যুবতীঃ বাল্য-বিবাহটা বড়ই খারাপ।
যুবকঃ নিশ্চয়ই। তাতে দম্পতির স্বাস্থ্যই যে কেবল নষ্ট হয়, তা নয়। তাদের সন্তানেরাই অত্যন্ত দুর্বল, ক্ষীণজীবী এবং রোগপ্রবল হয়। যে সব দোষের জন্য তোমাদের হিন্দুরা মুসলমানের অপেক্ষা দুর্বল, সাহসহীন ও ভীরু, তাহার মধ্যে এও একটি প্রধান কারণ।
যুবতীঃ কিন্তু আপনার এখন বিবাহ করা উচিত।
যুবকঃ তা দেখা যাবে।
যুবতীঃ খুব সুন্দরী ও প্রেমিকা দেখে বিয়ে করবেন।
যুবকঃ সুন্দরী ও প্রেমিকা ও চাইই বটে। কিন্তু বিয়ে করলে বলিষ্ঠা ও সাহসিনী দেখেও করা চাই।
যুবতীঃ কেন?
যুবকঃ তা’হলে সন্তানাদিও বলিষ্ঠ ও বীরভাবাপন্ন হবে।
যুবতীঃ আপনার ছেলে এমনি বীরপুরুষ হবে। আপনার সাহস ও বীরত্বের চার ভাগের একভাগ পেলেই সে ছেলে বাঘ আছড়িয়ে মারবে।
যুবকঃ কেবল পিতা বীরপুরুষ হ’লেই হয় না, মাতাও বীর্যবতী ও সাহসিনী হওয়া চাই।
যুবতীঃ তা’হলে স্ত্রীলোকদিগেরও শারীরিক নানা প্রকার ব্যায়াম এবং অস্ত্রচালনা কৌশল শিক্ষা করা চাই।
যুবকঃ নিশ্চয়ই।
যুবতীঃ তা’হলে আপনাদের মধ্যে স্ত্রীলোকেরাও ব্যায়াম-চর্চা করে?
যুবকঃ হাঁ, সম্ভ্রান্ত বংশের সকল স্ত্রীলোককেই যুদ্ধ শিখ্তে হয়। আগে এ প্রথা আরও বেশী ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা দেশে এসে মুসলমানেরাও কেমন বিলাসী, অলস ও দুর্বল হ’য়ে পড়ছে।
যুবতীঃ আমি ত একটু তীর ও তরবারি চালনার অভ্যাস ক’রেছি। কিন্তু বাবা ব্যতীত আর সকলেই তার জন্য আমাকে ঠাট্রা বিদ্রূপ করে-বলে যে, “মর্দামী শিখছে।”
যুবকঃ তবে ত আজ দস্যুরা বড় বেঁচে গেছে!
যুবতীঃ আপনি বিদ্রূপ কচ্ছেন, কিন্তু আমার হাতে অস্ত্র থাকলে আমি দস্যুদিগের সঙ্গে নিশ্চয়ই যুদ্ধ করতেম।
যুবকঃ বেশ কথা। আমি শুনে খুসী হ’লেম। এইবার একটা বীরপুরুষ দেখে বিয়ে দিতে হবে। দেখো কোনো কাপুরুষকে শাদী না কর।
যুবকের কথা শুনে যুবতীর গোলাপী গণ্ড লজ্জার আক্রমণে পক্ক বিম্ববৎ রক্তিম হইয়া উঠিল। যুবতীর গষ্ডে ও চক্ষে লজ্জার আবির্ভাব হইলেও, মনটা কেমন যেন একটা আনন্দ-রসে সিক্ত হইয়া গেল।
এদিকে বৃষ্টি সরিয়া যাওয়ায়, ঈসা খাঁ যুবতীকে বলিলেন, “স্বর্ণ! তুমি এখন শোও! আমি বাইরে যেয়ে আকাশের অবস্থাটা দেখে আসি।”
যুবক এই বলিয়া দ্বার খুলিয়া বাহিরে গেলেন। দেখিলেন মেঘ-বিমুক্ত আকাশ নির্মল নীলিমা ফুটাইয়া তারকা-হারে সজ্জিত হইয়া হাস্য করিতেছে। পূর্বদিকে দশমীর চন্দ্র ক্ষুদ্র এক কৃষ্ণ জলদের শিরে চড়িয়া বৃষ্টিস্নাতা পৃথিবী সুন্দরীর পানে চাহিয়া হাসিয়া উঠিয়াছে। নব বধূ অতি প্রত্যুষে গোপন স্নানান্তে ঘাট হইতে বাটী ফিরিবার পথে নন্দার সহিত দেখা হইলে যেমন লজ্জায় ও হৃদয়-চাপা-আনন্দে ইষৎ আরক্ত ও প্রফুল্ল হইয়া উঠে, সদ্যস্নাতা ধরণীসুন্দরীও তেমনি চন্দ্র দর্শনে আনন্দে স্ফীত-বা ও প্রফুল্লমুখী হইয়া উঠিয়াছে।
বৃষ্টি-বিধৌত বৃরে নির্মল শ্যামল পত্রগুলি বায়ুভরে দুলিয়া দুলিয়া চাঁদের কিরণে চিক্চিক্ করিয়া জ্বলিতেছে। জোনাকীগুলি বৃষ্টি বন্ধ হইয়াছে দেখিয়া, চারিদিকের ছোট ছোট গাছপালা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝোপের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে উড়িয়া উড়িয়া বাহার দিয়া ফিরিতেছে। মাঝে মাঝে বাতাস আসিয়া গাছপালার পত্রস্থ জল ঝাড়িয়া মাথা মুছাইয়া দিতেছে। যুবকের শাদা ঘোড়াটি গাছের নীচে দাঁড়াইয়া গা ঝাড়িতেছে। ঈসা খাঁ মন্দিরে ঢুকিয়া নিজের ভেজা ইজার লইয়া ঘোড়াটার গা মুছিয়া দিলেন। পরে তরবারি হস্তে লইয়া যুবতীকে বলিলেন, “তুমি পাল্কীর ভিতরে ঘুমাও, আর কোন ভয়ের কারণ নাই। আমি একবার ভট্রাচার্য-বাড়ীতে আমার লোকজনের এবং তোমার দাদার অনুসন্ধান করে আসি।”
ঈসা খাঁ তরবারি হস্তে মন্দির হইতে রাস্তায় বাহির পড়িলেন। কিঞ্চিৎ দূরে অগ্রসর হইয়া দেখিলেন, দূরে কে একজন অশ্বারোহণে ইতস্ততঃ ফিরিতেছে। যুবক অগ্রসর হইলেন। অশ্বারোহী ঈসা খাঁকে তরবারি-পাণি দেখিয়া ভীত কণ্ঠে বলিল, “কে ও ?” ঈসা খাঁ কণ্ঠস্বরেই বুঝিতে পারিলেন যে, অশ্বারোহী কেদার রায়ের পুত্র বিনোদ।
ঈসা খাঁ আনন্দে বলিলেন, “বিনোদ! এস, ভয় নাই, আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। স্বর্ণ ভাল আছে।” সহসা বিশ্বস্ত ও আত্মীয়তার প্রীতিমাথা কণ্ঠস্বর শ্রবণে বিনোদ বিস্মিত-অন্তরে ঘোড়া ছুটাইয়া নিকেট আসিল। ঘোড়া হইতে নামিয়া ঈসা খাঁর পদধূলি গ্রহণ করিল। ঈসা খাঁ তাহাকে আনন্দে আলিঙ্গন করিলেন। বিনোদ বলিল “দাদা সাহেব! আপনি এ দুর্যোগে কোথা থেকে” ঈসা খাঁ তাহাকে সমস্ত ঘটনা খুলিয়া মন্দির দেখাইয়া ভট্রাচার্য-বাড়ীর দিকে অগ্রসর হইলেন।
ঈসা খাঁ ভট্রাচার্য-বাড়ী উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তাঁহার সমস্ত লোকজন ভট্রাচার্য বাড়ীতে বসিয়া আছে। বাড়ী কর্তা রজনী ভট্রাচার্য ঈসা খাঁকে সপরিবারে, পরম সৌভাগ্য জ্ঞানে দেবতার ন্যায় সম্মান ও সমাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। রজনী ভট্রাচার্যের আগ্রহে, ভদ্রতা ও খাতিরে, ভক্তি ও শ্রদ্ধায় ঈসা খাঁ তথায় আহার করেন ও রাত্রি যাপনে সম্মত হইলেন। লোক পাঠাইয়া বিনোদ ও রায় নন্দিনীকে মন্দির হইতে আনিলেন। স্বর্ণময়ী অন্তঃপুরে পরমাদরে রমণীদের দ্বারা অভ্যর্থিতা হইল। রজনী ভট্রাচার্য একজন জমিদার। তিনি রাজার ন্যায় যত্নে ও আড়ম্বরে ঈসা খাঁ এবং তাঁহার সঙ্গীয় পঞ্চান্ন জন লোককে ভোজন করাইলেন।