কেমন করে সোংসারের উন্নতি-বরকতের অরম্বটো হলো সি কথাটা ইবার বলছি। আমার বিয়ের সোমায় বাপজি গয়নাগাঁটি যা দেবার তা দিয়েছিল। ত্যাকুনি জানা গেয়েছিল আমার সেই দাদিবাপজির খালা–মরবার আগে আমার নামে তার সব জমি–যোলে বিঘে জমি লিখে দিয়ে গেয়েছিল। দাদির তিন কুলে কেউ ছিল। সি কথা আগে বলেছি, সেই লেগে সম্পত্তিটো নিয়ে কুনে। হ্যাঙ্গামা-ফৈজত হয় নাই। বিয়ের পরে-পরেই ঐ সম্পত্তিটো বিক্রি করে দিয়ে কত্তা নিজেদের গাঁয়ের মাঠে পঁচিশ বিঘে জমি কিনলে। আমার নামে কিনেছিল, না সোংসারের সাজার করে দিয়েছিল ঐ জমি, আমি আজও জানি না। সবই তো শাশুড়ির সোংসারের–আমার তোমার কি? এই ছিল শিক্ষে। গোড়াতেই জেনে গেয়েছেলম কত্তার ছামনে কুনো জিনিস নিয়ে আমার আমার করা যাবে না। একবার কি একটো নিয়ে এইরকম আমার আমার করে কথা বলতে যেতে দেখেছেলম, কত্তা একদিষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। মনে হলো, ই মানুষ আমাকে চেনে না, এখুনি হাত ধরে ঘর থেকে বার করে দেবে। সেই আমার চেরকালের লেগে শিক্ষে হয়ে গেল।
বারে বারে কত্তা কত্তা করছি, তা বলে কেউ যেন না মনে করে যি কত্তা বি.এ. এম.এ. পাশ দিয়েছিল। আমার শ্বশুর লিকিনি খুব ল্যাখাপড়া-জানা আলেম মানুষ ছিল। কিন্তুক কত্তা কোথা থেকে কি শিখেছিল আমি জানি না। আমাকে কুনোদিন বলে নাই। ক-বছর। লিকিনি বাড়ি ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেয়েছিল, নদী পেরিয়ে পুবের কুন গাঁয়ে কুন এক পীরবাবার কাছে ফারসি পড়ত। এই গপ্পো অ্যানেকবার শুনেছি। তবে সিসব ডানপিটেমির গপ্পো, ল্যাখাপড়ার কথা নয়। যা-ই হোক, আমার খালি মনে হতো, এই মানুষ জানে না এমন কিছু কি ভূভারতে আছে? এই সোমায় সে গাঁয়ের ইশকুলে ছেলে পড়াইত। সেটো চাকরি ছিল কি না জানি না, পড়াইত এই জানি আর কত্তামার ছোট ছোট ছেলেটিকে লিয়ম ধরে পড়তে বসাইত।
একদিন দেখি বাড়ির ভেতরে এসে মায়ের সঙ্গে কি নিয়ে কথা বলচে। এমনিতে কিছুতেই বাড়ির ভেতরে ঢুকত না, থাকত তো বাইরের একটো ঘরে। বাড়ির ভেতরে এলে বুঝতে হতো গুরুতর কুনো কথা আছে। তা মায়ের সাথে কথা বলছে, আমাদের কারুর কাছে যাবার হুকুম নাই। দূর থেকে দেখছি, ছেলে কিসব বলচে আর মা খালি ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলচে, না বাবা, তা হয় না। তা কোরো না। কি যি কথা হলো কিছুই বোঝলম না। বোঝলম রেতে। হেঁশেলের। কাজকম্ম সেরে শেকল তুলে বাইরের ঘরে য্যান অ্যালম, কত্তা দেখলম ত্যাকননা বিছেনায় শোয় নাই। বসে আছে। খোঁকা তার। বিছেনায় অসানে ঘুমুইছে। খুব ঘেমেছে দেখছি গলার কাছটোয় ভিজে গেয়েছে। ঠান্ডা লাগবে না কি হবে–আঁচল দিয়ে ঘামটো মুছিয়ে দিচি ত্যাকন কত্তা বললে, শোনো, কথা আছে। গলার স্বর খুব মোলায়েম। কথা কত্তা এমন করে তো বলে না। এট্টু অবাক হয়ে কাছে যেয়ে বসলম। কত্তা বললে, জীবনে সুযোগ দুর্যোগ দুই-ই আছে। সব সময় সুযোগ আসে না, আর সুযোগ আসে যেমন আচমকা, তেমনি চলেও যায় আচমকা। তা একটা সুযোগ এসেছে। পঁচিশ-তিরিশ বিঘে। জমি একলাটে আছে। কদিন বাদে সেটা নিলাম হবে। রায়েদের জমি।
রায়েরা আবার কারা?
রায়েরা এ গাঁয়ের জমিদার। ওদের রবরবা আমাদের ছেলেবেলায় একআধটু দেখেছি, তবে আমাদের বাপচাচারা আরও ভালো জানত। এখন অবস্থা খুব পড়ে এসেছে। খেতে জোটে না। তাদেরই পঁচিশ-তিরিশ বিঘে জমি নিলাম হবে–ন-কড়ায় ছ-কড়ায় বিকিয়ে যাবে।
তা উ নিয়ে আমাদের কি ভাবনা? আমরা কি উদের কুনো উবগারে লাগব?
কথা শোনো, আমাদের এত বড় সোংসার, টেনে চলা খুব কঠিন। বাপজি তো সব প্রায় শেষ করে দিয়ে চলে গিয়েছে। নিলামটা ধরতে পারলে কাজ হয়। রায়েদের জন্যে খারাপ লাগছে খুব, হাতি খাদে পড়েছে। মানুষের দুর্দিনের সুযোগ নিতে নাই আমি জানি কিন্তু রায়েরা কিছুতেই এ জমি রক্ষা করতে পারবে না। আমি না নিলে আর কেউ নেবে।
কথা কটি বলে কত্তা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে। আমি তো অবাক–জমি নিতে হলে নাও গা— আমাকে শুদুবার কি আছে? আমি সঙ্গে সঙ্গে বললম, ই তো খুব ভালো কথা, নিলেম ডেকে নিতে পারলে সোংসারের লেগে খুব ভালো হয়। আমাকে আবার ই কথা শুদুইছ ক্যানে?
নিলাম তো আর খালি হাতে ডাকা যায় না? টাকা লাগবে না? অত টাকা কোথা থেকে পাব? কাঁচা টাকা আমার হাতে নাই। সংসারে কারও কাছে একটি পয়সা নাই। পয়সাকড়ি যা থাকে আমার কাছেই থাকে। খোরাকির বাইরে ধান যা আছে তা বিক্রি করে আর কতো টাকা পাওয়া যাবে? বলে কত্তা আবার আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলে। আমি ফের অবাক, টাকাপয়সার কথা আমার কাছে ক্যানে? উ বিষয়ে তো আমি কিছুই জানি না। আমিও কত্তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকলম।
টাকার কথা আমি কি বলব?
আমার এই কথার পরে কত্তা এতক্ষণ বাদে আসল কথাটি বললে, দ্যাখো, গয়না তুমি অনেক পেয়েছ, বাপের বাড়ি থেকে পেয়েছ, কত্তামার কাছ থেকেও পেয়েছ। কি হবে গয়না নিয়ে? কবার পরবে ঐ ভারী গয়না? একটু বয়েস হলে হয়তো আর কোনোদিন পরবে না। ঐ ওজনের লোহা বাড়িতে লুকিয়ে রেখে দিয়ে ভাবলেই হলো গয়না সবই আছে? একই কথা হলো না?
কথা শুনে আমি বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে আছি।
দু-একটা পরার মতো গয়না রেখে দিয়ে সংসারের এমন একটা কাজে বাকি গয়নাগুলো দিয়ে দিলে কি হবে তোমার? সবাই জানবে সংসার গড়ে তুলতে কোন্ এক পরের বাড়ির মেয়ে এই মেজ বউ-ই এত বড় কাজ করেছে!