ছুটো-ছাটা কাজের মানুষ আরও ছিল। তিন-চার আনা দৈনিক মজুরিতে সারা দিনের লেগে মুনিষ দুটো-একটো পেরায় দিন থাকত। তারাও সব গরিব আত্মীয়স্বজন। পানি খাবার বেলা ভরপেট বাসিভাত নাইলে মুড়ি আর দোপরবেলায় ভরপেট গরম ভাত এদের জোগাতেই হতো।
ইসব হলো সারা বছরের ব্যবস্থা। কিন্তুক বর্ষাকালে ধান রোপার সোমায় আর পোষ মাসে ধান কাটার সোেমায় একদম আলাদা বেবস্তা। ত্যাকন দশ থেকে পনেরো জনা মুনিষ পেত্যেকদিন কাজ করত। আবাদের সোমায় টানা বিশ-পঁচিশ দিন থেকে এক মাস পয্যন্ত তাদের থাকতে হত। ধান কাটার সোমায়েও তাই, শ্যাষ না হওয়া পয্যন্ত তারা থাকত। অত লোক কোথা পাওয়া যাবে? ভিন গাঁ থেকে, উত্তরের সব গরিব গাঁ থেকে আসত মুনিষরা। তা বাদে সেই কোথা ছোটনাগপুরের দুমকা জেলার সাঁওতালদের এলেকা থেকে সাঁওতাল মেয়ে-মরদ আসত কাজের লেগে। বর্ষাকালে ধান রোয়া হয়ে গেলে কিম্বা জাড়কালে ধানকাটা শেষ হলে এরা আবার সব নিজের নিজের জায়গায় ফিরে যেত। কত্তার ভাইরা চাষবাসের কাজ দেখাশোনা করত বটে কিন্তুক হাতে মাটি লাগাত না কেউই। একমাত্তর আমার সেজ দাওর নিজের হাতে কিছু কিছু কাজ করত। কিন্তু কত্তাকে তেমন কেউ দেখতেই পেত না। তবু এত বড় যজ্ঞি সে-ই সামলাত। সারা দিন সে বাড়িতে না থাকলেও গাঁয়েই পেরায় থাকত। স্কুল ছিল, কত্তামার বাড়ি ছিল। শহরেও যেত মাঝে মাঝে। শহরে গেলে ধোপ-দোরস্ত জামাকাপড় পরে ভোরবেলায় বেরিয়ে যেত, ফিরত রেতে। জামা-কাপড় আর কি–এই ধুতি আর শাট, কখনো কখনো পিরেন, শীতকালে কাশ্মীরি শাল–ইসবই পরত। কিন্তুক যেখানেই যাক, রেতে ফেরা চাই। চেরকাল এই দেখে অ্যালম, রাত কখনো বাইরে কাটাত না। মেঘঝড়বিষ্টি কোনো কিছুই মানামানি নাই, শতেক বেপদ ঘাড়ে নিয়ে হলেও বাড়ি ফিরবে। এক কোশ দূরে র্যাল ইস্টিশন। সিখানে যাবার পথঘাট নাই বললেই চলে। মাঝে মাঝে ধানের জমির আলপথ ধরে কিম্বা ডাঙামির বনবাদাড় ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হতো। চারদিক সাপ-খোপে ভরা। গরমকালে ভায়ানক ধুলো আর বর্ষাকালে বেপজ্জয় কাদা। এরই মধ্যে সে যাতায়াত করত। বোধায় অত কষ্ট পেয়েছিল বলেই আর ক-বছর বাদে সোন্দর সড়ক করিয়েছিল গরমেন্টকে দিয়ে। দশ গাঁয়ের যোগাযোগ হয়েছিল র্যাল ইস্টিশনের সাথে।
আমরা আর কি বুঝব? কিন্তুক বড় বড় মানুষ আর বড় বড় শহরের সাথে কত্তার যি যোগাযোগ হচে তা যেন একটু একটু বুঝতে পারতম। তা না হলে অত শহরে যেত ক্যানে? বাড়িতেও দেখি অচেনা-অজানা লোজন আসার কামাই নাই। আমাদের মতুন মেয়েমানুষদের অজানা-অচেনা তো হবেই, কত্তাই মাঝে মাঝে বলত, অ্যামন লোকও য্যাকন-ত্যাকন বাড়িতে আসে কত্তা যাদের চেনে না। আত্মীয়-কুটুম ছাড়া গাঁয়ে-ঘরে কার বাড়িতে আবার কটো অচেনা লোক আসে? তাইলে ই বাড়িতে এত লোক আসবে ক্যানে? ভয়ে আমার বুক দুরদুর করে–কি জানি এত বেগানা লোক ক্যানে আসে বাড়িতে!
ল্যাখাপড়া এট্টু এট্টু য্যাকন শিখছি, ত্যাকন কত্তা একদিন বলেছিল ই দ্যাশ পরাধীন। উ কথার মানে ত্যাকন কিছুই বুঝি নাই। কত্তাকে শুদিয়ে জেনেছেলম যি, ই দ্যাশ মাহারানীর রাজত্ব। দ্যাড়শো বছর ধরে ই দ্যাশ পরাধীন। তার মদ্যে তিন কুড়ি বছর ই দ্যাশ শাসন করেছে এই মাহারানী। সেই রানী মরেচে পেরায় বিশ বছর হলো। অ্যাকন তার ছেলে রাজা। কি আচ্চয্যি, কোথাকার কোন্ দ্যাশের লোক রাজা-রানী হয়ে ই দ্যাশ শাসন করছে!
ইসব কথার কিছুই বুঝতে পারতম না। রানী শাসন করছে, না রাজা শাসন করছে, চোখে দেখতেও পেচি না, কানে শুনতেও পেচি–শাসন করছে তা আমার কি? আমার বিয়ের সোমায় শুনেছেলম একটো যুদ্ধ হচে সারা দুনিয়া জুড়ে। সি তো শোনা কথা, যুদ্ধ কিছু দেখি নাই। তা আজকাল দেখি কত্তা বলছে, সারা দুনিয়ার এই যুদ্ধ জিতে রাজা লিকিনি মুসলিম জাহানের খলিফা যি দ্যাশে থাকে সি দ্যাশ থেকে তাকে তাড়িয়ে দেবে।
কত্তার কথা তেমন বুঝতে না পারলেও কেমন ভয় ভয় করতে লাগল আমার। এইসব লেগেই কি বাড়িতে অত অচেনা-অজানা মানুষ আসছে? এই লেগেই কি কত্তা পেরায় পেত্যেকদিন শহর-গঞ্জে যেচে?
ইদিকে বাড়িতে সুখের অন্ত নাই। দুধ ঘি মাখন মাছ গোশতো তরি-তরকারি চাল-ডালে ভেসে যেচে বাড়ি। দিনদিন লোক বাড়ছে। মুনিষ-জন, বছর-কাবারি মাহিন্দারে বাড়ি ভরা। কত্তা আজকাল পেরায়ই বাড়ির ভেতরে মা-বুনের কাছে আসে এটো-ওটো কথা বলার লেগে। কুনোদিন এসে বলে, মা, তুমি জানো বাপজির তাজি ঘোড়া ছিল, নিজের ছয়-বেহারা পালকি ছিল, বাউরি-পাড়ায় সোমবচ্ছরের জন্যে বেহারাদের ঘর ঠিক করা ছিল। সেসব কোনদিকে কি হয়ে গিয়েছে। পরচালির খুঁটিতে ঘোড়ার পুরনো জিনটা দেখি আর ভাবি, সব আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। পালকি আবার নতুন করে তৈরি হবে। গিগাঁয়ের ছুতোরমিস্ত্রিরা দুদিন বাদে আসবে। পুরনো পালকিটা নতুন করে ফেলব। নতুন ছাউনি হবে, নতুন ভঁপ, নতুন রঙ হবে। আর ঐ সঙ্গে গরুর গাড়ির নতুন একটি বড় টপ্পরও করিয়ে নেব।
ঘরের কাজ করতে করতে আড়চোখে চেয়ে দেখি, শাশুড়ির মুখে বড্ড খুশি। মুক্তোর মতুন জিরি জিরি শাদা দাঁত দেখা যেছে কি যেছে না। ছেলের লেগে শতেক দোয়া যেন ঝরে পড়ছে চাউনি থেকে। শাশুড়ি বলছে, সে তো ভালো কথা বাবা। আমি জানি, তুমি আবার সব করবে।
হ্যাঁ, সব আমার নতুন করে হলো। লতুন পালকি হলো, গরুর গাড়ির লতুন ছই হলো। বাইরে কাজ হতো, কাঠের গন্ধ, বাঁশের গন্ধ, রঙের গন্ধ বাড়ির ভেতরেও প্যাতম। কাঠ চাচা, বাঁশ চ্যাঁচা, বেত চাচার শব্দও কানে আসত। সব তৈরি হয়ে গেলে একদিন সিসব দেখেও অ্যালম।