সরলা তাহার বাল্য-সখী। শিশুকাল হইতে উভয়ের গভীর অনুরাগ। স্বর্ণের বিপদে, স্বর্ণের দুশ্চিন্তায় সরলাও ব্যাকুলা হইয়া পড়িল। অবশেষে ঠাকুর যশোদানন্দ বা জহিরুল হকের নিকট পরামর্শ গ্রহণ করিবার জন্য স্বর্ণ সরলাকে কৌশল করিয়া পাঠাইয়া দিল। শাহ সোলতান মহীউদ্দীনের নিকট হইতে পানি-পড়া আনিবার উপলক্ষে সরলা জহিরুল হককে সমস্ত কথা নিবেদন করিল।
যশোদানন্দ সুকুমারী স্বর্ণময়ীকে বাল্যকাল হইতেই আপন কন্যার ন্যায় ভালোবাসিতেন এবং স্নেহ করিতেন। কারাগারে যখন যশোদানন্দের নির্যাতন ও লাঞ্ছনায় তাঁহার পূর্বের ভক্ত অনুরক্ত শিষ্য-শিষ্যাগণ আনন্দবোধ করিতেছিল, তখন একমাত্র স্বর্ণের চক্ষেই তাঁহার জন্য সহমর্মিতার পবিত্র অশ্রুবিন্দু ফুটিয়াছিল। স্বর্ণ অবসর এবং সুবিধা পাইলেই চঞ্চল চরণে করুণাপূর্ণ আঁখি ও মমতাপূর্ণ হৃদয় লইয়া কিরূপ ব্যাকুলভাবে কারাগৃহের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইত এবং কিরূপ পরিপূর্ণ সহৃদয়তার সহিত তাঁহার দুঃখে সহানুভূতি জানাইত এবং পরিশেষে তাহার বুদ্ধি-কৌশলে জহিরুল হক সেই সাক্ষাৎ নরক হইতে কিরূপে প্রমুক্ত হইলেন, তাহা স্মরণ করিয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন। স্বর্ণের প্রাণের যন্ত্রণা এবং মহাবিপদের কথা শুনিয়া তাঁহার স্নেহ-মমতা আরও উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। কোমলপ্রাণ্য, উদি্ভন্ন-যৌবনা স্বর্ণময়ীর সরল হৃদয়খানি প্রেমানুরাগে কিরূপে দগ্ধ হইতেছে-নৈরাশ্যের ভীষণ ঝটিকা, তাহার আশা-আনন্দ ও আলোকপূর্ণ মানস-তরুণীকে কিরূপভাবে বিষাদের অগাধ সলিলে ডুবাইয়া দিতেছে, তাহা ভাবিয়া একান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।
স্বর্ণময়ী যে ঈসা খাঁর প্রেমের আবদ্ধ হইয়াছে, জহিরুল হক তাহা স্বপ্নেও জানিতেন না। ঈসা খাঁর বিবাহ-প্রস্তাবে তিনি যদি আপত্তি উত্থাপন না করতেন, তাহা হইলে স্বর্ণময়ীর জীবন-পূর্ণিমা আজ এমন অমাবস্যায় পরিণত হইত না। তিনিই যে স্বর্ণময়ীর প্রণয়-পথে কণ্টক রোপন করিয়াছেন, তাহা স্মরণ করিয়া লজ্জিত এবং মর্মাহত হইলেন। এক্ষণে প্রাণপাত করিয়াও সে কণ্টক উদ্ধার করিতে পারিলে, তিনি সুখী হইতে পারেন! স্বর্ণের ভবিষ্যৎ কি হইবে? কিরূপে ইদিলপুরের শ্রীনাথ চৌধুরীর সহিত বিবাহ-সম্পর্ক ভঙ্গ করিয়া ঈসা খাঁর সহিত স্বর্ণময়ীর উদ্বাহ ক্রিয়া সম্পন্ন করিবেন, তাহাই জহিরুল হকের একমাত্র চিন্তার বিষয় হইয়া উঠিল। স্বর্ণকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করিতে পারিলে শ্রীনাথ চৌধুরীর পাপ-পাণিপীড়ন হইতে তাহাকে রক্ষা করিতে পারা যায় বটে, কিন্তু ঈসা খাঁর জননী আয়েশা খানমের অমতে ঈসা খাঁর সহিত কিরূপে তাহাকে পরিণয়সূত্রে সম্মিলিত করা যাইবে, ইহাও এক গভীর সমস্যার বিষয়। অন্যদিকে স্বর্ণ মুসলমান হইলেই বা তাহাকে কোথায় আশ্রয় দেওয়া যাইবে? কেদার রায়ের রোষানলে দগ্ধিভূত হইতে কে স্বীকার করিবে।
জহিরুল হক স্বর্ণময়ী সম্বন্ধে অনেক চিন্তা করিলেন, কিন্তু মস্তিস্ক-সিন্ধু আলোড়ন করিয়াও কিছু স্থির করিতে পারিলেন না। অবশেষে অধীর হইয়া তাঁহার ধর্মগুরু ধর্মাত্মা হযরত সুফী মহীউদ্দীন শাহের চরণে সমস্ত বৃত্তান্ত বিষদরূপে বিবৃত করিলেন। শাহ সাহেব ক্ষণকালের জন্য নেত্র নিমীলিত করিয়া ধ্যানস্থ হইলেন। তৎপর বলিলেন, “কয়েকদিন অপেক্ষা কর, কি করতে হবে জানতে পারবে।”
২০.রায়-নন্দিনী – বিংশ পরিচ্ছেদঃ আত্মদান
অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমাংশ বিগতপ্রায়। স্বর্ণময়ীর বিবাহের আর দশ দিন মাত্র অবশিষ্ট। শ্রীপুরের রাজবাটীতে বিবাহের জন্য বিশেষ সমারোহ ব্যাপার। স্বর্ণের উদ্বেগ ও অশান্তি চরমে উঠিয়াছে। তাহার পরিণাম যে কি ভয়াবহ হইবে, ভাবিয়া তাহার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিতেছে। স্বর্ণের তপ্ত স্বর্ণের ন্যায় বর্ণ বিবর্ণ হইয়াছে। তাহার মুখ শুঙ্ক, বদনমণ্ডল মলিন! জহিরুল হকও বিশেষ চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন। তবে তাঁহার মহাজ্ঞানী মহীউদ্দীন সাহেবের বাক্যের উপরে নির্ভর করিয়াই কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত রহিয়াছেন।
ইতিমধ্যে অগ্রহায়ন মাসের ১৫ই তারিখ বৃহস্পতিবার প্রাতে সূফী মহীউদ্দীন সাহেব জহিরুল হককে ডাকিয়া বলিলেন, “এখনি তুমি রায়-নন্দিনীকে লয়ে বিজয়নগরে যাত্রা কর। তথায় গেলেই তোমাদের সিদ্ধ হবে।”
জহিরুল হক সূফী সাহেবের আদেশে আনন্দে উৎফুল্ল হইলেন। বিজয়নগর গমন কষ্টসাধ্য হইলেও, তথায় গমন করিলে সোনামণির অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে এই আশায় তাঁহার হৃদয়ে উৎসাহের সঞ্চার হইল। তাঁহার পরশ স্নেহপাত্রী, দুর্দিনের পরম বন্ধ সোনার মঙ্গল চিন্তায় জহিরুল হক ডুবিয়া গিয়াছিলেন; কাজেই তাহার সুখের জন্য যে কষ্ট স্বীকার, তাহা তাঁহার কাছে নূতন সুখের নিদান বলিয়াই বোধ হইল।
পরদিন নিশাশেষে ঊষার শুভ্র হাস্যরেখা প্রকাশিত হইবার পূর্বেই জহিরুল হক স্বর্ণময়ীকে লইয়া ছদ্মবেশে অশ্বারোহণে শ্রীপুর ত্যাগ করিলেন। জহিরুল হক দুইজন বিশ্বস্ত ভৃত্যকেও সঙ্গে লইলেন। স্বর্ণময়ী অশ্বারোহণে অনভ্যস্তা হইলেও কিছু দিনের মধ্যে অল্পে অল্পে কিঞ্চিৎ পটুতা লাভ করিল। জহিরুল হক সকল বিষয়েই পিতার ন্যায় স্বর্ণময়ীর যত্ন লইতে লাগিলেন। স্বর্ণময়ী নানাদেশ ও জনপদ, অসংখ্য নদী ও মাঠ, নগর ও পল্লী অতিক্রম করিয়া ঊনত্রিশ দিনে বিজয়নগরে উপস্থিত হইলেন।
ঈসা খাঁ তখন ঘোরতর পীড়িত। সেই বিষদিগ্ধ শল্যের আঘাতে তাঁহার বাণ্হুর বিয়দংশ পচিয়া গিয়াছে। জ্বরের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। শরীর শীর্ণ, কান্তি-শ্রী মলিল। সোলতান নিজাম শাহের খাস চিকিৎসক ‘জোবদাতল হোকামা’ আহমদুল্লাহ্ খান সাহেব বিশেষ যত্নে তখন চিকিৎসা করিতেছিলেন। ক্ষতস্থানের পচনক্রিয়া কিছুতেই বন্ধ হইতেছে না। ক্ষত শুঙ্ক না হওয়ার জন্য জ্বরও বন্ধ হইতেছে না। ঈসা খাঁ নিজের অনুচর ও ভৃত্যগণ এবং সোলতানের নিয়োজিত ব্যক্তিগণ প্রাণপণে তাঁহার সেবা-শুশ্রুষা করিতেছেন। স্বয়ং সোলতান নিজাম শাহ প্রতি শুক্রবারে তাঁহাকে দেখিতে আসেন।