একদা প্রাতঃকালে উড়িষ্যার উপকূলে চিল্কাহ্রদের তীরে শিকার করিবার মানসে বীরপুরুষ ঈসা খাঁ কতিপয় শিকারী যোদ্ধাসহ ক্ষুদ্র তরণীযোগে জাহাজ হইতে তটে আসিয়া অবতরণ করিলেন। তাঁহারা যখন চিল্কার তট-প্রদেশে নানা জাতীয় হংস, সারস ও চক্রবাক শ্রেণীর পক্ষী শিকার করিয়া হরিণ শিকারের জন্য চিল্কার পশ্চিমাদিকস্থ কাননাভিমুখে অগ্রসর হইতেছিলেন, সেই সময় পথিমধ্যে একস্থান চিল্কার তীরে বহু লোকসমাগম এবং বাদ্যধ্বনি ঈসা খাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। ঈসা খাঁ অচিরেই বুঝিতে পারিলেন যে, একটি হিন্দু-রমণীকে তাহার মৃতপতির চিতায় একসঙ্গে পোড়াইবার জন্য সমারোহ ব্যাপারের সূচনা। ঈসা খাঁ নিজ রাজ্যের সহমরণ প্রথা কঠোর রাজাদেশ প্রচার করিয়া একেবারেই বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। তজ্জন্য সহমরণ প্রথা যে কিরূপ নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক কাণ্ড, তাহা নিজে কখনও প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ পান নাই। ঈসা খাঁ এক্ষণে সুযোগ পাইয়া অশ্ব ছুটাইয়া যাইয়া জনতার নিতান্ত সন্নিকটবর্তী হইয়া দেখিতে পাইলেন যে, একটি পরমাসুন্দরী যুবতী রমণীকে হস্তপদ বন্ধাবস্থায় তাহার স্বামীর চিতায় তুলিয়া দিয়া আগুন ধরাইয়া দিবার আয়োজন করা হইতেছে। নারীটি অতি করুণকণ্ঠে আর্তধ্বনি করিতেছে! একদিকে নারীহত্যার উদ্যোগী পাষণ্ডগণ সেই করুণ ক্রন্দনরোলকে কোলাহলে ডুবাইয়া দিবার জন্য বিপুল উদ্যামে বাজনা বাজাইতেছে।
দেখিতে দেখিতে চিতার আগুণ জ্বলিয়া উঠিল। রমণী ভীষণ চিৎকার করিয়া প্রাণরক্ষা সঙ্কল্পে অন্তিম চেষ্টায় চরম বল-প্রয়োগে চিতা হইতে মাটিতে পড়িবার চেষ্টা করা মাত্র একটি পাষণ্ড হিন্দু ভীমবংশদণ্ড দ্বারা নারীর কটিদেশে আঘাত করিল! ঈসা খাঁ মুহুর্ত মধ্যে ব্যাপার বুঝিয়া অত্যন্ত বিস্মিত এবং যার-পর-নাই শোকসন্তপ্ত কণ্ঠে চীৎকার বলিলেন, “কি কর! কি কর!!” ঈসা খাঁর সঙ্গীয় যোদ্ধাগণও মুহুর্তমধ্যে ঈসা খাঁর নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন। হিন্দুগণ ঈসা খাঁকে মুসলমান, সুতরাং সহমরণের নিষ্ঠুর প্রথার তীব্র বিরোধী আসিয়া করিয়া বংশদণ্ড, কুঠার, দা, লগুড় ও পাথর হস্তে তাঁহাকে আক্রমণ করিবার জন্য ছুটিয়া আসিল। ইহাতে ঈসা খাঁ নিতান্ত উত্তেজিত এবং ক্রুদ্ধ হইয়া ভীমবেগে তরবারি হস্তে তাহাদিগকে আক্রমণ করিলেন। কয়েকজন আহত হইয়া ভূপতিত হইবার পরেই সকলে বৃকতাড়িত মেষবৎ ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিতে লাগিল। ঈসা খাঁ বিদ্যুদ্বেগে যাইয়া চিতার উপর হইতে নারীকে স্বহস্তে উঠাইয়া লইলেন। তৎপর তাহার হস্তপদের বন্ধন খুলিয়া দিলেন।
রমণী বন্ধনমুক্ত হইয়া ভক্তিভরে জীবনদাতা ঈসা খাঁর পাদস্পর্শ করিতে করিতে বাম্পাবরুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “আমি অরুণাবতী।” বহুদিনের মৃতব্যক্তিকে সহসা জীবিতাবস্থায় দর্শন করিলে যে-পরিমাণ বিস্ময় ও কৌতূহল জন্মিতে পারে, সেই প্রকার বিপুল বিস্ময় ও কৌতূহলে উদ্দীপ্ত হইয়া ঈসা খাঁ বলিলেন যে, “কি অরুণাবতী! আশ্চর্য! সেকি কথা!! তুমি ত অনেক দিন হ’ল বসন্তরোগে মারা গিয়াছে! তুমি এখানে কিরূপে? তুমি কোন্ অরুণাবতী? আমি তোমাকে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের কন্যা রূপেই দেখতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি অন্য কোনও অরুণাবতী! শীঘ্র তোমার পরিচয় দাও।”
অরুণাবতী বলিল, “জাঁহাপনা, আমি যশোহরের অধিপতি মহারাজ প্রতাপাদিত্যের কন্যা অরুণাবতীই বটে; আমি মাহতাব খাঁর বাগদত্তা ভার্ষা। আমি বসন্তরোগে মারা যাই নাই। আমার বসন্ত হবার কথাটাই সম্পূর্ণ মিথ্যা! পিতা আমাকে খাঁর সাথে পূর্বে বিয়ে দিতে স্বীকৃত হলেও পরে যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ায় জন্য এবং স্বর্ণময়ীকে হস্তগত করতে না পারায় আপনাদের প্রতি যার-পর-নাই জাতক্রোধ হন। মাহতাব খাঁর প্রতি তিনি যার-পর-নাই রুষ্ট এবং বিরক্ত। তাঁহার প্রাণ বধের জন্য তিনি নিতান্তই অধীর ও উন্মক্ত। শুধু দায়ে পড়েই তিনি মাহতাব খাঁর হস্তে আমাকে সমর্পণ করতে চেয়ে ছিলেন। আমাকে বাটীতে লয়ে যাবার কয়েক দিন পরেই আমাকে একটি বিশেষ ঘরে আবদ্ধ করে, চতুর্দিকে রাষ্ট্র করে দিলেন যে, আমি বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছি। পরে অন্য একটি রমণীকে বাটী হতে রাজ-আড়ম্বরে শ্মাশানে লয়ে দাহ করা হয়! তা’তেই আপনি ভ্রমে পড়েছেন। বস্তুত;, আমি মারা যাই না। পিতৃদেব আপনাদের হস্ত হতে অব্যাহতি পাবার জন্য আমাকে মেরে ফেলবার জন্যই সংকল্প করেছিলেন; কিন্তু আমার জননী এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধে অবশেষে বীরেন্দ্রকিশোর দত্ত নামক জনৈক নিরাশ্রমে ভদ্রসন্তানের সহিত আমাকে বলপূর্বক বিবাহ দিয়া লোকজনসহ জগন্নাথধামে অতি সঙ্গোপনে পাঠিয়ে দেন। আমাদের জন্য বার্ষিক পাঁচ সহস্র মুদ্রার বৃত্তি বন্দোবস্ত করে দেন। নগদ দশ হাজার টাকা আমাদিগের বাটী ও সরঞ্জামী খরচের জন্য সঙ্গে দিয়েছিলেন। আমি সমস্ত পথই অশ্রুপাত করতে করতে জগন্নাথক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হই। স্থলপথে এবং জলপথে ২০ দিনে আমরা পুরীতে এসে হাজির হই।
পুরী যাবার পঞ্চম দিবসে বীরেন্দ্র দত্ত অশ্বারোহণে নির্বিঘ্নে যেতে ছিলেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে এক অরণ্যের অন্তবর্তী পস্থায় সহসা ব্যাঘ্র-দর্শনে অশ্বটি উধাও হ’য়ে তাঁকে পৃষ্ঠ হ’তে ফেলে দিয়ে ছুটে পলায়ন করে। একখণ্ড প্রস্তরের উপর মস্তক ও কটিদেশ পতিত হওয়ায় তিনি অতি সাংঘাতিক রূপে আহত হন। সেই আঘাতে তিনি যার-পর-নাই দুর্বল এবং পীড়িত হয়ে পড়েন। অনবরত কয়েক দিন রক্তবমন করেন। পুরীতে এসে হাকিম ইকবাল খাঁর চিকিৎসায় অনেকটা আরোগ্য লাভ করেন। তৎপর হাকিমের উপদেশে চিল্কাহ্রদের তীরবতী মুণ্ডী নামক স্থানে জলবায়ু উৎকৃষ্টতর বলে সেইখানেই আমরা বাস পরিত্যাগপূর্বক ময়ূরভঞ্জের জনৈক অবধূত সন্ন্যাসীর ঔষধ সেবন করতে থাকেন। তা’তে প্রথমতঃ একটু ভালো ফল দেখা যায়। কিন্তু কয়েক দিন পরেই অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়।