কত্তার কথা শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এল। এত নিষ্ঠুর, হায়রে এত কঠিন জান আমার সোয়ামির? কলজেটা ছিড়ে নিলেও তো এত কষ্ট হতো না। মেয়েমানুষের গয়না ছাড়া আর কি আছে! স্বামী চলে গেলেও গয়না থাকবে। আমার সেই গয়না আকন সব কেড়ে নেবে? চোখ-ভরা পানি নিয়ে কত্তার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে গ্যালম, ঝাপসায় কিছুই দেখতে প্যালম না। তবে আমি এই ভবসংসারে কার ঠেয়ে যেয়ে দাঁড়াব? শুনতে প্যালম কত্তা বলছে, কেঁদো না। তুমি না দিলে গয়না আমি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেব না। তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি মেয়েমানুষের কাছে গয়না কি! সন্তান গেলেও তারা গয়না ছাড়বে না।
কত্তার এই শেষ কথাটো যেন আগুনের ছ্যাকা দিয়ে আমার কলজেটো পুড়িয়ে দিলে। ই কি কথা, ই কি কথা, হায় হায়! চোখের পানি ত্যাকন ত্যাকনই শুকিয়ে গেল। একবার ঘুমনো ছেলের দিকে তাকালম, বালাইষাট, আমি হাজারবার লাখবার মরি তোর জানের লেগে! একবার কত্তার দিকে তাকালম। হেরিকেনের আলোয় অ্যাকন তার মুখটো দেখতে পেছি। দেখি কি, সি মুখে এটুও রাগরোষ নাই। আমার দিকে চেয়ে রয়েছে যে চোখদুটি তাতে কি যে ভরসা! তাই বটে, তাই বটে, মেয়েমানুষ এইরকমই বটে, নিরুপায়। আমি বললম, গয়না সব নিয়ে যাও। আমি মন খোলসা করে বলছি একটি গয়নাও আমি রাখতে চাই না।
না না, মোটা কঙ্কণ দুটো রেখে দাও। নিজে না পরো, ছেলের যখন বউ হবে; তাকে দিয়ে দিয়ো।
সেই রেতেই একটি একটি করে সমস্ত গয়নাগাঁটি পুঁটলিতে বেঁধে কত্তার হাতে তুলে দেলম। কদিন বাদেই জানতে পারলম, রায়েদের কাছ থেকে তিরিশ বিঘে জমি নিলেমে কেনা হয়েছে। কত্তা টাকা কি করে জোগাড় করেছিল সি আমি জানি না–গয়না বিক্রি করেছিল,
বন্দুক রেখেছিল তা আর কুনোদিন শুদুই নাই তাকে। এমন মানুষ, যিদিন নিলেমে জমি পাওয়া গেল, সিদিন বাড়িতে ঢুকে পেথম মাকেই ডেকে বললে,, সংসারের আরও তিরিশ বিঘে জমি হলো।
এই পেথম দেখলম আমার শাশুড়ি এগিয়ে যেয়ে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললে, চিরজীবী হও বাবা, আল্লা তোমার হায়াত দরাজ করুক। এই বলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলে। অথচ রেতে য্যাকন ঘরে গ্যালম কত্তা শুধু বললে, শুনেছ তো, নিলাম ডাকা হয়ে গিয়েছে?
হিসেব করে ত্যাকন দেখলম দাদির ঠেয়ে পাওয়া আমার যোলো বিঘে জমি, শ্বশুরের জমি, আর এই নিলেমের জমি একাই করলে পেরায় আশি-নব্বই বিঘে জমি সংসারের হয়েছে। গাঁয়ে এত জমি আর কারও নাই। সবারই সাধারণ অবস্তা। মোসলমানপাড়ায় দশ-পনেরো বিঘের বেশি জমি কারুর নাই। হিঁদুপাড়াতেও তাই, খুব বেশি হলে দু-চারজনার চল্লিশ-পঞ্চাশ বা ষাট বিঘে। মহারাজার যে দুটি আত্মীয় ই গাঁয়ে আছে, তাদের জমি এট্টু বেশি বটে, তবু ষাট-সত্তর বিঘের বেশি হবে না। ইসব কথা কত্তার কাছেই শোনা। মন হলে কখনো কখনো ইসব কথা বলত।
কত্তাকে সারা জেবনে কুনোদিন নেশা করতে দেখি নাই। শখ করে কুনো সোমায় পান খেতে দেখেছি। তেমন সময়ে ফরসি হুঁকো টানতেও দেখেছি। খেত না, খেত না, য্যাকন খেত, ত্যাকন খুব আয়েশ করেই খেত। দামি অম্বুরি তামুক আনাত, পানের লেগে কিমাম কিনত। দেখে মনে হতো, এই বুঝি কত্তা পান ধরলে কিম্বা তামুক ধরলে। কিন্তুক এসব দু-মাস তিন মাস। তাপর তামুক হঠাৎ ছেড়ে দিলে, ফরসি হুঁকোটোও কোথা পড়ে থাকল। এমনি আজব মানুষ! তবে ইকথা বলব, য্যাকন পান ধরত কিম্বা হুঁকো খেত, মেজাজটো খুব শরিফ থাকত। কথা যা ঐরকম সোমায়েই বলত বেশি।
রায়েদের জমি যি কত্ত নিলেমে কিনে নিয়েছিল, তাতে আমার মনটো খুব খচখচ করত। মাঝে মাঝে মনে হত কত্তাও বোধায় এই নিয়ে আমাকে দুটো কথা বলতে চায়। কাজটো সে করেছে বটে, কিন্তু সি যেন নেহাত বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে বলেই করেছে। কথাটো এই যি জমি কি রায়েদের থাকত আমরা নিলেম না ডাকলে? কত্তা একদিন এমন করে রায়েদের কথা বললে তাতে মনে হলো যেন কেচ্ছা শুনছি। ফরসি টানতে টানতে শুরু করলে, এ গাঁয়ে মিদার যদি কেউ থাকে, তাহলে সে রায়েরা। এরা উঁচু বংশ, বামুন বংশ। গাঁয়ের আদ্দেকটার মালিক ছিল ওরাই। যেমন উঁচু মন, তেমনিই বেহিসাবি খরুচে। খাওয়া-পরায় সবই উড়িয়ে দিত। কিন্তু এদের কেউই মেজাজি ছিল না। সবাই বড় ঠান্ডা মানুষ। যে যা চাইত, ধরে বসত, দিয়ে দিত। এই করতে করতে সব শেষ করে দিলে। ছেলেপুলেরা কেউ গাঁ ছাড়লে না, লেখাপড়া শিখলে না, চোখের সামনে দেখলাম পঁচিশত্রিশ বছরের মধ্যে সব শেষ করে দিয়ে ফতুর হয়ে গেল। জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর অনেকেই এখন গা ছেড়ে চলে গিয়েছে, ছেলেদের কেউ কেউ কলকাতা-টলকাতা গিয়ে বাড়ির চাকর বা রাঁধুনি-বামুনের কাজ করছে। ভিটেমাটি পড়ে আছে, সাপ-খোপ বাসা করেছে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পাকা বাড়ি-ঘর, পুজোর মন্দির। ছাদ ফাটিয়ে বট-পাকুড় গাছ উঠেছে। বেনা ঘাস, গোয়াল-লতা, কন্টিকারির জঙ্গলে কাছে যাবার উপায় নাই। এই তো অবস্থা! দেখবে আর দুদিন বাদে ছোট রায় ঝুলি হাতে ভিক্ষে করতে বেরুবে। জমিগুলি আমি কিনলাম, খুবই খারাপ লাগে বটে তবে নিয়তি ঢুকেছে বংশে। মানুষের সংসারে নিয়মই এই, উঠতে উঠতে আকাশে ঠেকবে মাথা, তারপরে পড়তে পড়তে একদিন মাটিতেই আশ্রয়। এ হবেই–সব বংশেই হয়। নিয়তির পথ কেউ বন্ধ করতে পারবে না।
আস্তে আস্তে ফরসি টানতে টানতে ইসব কথা একদিন কত্তা বলেছিল আমাকে। কথা বলতে পারত বটে মানুষটো, অমন আর কোথাও শুনি নাই। ইসব কথা চেরকালের লেগে মাথার ভেতরে ঢুকে গেল : দেখো, কদিনের মধ্যেই জমির টাকা খেয়ে ফুরিয়ে দেবে রায়েদের ছোট তরফ, বড় বড় আইবুড়ো মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত হবে না।