তারপর, ঠিক নয় দিবস পরেই গত রাত্রিতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাঁর মৃত্যুতে আমি পলায়ন করে কোনওরূপে আমার একমাত্র স্বামী যাঁকে আমি এক মুণ্ডর্তের জন্যও ভুলি নাই, যাঁকে স্বেচ্ছায় আমি হৃদয়-মন্দিরের সিংহাসনে প্রেমরাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে বরণ করে নিয়েছি-সেই মাহতাব খাঁর শ্রীচরণে আশ্রয় ও শান্তি লাভের সুবিধা হবে মনে করে উৎফুল্ল হয়েছিলাম। কিন্তু আমার সঙ্গের লোকজন আমার গহনাপত্র, মণিমুক্তা এবং অর্থলাভের জন্য বলপূর্বক সহমরণে বাধ্য করে। আমার অনুনয়-বিনয় এবং কাতর ক্রন্দন কিছুতেই তাদের পাষাণ হৃদয়ে করুণার সঞ্চার হয় না। আমি যখন স্বেচ্ছায় স্বীকৃত হলাম না, তখন বলপূর্বক হস্তপদ বন্ধন করে আমাকে চিতায় তুলে দিল। আমি যখন করুণকণ্ঠে আর্তনাদ করতে লাগলাম, তখন পাষণ্ডগণ বিকট শব্দ ঢাকঢোল করতাল বাজাতে এবং উচ্চৈঃস্বরে হরিধ্বনি করতে লাগল। তারপর সর্ববিপদ্ হন্তা মঙ্গলময় আল্লার কৃপায় আপনি এসে উদ্ধার করলেন।
ঈসা খাঁ অরুণাবতীর মুখে স্বপ্নরাজ্যের অগোচর এবং চিন্তার অতীত অপূর্বকাহিনী শ্রবণ করিয়অ আনন্দে আত্মহারা হইয়া মুক্তকণ্ঠে “ছোবহান আল্লাহ!” “ছোবহান আল্লাহ!” বলিয়া উঠিলেন। তাঁহার আনন্দাশ্রুর উন্মেষ হইল। অরুণার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “দেখছি করুণাময় বিধাতা একনিষ্ঠ প্রেমিক-প্রেমিকাদিগকে কদাপি বঞ্চিত করেন না।
এণে চল, আমার সঙ্গে চল। আমি দাক্ষিণাত্য হতে দেশে ফিরছি। মাহতাব খাঁ তোমার মিথ্যা-প্রচারিত মৃত্যু-সংবাদে মরমে মরে আছে। সে আবার তোমার অপ্রত্যাশিত দর্শনে রাণ্ডমুক্ত মাহতাবের (চন্দ্রের) ন্যায় নবজীবন লাভ করবে। তোমার বাসনাও সিদ্ধ হবে। চল, আর বিলম্ব না করে জাহাজে চল। এথায় কালবিলম্বে অনেক বিপদ ঘটতে পারে।”
অতঃপর অরুণাবতীকে লইয়া ঈসা খাঁ ‘বাবরজঙ্গ’ জাহাজে প্রত্যাগমন করিলেন।
২২.রায়-নন্দিনী – উপসংহার
প্রায় একমাস পরে বসন্তকালের মধুর সময় ফাল্গুনের শেষে গাজী ঈসা খাঁ খিজিরপুর রাজধানীতে মাতা, বণিতা, বন্ধুবর্গ এবং সৈন্যাদি-সহ উপস্থিত হইলেন। নাগরিকগণ বিপুল আড়ম্বরে নব-দম্পতিকে অভ্যর্থনা করিল। কয়েক দিন পর্যন্ত রাজধানী এবং অনেক পল্লী ও মফঃস্বলের রাজ-করাচিতে আলোকসজ্জা এবং পুস্প-পতাকার বাহার খেলিল! দীনদুঃখীগণ প্রচুর দান পাইল। গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণ স্বচ্ছন্দে সংসার-যাত্রা নির্বাহের জন্য ‘লাভোরাজ’ এবং ‘মদদে মাশ’ প্রাপ্ত হইলেন।
কয়েক দিবস পরে ঈসা খাঁ নিজে উদ্যাগী হইয়া রাজ-ব্যয়ে প্রতাপ-কন্যা অরুণাবতীকে মাহতাব খাঁর পরিণয়-পাশে আবদ্ধ করিলেন। এই বিবাহ প্রতাপ নিমন্ত্রিত হইয়াও ঘৃণা ও লজ্জায় উপস্থিত হইলেন না। কিন্তু শ্রীপুরাধিপতি কেদার রায় ও চাঁদ রায় দুই ভ্রাতা আসিয়া ঈসা খাঁর সহিত গভীর আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হন।
জহিরুল হক প্রচুর জায়গীর লাভ করতঃ সপরিবারে খিজিরপুরে আসিয়া নিরুদ্বেগে ধর্ম ও জ্ঞান-চর্চা করিতে লাগিলেন। তাঁহার চেষ্টায় বহুতর উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ-পরিবার ক্রমশঃ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।