রজনী প্রভাতে ঈসা খাঁ বেহারা ঠিক করিয়া স্বর্ণময়ীকে সাদুল্লাপুরে পাঠাইয়া দিলেন। তৎপর রজনী ভট্রাচার্যের ছেলে ও মেয়েকে ডাকিয়া প্রত্যেকের হস্তে জলপান খাইবার জন্য ১০টি করিয়া মোহর প্রদান করিয়া অশ্বারোহণে মুরাদপুরের দিকে দ্রুত ধাবিত হইলেন। স্বর্ণময়ী পাল্কীর দরজার ফাঁকের মধ্য দিয়ে যতদূর দৃষ্টি চলিল, ততদূর পর্যন্ত তাহার প্রাণের আরাধ্য মনোমোহন-দেবতার ভুবনোজ্জ্বল অশ্বারূঢ় মূর্তি অনিমেষ দৃষ্টিতে সমস্ত প্রাণের পিপাসার সহিত দেখিতে লাগিল। স্বর্ণ দেখিল, যেন কোন অপূর্ব সুন্দর স্বর্গীয় দেবতা তাহার হৃদয়-মন চুরি করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছেন। তাঁহার গমন-পথের উপরিস্থ আকাশ, নিম্নস্থ ধরণী এবং দুই পার্শ্বের শ্যালল-তরুলতা যেন আনন্দে পুলকিত হইয়া উঠিতেছে। চারিদিকে যেন আলোকের তরঙ্গ উঠিতেছে। স্বর্ণময়ী দেখিল সত্য সত্যই তাহার প্রিয়তম-সুন্দরতম এবং জগদ্বিমোহন। তারপর যখন ঈসা খাঁ দূর পল্লীর তরুবল্লী-রেখার অন্তরালে মিশাইয়া গেলেন, তখন সুন্দরী বুকভাঙ্গা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া দৃষ্টি প্রত্যাহার করিল। হৃদয় উচ্ছ্বসিত নদীর ন্যায় ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে দুই বিন্দু অশ্রু অজ্ঞাতসারে বরে কাঁচলীতে পতিত হইল। যুবতী তাড়াতাড়ি পাল্কীর দরজা বন্ধ করিয়া পাল্কীর ভিতরে শুইয়া পড়িল। বাহিরের দৃশ্য দেখিবার আর ইচ্ছা হইল না। বেহারারা পাল্কী লইয়া দুই দিকের বিস্তৃত শ্যামায়মান ধান্যক্ষেত্রর মধ্যবতী রাস্তা দিয়া সাদুল্লাপুরের দিকে ছুটিয়া চলিল।
০৩.রায়-নন্দিনী – তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ মাতুলালয়ে
ঈসা খাঁ মস্নদ-ই-আলী শ্রীমতী স্বর্ণময়ীকে সাদুল্লাপুর রওয়ানা করিয়া দিয়া মুরাদপুরের দিকে অগ্রসর হইলেন। সাদুল্লাপুরে জগদানন্দ মিত্র, স্বর্ণময়ীর মাতামহ। তিনি একজন প্রাচীন জমিদার। তাঁহার বয়স প্রায় নব্ব্যই পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু এখনও বৃদ্ধ বিনা চশমায় প্রদীপের আলোতে কাশীরাম দাসের মহাভারত অনায়াসে পড়িতে পারেন। লোকটির বেশ হাসিখুসী মেজাজ। আজকাল প্রায় ঠাকুর পূজা এবং ছিপে করিয়া পুকুরের মাছ ধরাতেই দিন কাটে।
তাঁহার দুই বয়স্ক পুত্র, বরদাকান্ত ও প্রমদাকান্ত। তাহাদের দুইজনের ঘরেও সাতটি মেয়ে ও পাঁচটি ছেলে জন্মিয়াছে। বরদাকান্তের জ্যেষ্ঠপুত্র হেমকান্ত, তাহার এক পিসীর সহিত কাশীতে বাস করে। তদ্ব্যতীত আর সকলেই বাড়ীতে। সুতরাং বাড়ীখানি ছেলেমেয়ের কোলাহলে এবং অট্রহাসিতে বেশ গোলজার। স্বর্ণ এখানে আসিয়া পরম যত্নে ও আনন্দের মধ্যে দিন কাটাইতে লাগিল। তাহার মামা ও মামীদের আদরে ও ভালবাসায়, মাতামহ এবং মাতামহীর স্নেহ ও যত্নে বাহিরে সুখানুভব করিলেও প্রাণের ভিতরে কি এক অতৃপ্তি ও শূন্যতা বোধ দিন দিন তীব্র হইতে তীব্রতর হইয়া উঠিতেছিল। ঈসা খাঁর কথা এক মুহূর্তেও ভুলিতে পারিত না। ঈসা খাঁর বীর্য-তেজঃ-ঝলসিত বীরবপু ও অনিন্দ্য-সুন্দর মুখমন্ডল, তাঁহার সেই মধুবর্ষিণী অথচ সুস্পষ্ট গম্ভীর ভাষা এক মুহূর্তের জন্য ভুলিতে পারিল না। ঈসা খাঁর সুন্দর-কমনীয় বীরমূর্তী তাহার হৃদয়ে এমন করিয়া আসন পরিগ্রহ করিয়াছে যে, যুবতীর চিন্তা ও কল্পনা, হৃদয় ও মন ঈসা খাঁ-ময় হইয়া গেল। দেখিল, ভুলিতে বসিলে স্মৃতি আরও দ্বিগুণ ত্রিগুণ জাগিয়া উঠে। হৃদয়ে যখন প্রেমাশ্নি জ্বলিয়া উঠে তখন উহাতে বাধা দিতে গেলে শিলা-প্রতিহত নদীর ন্যায় ভীষণ উচ্ছ্বসিত হইয়া দুই কুল প্লাবিত করিয়া ফেলে। পূর্বের লজ্জা ও সঙ্কোচ একেবারে উড়িয়া যায়। স্বর্ণ যখন বালক-বালিকার মধ্যে বসিয়া নানা প্রকারে তাহাদের আনন্দ বিধান এবং তাহাদের ক্ষণিক কলহের বিচার করিতে বসে, তখন তাহার মানসিক অধীরতা কিছু চাপা পড়ে বটে, কিন্তু আবার একেলাটি বসিলেই প্রাণের আকুলতা দশগুণ বৃদ্ধি পায়। বর্ষার ভরা নদীর মত তাহার মন কি যেন এক চৌম্বক-আকর্ষণে ফাঁপিয়া ফুলিয়া উঠে। হৃদয়ের পরতে পরতে, শরীরের প্রতি অণুপরমাণুতে কি যেন এক পিপাসার তীব্রতা হইতে স্বর্ণময়ী বুঝিতে পারিল, যৌবন কাল কি ভয়ানক, প্রেমের আকর্ষণ কি ভয়ঙ্কর বেগশালী! উহা এক মুহূর্তের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়া সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ভুলাইয়া প্রেমাস্পদের পদে আত্ম বিকাইয়া বসে। প্রেমাস্পদের মধ্যে তখন তাহার জীবনের আশা ও নির্ভর, সুখ ও শান্তির সর্বস্ব দেখিয়া পায়। রায়-নন্দিনীও দেখিতে পাইল, ঈসা খাঁ-ই তাঁহারা জীবনের সর্বস্ব। এক একবার তাঁহাকে পাইবার আশায় হৃদয় আশ্বস্ত হইত, কিন্তু পর মূহুর্তের নিরাশায় তাহার অন্তর ব্যথিত ও অবসন্ন হইয়া পড়িত। স্বর্ণ ভাবিত, “আমি ও তাঁহাকে দেহ-প্রাণ উৎসর্গ করিয়া বসিয়া আছি, কিন্তু তিনি তাহা না বুঝেন! অথবা আমি পৌত্তলিক কাফের-কন্যা বলিয়া যদি আমাকে গ্রহণ না করেন। কৈ! তাঁহাকে ত আমার প্রতি আকৃষ্ট বলিয়া বোধ হয় না।” আবার ভাবে, “না না, তিনি ত চিরকালই আমাকে ভালোবাসিয়া আসিয়াছেন। যাহাকে এতকাল ভালোবাসিয়াছেন, সে যদি এখন তাঁহার আত্মবিক্রয় করে, তবে কি তিনি আনন্দিত হইবেন না? নিশ্চয়ই আনন্দিত হইবেন।”
“ভালোবাসা প্রেমে ঘনীভূত হইতে কতক্ষণ?” আবার নিরাশা তাহার কর্ণকুহরে গোপনীয়ভাবে বলে, “কি বিশ্বাস। পুরুষের মন।” আবার স্বর্ণকুমারী চঞ্চল-চিত্ত হইয়া উঠে। এইরূপ আশা এবং নিরাশায় স্বর্ণময়ীর জীবন কেমন যেন আনন্দবিহীন ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল। সে কি করিবে কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছিল না।