যুবতীর হৃদয়ের উপর দিয়া কত কি চিন্তার তুফান ও ভাবের তরঙ্গ প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে, কিন্তু ঈসা খাঁ আনমনে চিবাইতেছেন। পান চিবান শেষ হইলে-ছিবড়া ফেলিয়া যুবক একবার নেত্র ফিরাইয়া যুবতীর দিকে তাকাইয়া বলিলেন, “স্বর্ণ! এখন কি করা যায়! বৃষ্টি ও তুফান এখনও ত সমানভাবে চলছে। তুমি পাল্কীর ভিতরে শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে। অসুখ করতে পারে। বৃষ্টি থামলে যা হয় একটা বন্দোবস্ত করবো।”
যুবকের আহবানে পুনরায় কি যেন একটা তড়িৎ স্রোত যুবতীর হৃদয়ে প্রবাহিত হইল। যুবতী গলাধরা-স্বরে বলিল “আমার ঘুম আসছে না। আপনি অনেক হয়রান হয়েছেন, আপনি বরং ঘুমান।” তারপর একটু থামিয়া যুবতী আবার বলিল, “আচ্ছা, আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন এখানে এ সময় কেমন করে এলেন?”
যুবকঃ কেন? সে কথা তুমি এতক্ষণে জিজ্ঞাসা করছ যে?
যুবতীঃ আপনাকে পরিশ্রান্ত ভেবেই প্রথমে কিছু জিজ্ঞাসা করি নাই। তবে আপনি যে মুরাদপুরে যাচ্ছিলেন, তখন তা দস্যুদিগকে বলেছিলেন।
যুবকঃ হাঁ, মুরাদপুরেই যাচ্ছিলেম। সেখানে একটা গ্রামের সীমা নিয়ে, আমার অধীন দুইজন জমিদারের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। সেখানে পূর্বেই লোক পাঠিয়েছি। আরো লোক সঙ্গে ছিল। ঝড় উঠে এলে, আমি ভট্রাচার্যদের বাড়ীতে আশ্রয় নেবার জন্য দ্রুতগতিতে অশ্ব চালনা করায় তা’রা পিছনে পড়েছে। অন্ধকারে পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই রাস্তায় এসে পড়ি। মন্দিরের নিকটবর্তী হলে, বহু লোকের কোলাহল শব্দ শুনে ও গবাক্ষের ভিতর দিয়ে গৃহের আলো দেখে এখানে নেব মনে করে ঘোড়া হতে নামি। এটা যে শিবমন্দির তা অন্ধকারে কিছু টের পাইনি। আমি বৈঠকখানা মনে করেছিলাম। মন্দিরের দ্বারের সম্মুখবর্তী হইবামাত্রই প্রতাপাদিত্যের লোকেরা তোমাকে লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে, তা তাদের কথা থেকে বেশ বুঝতে পেলাম। ব্যাপার গুরুতর মনে করে আমি ঘোড়টাকে তাড়াতাড়ি এই সম্মুখের গাছের নীচে রেখে বিদ্যুতালোকে মন্দিরটি একবার বেশ ভাল করে দেখে নিলাম। দেখলাম যে, একটি ব্যতীত মন্দিরের দ্বিতীয় দ্বার নাই। দস্যুদের পালাবার কোন উপায় নাই। তখন দ্বারে পদাঘাত করি।
যুবতীঃ ধন্য আপনার হৃদয়! ধন্য আপনার সাহস ও বীরত্ব! আপনি একাই অতগুলি দস্যুকে আক্রমণ করে জয়লাভ করলেন। ভগবান্ আপনার দীর্ঘজীবন ও মঙ্গল করুন।
যুবকঃ এ আর বেশী সাহসের বা বীরত্বের কথা কি, স্বর্ণ! দস্যুরা বলশালী হলেও, অন্তরে তারা অত্যন্ত ভীরু। যারা পাপকার্য করে, তারা মানসিক বলশূন্য। বাহিরে তারা যতই আস্ফালন করুক না কেন, ভিতরে অত্যন্ত ভীত ও কম্পিত। আর তোমাকে বিপদগ্রস্থ দেখে, তোমাকে উদ্ধার করবার জন্য আমার এখন উত্তেজনা এসে পড়েছিল যে আমি তখন আমার নিজের কোনও বিপদের বা দস্যুদের সংখ্যার বিষয় আদৌ খেয়াল করি নাই।
যুবতীঃ আপনি আমাকে দু’বার রক্ষা ক’রলেন।
যুবকঃ আমি কে, যে রক্ষা করব? খোদা রক্ষা করেছেন। আর দু’বার কোথায়?
যুবতীঃ খোদাই রক্ষা করেন সত্য, কিন্তু আপনি ত উপলক্ষ বটেন। দু’বার নয় কেন? এই একবার, আর সেই যে কৃষ্ণদীঘি থেকে; ভুলে গেছেন নাকি?
যুবকঃ না, ভুলে যাইনি। কিন্তু সেবার আরো লোক ত তোমাকে জন্য জলে ঝেঁপে পড়েছিল।
যুবতীঃ পড়েছিল বটে, কিন্তু সে অনেক পরে, আপনি তখন আমাকে তুলে নিয়ে দীঘির প্রায় কেনারায় এসেছিলেন। আপনি না তুললে সেদিন আর একটুতেই ডুবে যেতাম।
যুবকঃ তুমি যাতে ডুবে না যাও, সেই জন্যই খোদা আমাকে তখন ওখানে রেখেছিলেন। কেন? সে কথা এখন তুললে যে!
যুবতীঃ না, এমনি মনে প’ল। তবে আমি যখনি বিপদে পড়ি, তখনই যে খোদা আপনাকে আমার উদ্ধারকর্তা করে পাঠান এ এক চমৎকার রহস্য।
ইহা বলিয়া যুবতী মন্দিরস্থ শিবলিঙ্গের দিকে আনমনে একবার দৃষ্টি করিল এবং মনে মনে কি যেন ভাবিয়া একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।
যুবকঃ তাঁর সবই রহস্য। তাঁর কোন কার্যে রহস্য নাই? তাঁর সবই বিচিত্র। ভাবলে অবাক হতে হয়।
যুবতীঃ যা হ’ক আপনি না এলে, উঃ! কি একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার সংঘটিত হ’ত! আপনাকে দেখে আমার বড়ই সুখ ও আনন্দ হচ্ছে। আপনার কথা আমরা সর্বদাই স্মরণ করি। এবার পুণ্যাহে কত বিনয় ক’রে আপনাকে নিমন্ত্রণ করা হল; তথাপি এলেন না। আপনি না আসায় পুণ্যাহের আমোদও তেমন হয় নাই; আপনি আসবেন বলেই মালাকরেরা কত ভাল ভাল বাজি তৈয়ার ক’রেছিল। বাবা আপনার জন্য কত দুঃখ প্রকাশ ক’রলেন।
যুবকঃ কি ক’রবো স্বর্ণ। তোমাদের ওখানে আসতে আমারও খুব আনন্দ ও ইচ্ছা হয়, কিন্তু কেবলা সাহেবের মৃত্যুর পর হ’তে বিষয়কর্ম নিয়ে এমনি ফ্যাসাদে পড়েছি যে, একটু ফরাগৎ মত দম ফেলবারও আমার অবসর নাই। সর্বদাই মহালে বিদ্রোহ হচ্ছে। সীমা নিয়ে জমিদারের সঙ্গে প্রায়ই লড়াই চলছে। দায়ুদ খাঁর পতনের পরে বাঙ্গালা দেশ কেমন অরাজক হয়ে পড়েছে। এদিকে আকবর শাহ্ সমস্ত বাঙ্গালা এখনও করতে পারেন নি।
যুবতীঃ যাক, সে সব কথা। আপনার বিবাহের কি হচ্ছে?
যুবকঃ এখনও বিবাহের কিছু হয়নি। কিছু হলে তোমরা ত জেয়াফতই পেতে। মা মাঝে মাঝে বিবাহের কথা বলেন। তবে আমি এখনও বিবাহ সম্বন্ধে বড় একটা কিছু ভাবি নাই।
যুবতীঃ এত বয়স হয়েছে। এখনও বিয়ে করবেন না?
যুবকঃ তা আর বেশী কি? এই ত সবে পঁচিশে পড়েছি। আমাদের মধ্যে ৩০ বৎসর বয়সের পূর্বে প্রায় বিয়ে হয় না। হিন্দুদের মত আমাদের মধ্যে বাল্য-বিবাহ নাই।