ঠিকই তাই, কদিন বাদেই শোনলম, ছোট রায় তাদের বেরাট বাড়িটো ভেঙে সেগুনকাঠের কড়ি-বরগা, নোকশা-করা কাঠের সাজ আর আর যা কিছু আছে নকড়ায়-ছকড়ায় বিকিয়ে দিচে। সব ঘর ভেঙে দিয়ে একপাশে মাত্তর একটি ঘর রেখে সেখানে বাস করবে, এগনের এক কোণে রান্নার লেগে বানিয়ে নেবে একটো ছোট চালাঘর। যাকগো, ই বাড়ি থেকে রায়েদের বাড়ির আর একটিও জিনিশ কেনা হলো না।
০৭. সোয়ামি সোংসার নিয়ে আমার খুব গরব হলো
যে শাশুড়িকে যমের মতুন ভয় করতম, মুখের দিকে তাকাইতে পয্যন্ত সাহস করতম না, সেই শাশুড়ি একদিন বৈকালবেলায় আমাকে তার ঘরে ডাকলে। খোঁকা ত্যাকন খানিকটো ডাগর হয়েছে, সে-ও সেই সোমায় আমার কাছে ছিল। ঘরে যেয়ে দাঁড়াইতেই শাশুড়ি আমার কাছে এসে বললে, মেতর-বউ, আমি একটা কথা বলি। এই বাড়ির লক্ষ্মী তুমি, তোমার পয়েই সবকিছু আবার হবে। তোমার শ্বশুরের মিত্যুর পর সোংসার ভেসে যেছিল, ছেলেমেয়ে নিয়ে অগাধ পানিতে পড়েছেলম। আমার ঐ মেজ ছেলে সব আবার ফিরিয়ে আনলে। সেই ছেলের বউ তুমি। আমি সব জানি, গায়ের গয়না খুলে দিয়েছ তুমি। আল্লা তোমার ভালো করবে। দোয়া করি তোমাকে। দ্যাওর, ননদ, জা সবাইকে তুমি দেখো। চিরকাল ওরা তোমাকে ভক্তি করবে, মেনে চলবে, আমি জানি। তোমার এই খোঁকা আমার বংশের মানিক। ওর হায়াত দরাজ হোক, এই দোয়া করি আমি–এই বলে শাশুড়ি আমার মাথার ওপর হাত রাখলে।
ঐ একবারই অমনি করে কথা বলেছিল আমার শাশুড়ি, আর কুনোদিন লয়। এমনিতে কথা পেরায় বলতই না। পাতলা পাতলা দুটি ঠোঁট চেপে থাকত, আমাদের সাথে য্যাকন কথা বলত কি কাঠ কাঠ যি লাগত! তা সি যাকগো, সেই থেকে আমি জানি, সব সোমায় নিজের নিজের করলে কিছুই আর নিজের থাকে না।
সোংসারের আয়-বরকত বেড়ে গেল। কত্ত একদিন তার মাকে হিশেব করে বুঝিয়ে দিলে যে চাষের জমি সব মিলে এক-শো বিঘে না হলেও আশি-নব্বই বিঘে হয়েছে। আউশ জমি কুড়ি-পঁচিশ বিঘে, তা থেকে আউশ ধান কিছু তো পাওয়া যাবেই, তা-বাদে সোমবচ্ছরের যব, গম, আলু, পেঁয়াজ, তিল, সরষে যা যা সংসারের দরকার তার সবই পাওয়া যাবে। জমিতে আখ লাগিয়ে চোত মাসে শাল করে যা গুড় পাওয়া যাবে, তাতে সোংসারের পেয়োজন মিটিয়ে অ্যানেকটো বেচাও যাবে। ডাল যা লাগছে, মুগ মুশুরি মাস মটর ছোলা আইরি সব ডালই সারা বছরের লেগে হবে। খোঁরো ডিঙিলি পটল ইসব তরিতরকারিও করা যাবে। আর সত্তর-আশি বিঘে জমির আমন ধানে বছরখোরাকি তো হবেই, সোংসারের দরকারে ধান কিছু বিক্রিও করা যাবে।
চার-পাঁচটো নাঙলের লেগে কেনা হলো আট-দশটো মোষ। এই এলেকার মাটি ভালো লয়, এঁটেল মাটি, ইদিকে গরুর নাঙল চলে না। এই বড় বড় চ্যাঙর ওঠে জমিতে, সি চ্যাঙর ভোলা গরুর কম্ম লয়। হাতি হাতি মোষ দরকার। মোষের নাঙলে-তোলা ঐসব চ্যাঙর আবার টানা দিয়ে ভাঙতে হয়।
চাষের লেগে একটা-দুটো করে আট-দশটো মোষ কেনা হলো। সেই সাথে গরু-বাছুরও বাড়তে লাগল। বাড়িতে এত লোক, ছোট ছেলে বলতে অবিশ্যি আমার খোঁকা, গরুর দুধ তো কম লাগে না। তাই গাই-গরু অ্যানেকগুলিন হলো। তাদের আবার এঁড়ে বকনা বাছুর যি কতো! সব নিয়ে গোয়াল ভত্তি। পেতলের বড় বড় বালতিতে দুধ আনা হয় দু-বেলা। বড় বড় লোহার কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয় সেই দুধ। তাপর বাড়িতে পেঁয়াজের বড় পাহাড় হয়, রাখার জায়গা নাই। বাড়তি পেঁয়াজ বেচেও কুনো লাভ নাই। দু-পয়সা চার পয়সা সের। নেবেই বা কে? পাঁচ কামরার কোঠাঘরের একটো ঘরের মেজেয় পেঁয়াজ রাখা হয়েছে। সব পচে বাড়ি একদম দুর্গন্ধে ভরে গেল। শুধু পেঁয়াজ কানে, গুড়ের আবস্তাও তাই। খানা রাঁধার বিরাট তামার হাঁড়িতে গুড় রাখা হয়েছে। ঘরে রাখার জায়গা নাই, পিঁড়ের এক কোণে রাখা হয়েছে, ঢাকনা পয্যন্ত নাই। একদিন সবাই দ্যাখে, এই বড় একজোড়া ইদুর মরে তার মদ্যে পড়ে রয়েছে, মাগো কি ঘিন্না! সেই গুড় ফেলে দিলে গুড়ের ঢল বয়ে গেল গোটা এনে জুড়ে। একেই বলে উপছে-পড়া সোংসার। ধান নিয়েও কুনো কুনোবার মুশকিল হতো। অত বড় খামার এক-একটো একশো-দ্যাড়শো মণ ধানের মরাই–একটা-দুটো তো লয়, আট-দশটো সারা খামার জুড়ে, ছেলেপুলেরা লুকোচুরি খেলতে পারত–তা এক-এক বছর সেই খামারেও খ্যাড়ের পালুই আর মরাই করার জায়গা থাকত না। এইসব কথা অ্যাকনকার লোকের পেত্যয় হবে না কিন্তুক ইসবই আমি নিজের চোখে দেখেছি।
বাড়িতে ইদিকে মানুষ বেড়েই যেচে, বেড়েই যেচে। কাজের মানুষ আলেদা পাওয়া যেত না। গরিব পাড়া-পড়শি, ভাই-ভায়াদ, আত্মীয়, বেধবা কিম্বা গরিব বউরা বাড়িতে এসে থাকত, এটো ওটো করত, দুটো খেতে পেত। গামছা দিয়ে ঢেকে বাড়িতে ভাত-তরকারি নিয়েও যেত। কিন্তুক কেউ রেতে থাকত না। গরু মোষ মাঠে নিয়ে যাওয়া, চরানো, আবার বাড়িতে আনার লেগে সোমবচ্ছরের রাখাল রাখা হতো, মাহিন্দার থাকত দুজন। এই সবাই কিন্তুক ঘরের লোক মতুন, তবে রেতে নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে যায়। বাড়িতে কেউ থাকে না।
এমনি অ্যাকটো পরিবার একবার এল ভিন গাঁ থেকে। বাপটো কুটে, একগাদা ছেলেমেয়ে নিয়ে মা হিমশিম খেছে। কত্তা খামারের পাশে ছোট খামারে ঘর বাঁধার লেগে তাদের জায়গা দিলে। কুটে বাপটো, কৃঞ্চি-কাবারি দিয়ে চালের ওপরে খ্যাড় চাপিয়ে ঘর একটো বানাইলে বটে, তা কাকেও তার চাইতে ভালো বাসা বানায়। সেই ঘরে সবারই জায়গা হলো। বড় ছেলেটো হলো মাহিন্দার, ছোটটোসে একদম ছোট–সে হলো রাখাল। বাপ ঘরের ভেতর দিনরাত শুয়ে থাকে, তামুক খায় আর কাশে। তিন-চারটো মেয়ে নিয়ে মা মাঠেঘাটে চরে বেড়ায়। তা বলে কেউ উপোস থাকত না, দুটো ভাত সবারই জুটত। তিন মেয়ের নোম্বা নোম্বা চুল, কুনোদিন ত্যাল পড়ে নাই তাতে, কটা শণের মতুন রং। বৈকালবেলা মা-টো এই তিন মেয়ের চুলের উকুন বাছতে বসত আর তারা নড়লেই পিঠে মারত গুম গুম করে কিল। খেতে পেলে তবেই না এমন করে উকুন বাছা!