাই ছিল না। তাদের তো কিছু করার নাই। হাড়িবউ দাই ঠিক করা আছে, সি ব্যবস্থা বছরকাবারি। বছরের শেষে দাই একটো সিদে পায়, শাড়ি-কাপড় পায়, চাল-ডাল পায়, পারলে কেউ কেউ নগদ-ও কিছু দেয়। সন্তান হলেও দেয়, না হলেও দেয়। বছর শেষে চোত মাসের মদ্যেই দেয়। আর সন্তান হলে তো কথাই নাই, ত্যাকন অ্যানেক কিছুই পায়। বড়লোকের বাড়ি হলে সোনা-রুপোর গয়নাও পায়। আমার বড় খোঁকা হলে তার দাই সোনার মাকড়ি পেয়েছিল। যাকগো, কত্তা সিদিন ছিল কি ছিল না মনে নাই, এতটুকুনি মরা ছেলে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে একপাশে রাখা হয়েছে। রেতে ফিরে কত্তা কি একবার দাঁড়িয়ে দেখলে? কি জানি! ডাক্তারবদ্যির কুনো কথাই ছিল না। তাই ভাবি, ছেলে মলো, মা-ও তো মরতে পারত। তাই যেদি হতো, তাইলে কত্তা কি করত? ব্যাটাছেলে আবার কি করবে? মায়ের কথা শুনে দিনকতক বাদে আবার বিয়ে করত। একটো ফল দিয়ে ফলগাছ মরে গেয়েছে, তা আবার তার পাশে আর একটো ফলগাছ লাগাতে হবে না? ইসব কথা অ্যাকন মনে হয়, ত্যাকন কিন্তুক মনে হয় নাই। কত্তার মুখটা কেমন হয়েছিল ত্যাকন দেখি নাই, পরেও কুনোদিন কত্তা ই নিয়ে কুনো কথা বলে নাই।