স্বর্ণকে দেখিবার জন্য বেগম ও শাহজাদী হইতে আরম্ভ করিয়া স্বর্ণকে গৃহে নানাশ্রেণীর অসংখ্য রমণীর সমাগম হইতে লাগিল। সোলতান ও বেগমগণ স্বর্ণময়ীকে ধর্মকন্যা বলিয়া সমাদর ও সম্বর্ধনা করিতে লাগিলেন। স্বর্ণের সুচিকিৎসা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের জন্য সর্বপ্রকারের শাহী বন্দোবস্ত করা হইল। ইশ্বরেচ্ছায় অল্পদিগের মধ্যেই ঈসা খাঁ এবং স্বর্ণময়ী আরোগ্য লাভ করিলেন।
ঈসা খাঁর রুগ্ন ও জীর্ণ দেহে আবার নবযৌবনের কান্তি-শ্রী ফিরিয়া আসিয়া লাগিল। হিমানী-পীড়িত শ্রীহীন-উদ্যান যেমন বসন্ত-সমাগমে নব-পত্র-পল্লব এবং ফল-ফুল মঞ্জুরীতে হিভূষিত হইয়া পিকবধূর আনন্দ বিধান করে, ঈসা খাঁর স্বাস্থ্য-শ্রীও তেমনি স্বর্ণময়ীর প্রাণে অতুল আনন্দ দান করিতে লাগিল। জীবনের স্বার্থকতার পূর্ণ পরিতৃপ্তি বোধে, জীবনানুভূতি স্বর্ণের নিকটে নিতান্তই সুবিধাময় বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। নিজের দুঃখ-কষ্ট বা অসুবিধার বিষয় স্থান পাইতে পারে, এমন একটু স্থানও হৃদয়ে রহিল না। তাহার হৃদয়-মন্দিরের প্রেমদেবতা, অন্তর-আকাশের পূর্ণচন্দ্রমা, মন-উদ্যানের মন্দাকিনীধারা জীবনকুঞ্জের শোভন গোলাপ-ঈসা খাঁকে যে মৃত্যুর কবল হইতে নব-জীবনে ফিরাইতে আনিতে পারিয়াছে, তাঁহার জন্য যে নিজ বাণ্ডর মাংসচ্ছেদ করিয়া দিবার সুযোগ পাইয়াছে, সেই মধুর ঘটনা ও উল্লাসে স্বর্ণময়ীর হৃদয়ের কুঞ্জে অপার্থিব প্রেমের সুধা রাগিণীর যে বিনোদ ঝঙ্কার বাজিয়া উঠিয়াছে, তাহাতে তাহার হৃদয় ভরপুর হইয়াছে। প্রেমাস্পদের জন্য স্বার্থত্যাগ এবং আত্মত্যাগে যে আনন্দ, তাহা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্যের পক্ষে ধারণা করা অসম্ভব। স্বর্গে সে আনন্দ নাই।
২১.রায়-নন্দিনী – একবিংশ পরিচ্ছেদঃ মিলন
মাসাধিক কাল পরে বীরবর ঈসা খাঁ সম্পূর্ণ সুস্থ ও পূর্ববৎ বলিষ্ঠ হইলেন। সোলতান নিজাম শাহ উৎফুল্লচিত্তে এক দরবার আহবাস করিয়া ঈসা খাঁর স্বার্থত্যাগ, স্বজাতি-প্রেম এবং প্রখর বীরত্বের জন্য মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিয়া সোলতান চতুষ্টয়ের পক্ষ হইতে হীরকের মুষ্টিযুক্ত একখানি বণ্ডমূল্য তরবারি, বণ্ডমূল্য রাজকীয় পরিচ্ছেদ, একটি অত্যদ্ভুদ ঘটিকা-যন্ত্র, একছড়া বৃহদাকারের মুক্তার মালাসহ “বাবর-জঙ্গ” উপাধি প্রদান করিলেন।
অতঃপর নিজাম শাহের বেগম জান্নাত মহলের আগ্রহ এবং উদযোগে বিজয়নগরেই ঈসা খাঁ এবং স্বর্ণময়ীর বিবাহ-ব্যাপার সম্পন্ন হওয়া স্থিরীকৃত হইল। সোলতান নিজাম শাহ বিপুল উদ্যোগে বিবাহের আয়োজন করিতে লাগিলেন। উদ্বাহ-ক্রিয়ার জন্য বিরাট মহফেল সংগঠিত হইল। রাজ্যময় ধূমধান হৈচৈ পড়িয়া গেল। দশ হাজার লোক বসিতে পারে, এমন বিরাট সভামণ্ডপ নির্মিত হইল। নানা শ্রেণীর দর্পণ, ময়ূরপুচ্ছ, পতাকা, ফুল ও পাতা দ্বারা মজলিস দ্বারা মসলিস আরস্তা করা হইল। দশ সহস্র বেলওয়ার ও স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত বিচিত্র-দর্শন ঝাড় ও ফানুসের দ্বারা মসলিস রওশন করা হইল। অতিসূক্ষ্ম ‘জড়বফত’ ও ‘শবনম’ দ্বারা দ্বারসমূহের যবনিকা প্রস্তুত করা হইল। কিঙ্খাপ দ্বারা চতুর্দিকের কানাৎ রচিত হইল। বহুসংখ্যক মূল্যবান ‘ক্কালিন’ বিছাইয়া তদুপরি নানাশ্রেণীর চিত্র-বিচিত্র কুর্সী, সোফা ও তখত স্থাপন করা হইল। নির্দিষ্ট দিনে বিপুল আড়ম্বরে শত তোপধ্বনি এবং অযুতকণ্ঠে মঙ্গল-কামনার মধ্যে ঈসা খাঁ এবং শামসুন্নেসার (স্বর্ণময়ীর ইসলামী নাম) শুভ উদ্বাহ ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গেল। অতঃপর দুই দিন ধরিয়া নগরে সমস্ত হিন্দু ও মোসলেম অধিবাসী এবং সমাগত সমস্ত ব্যক্তিকে রাজ-ভোজে পরিতৃপ্ত করা হইল। বেগম জান্নাত মহল নব-দম্পতিকে মূল্যবান পরিচ্ছদ, মণিমুক্তাখচিত অলঙ্কার এবং বহু জিনিসপত্র দান করিলেন। সোলতান চতুষ্টয় প্রত্যেকে একশত করিয়া পারস্যসাগরজাত মুক্তা এবং নিজ নিজ রাজ্যের এক সহস্র করিয়া সুবর্ণ মুদ্রা, একটি করিয়া আরব্য অশ্ব এবং একটি করিয়া হস্তী দান করিলেন। আমীর ও সম্ভান্ত ব্যক্তিগণ কেহ মৃগনাভি, কেহ মুক্তা, কেহ সুবর্ণমুদ্রা প্রভৃতি উপহার দান করিলেন। ঈসা খাঁ এবং স্বর্ণময়ী যে পরিমাণ সুজা উপহার পাইয়াছিলেন, তাহার ওজন ৩০২ তোলা হইয়াছিল।
বিবাহের পরে ঈসা খাঁ এবং স্বর্ণময়ী দীন-দুঃখী এবং পান্থ ও বিপন্ন ব্যক্তিদিগকে তিনদিন পর্যন্ত অর্থ বিতরণ করিলেন। এই বিতরণে এক লক্ষ সতর হাজার টাকা ব্যয়িত হয়। অতঃপর সোলতান, বেগম এবং আমীর ওমরাহ ও আলেমদিগকে তিন লক্ষ টাকা মূল্যের টুপি, পাগড়ী, ছড়ি, তরবারি, পরিচ্ছদ, অঙ্গুরী প্রভৃতি উপহার প্রদান করেন।
অতঃপর ঈসা খাঁ বিজয়নগরে স্মৃতি-চিহৃস্বরূপ একটি করিয়া অনাথ আশ্রম এবং শামসুন্নেসা ল মুদ্রা ব্যয়ে একটি রমণীয় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করিয়া মাঘ মাসের শেষে স্বদেশ প্রত্যাগমনে উদ্যোগী হইলেন।
সোলতানগর আমীর ও সম্ভান্ত ব্যক্তিবর্গ সহানুভূতি, ভ্রাতৃভাব এবং প্রগাঢ় প্রেমের সহিত সাশ্রুনেত্রে বিদায় প্রদান করিলেন। সহস্র সহস্র কণ্ঠের মঙ্গলধ্বনির মধ্যে মধ্যে বিজায় গ্রহণ করিয়া ঈসা খাঁ তিন দিবস অশ্বারোহণে যাইবার পরে কৃষ্ণা-নদীর কূলে জাহাজে যাইয়া আরোহণ করিলেন। জাহাজ ছুটিবার সঙ্গে সঙ্গেই তীরস্থ জনগণ রুমাল উড়াইয়া “জাজাকাল্লাহু” “জাজাকাল্লাহু” বলিয়া উচ্চকণ্ঠে মঙ্গলধ্বনি করিতে লাগিলেন। যতক্ষণ দেখা যাইতে লাগিল, ততক্ষণ পর্যন্ত জাহাজ ও তীরস্থ ব্যীক্তবৃন্দ রুমাল উড়াইতে লাগিলেন।