অতঃপর স্বর্ণ সহসা একদিবস শিরঃপীড়ার ভাণ করিয়া আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিল। কোনও রূপেই সে শিরোবেদনার লাঘব হইল না, শিরঃপীড়ার সহিত নানা উপসর্গ আবিভূর্ত হইয়া স্বর্ণকে যারপর-নাই ব্যথিত করিয়া তুলিল। কবিরাজ এবং হাকিমগণ স্বর্ণের এই আকস্মিক ব্যধির কোন প্রতিকার করিতে পারিলেন না। অবশেষে স্বর্ণ একদিন শেষ রাত্রিতে গভীর চীৎকার করিয়া নিদ্রা হইতে শয্যায় উঠিয়া বসিল। স্বর্ণের জননী এবং পিতা সে-চীৎকারে ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া কারল জিজ্ঞাসু হইলে, স্বর্ণ বলিল, “উপাস্য কালিকাদেবী এসে রোষ-কষায়িতনেত্র গম্ভীরভাবে আমাকে বললেন যে, ‘তুই যদি বাঁচতে চাস, তা’ হ’লে তোর পিতাকে বলে কুলগুরুকে শীঘ্র মুক্ত করে যে নতুবা এই অগ্নিময় মুখে তোকে গ্রাস করব।’ এই মুখব্যাদান করলেন, অমনি তাঁর মুখ হতে ভীষণ অগ্নিশিখা বহির্গত হতে লাগল। ভয়ে আমি চীৎকার করে উঠলাম।”
স্বর্ণময়ীর স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনিয়া কেদার রায় তাহা যথার্থ বলিয়া বিশ্বাস করিলেন এবং কন্যার মঙ্গলাকাঙ্খায় পরদিন প্রত্যুষেই জহিরুল হককে কারামুক্ত করে দিলেন। জহিরুল হক স্বর্ণের উপস্থিত-বুদ্ধি এবং অসাধারণ সহানুভূতির পরিচয় পেয়ে পরমেশ্বরের সমীপে তাঁহার অজস্র মঙ্গল কামনা করিলেন। বলাবাহুল্য, সেইদিন দ্বিপ্রহর হইতে স্বর্ণময়ীর শিরঃপীড়া আরোগ্য হইল।
১৯.রায়-নন্দিনী – ঊনবিংশ পরিচ্ছেদঃ উৎকণ্ঠা
ঈসা খাঁ দাক্ষিণাত্যে জেহাদের জন্য গমন করিবার পরে স্বর্ণময়ী দুর্ভাবনায় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। পিতার অসম্মতি প্রকাশে এবং ঈসা খাঁর জেহাদ গমনে তাহার চিত্ত বিষম ব্যাকুল হইয়া পড়িল। হায়! সে যাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে আপনার হৃদয়-মন সমর্পণ করিয়া প্রেম-দেবতা রূপে বরণ করিয়া অন্তরের অন্তস্তম প্রদেশে প্রীতির সিংহাসনে বসাইয়াছে-যাঁহার রাতুল চরণে আপনার সর্বস্ব বিকাইয়া বসিয়াছে-নেত্রে তাঁহার পরমরূপ সর্বদা দীপ্তি পাইতেছে-কর্ণে যাঁহার প্রীতিমাখা মধুরবাণী সর্বদা পীযুষধারা বর্ষণ করিতেছে-হৃদয়ের প্রতি অণুপরমাণু যাঁহার প্রেম সুধায় আকৃষ্ট এবং বিহবল, তাহার সেই সুখদ বসন্তের প্রাণ-জুড়ান, মন-মাতান মলয় সমীকরণ, তাহার হৃদয়-আকশের সেই শরচ্ছন্দ্র, তাহার জীবন-মরুর সেই বর্ষণশীল-বারিদখণ্ড, তাহার আতপতগ্ধ পথের সেই সুশীতল বটচ্ছায়া, তৃষ্ণার্ত জীবনের সেই অমৃতনির্ঝরিণী, জীবনতরণীর সেই ধ্রুবতারা, মানসকুঞ্জের সেই বসরাই গোলাপ, তাহার পিতার অসম্মতিতে এবং স্বীয় জননীর অমতে তাহাকে আদর করিয়া চরণতলে স্থান দিতে কি সমর্থ হইবেন? তাহাকে কি তিনি স্মরণ করিতেছেন? তিনি কি তাহাকে উদ্ধার করিতে সমর্থ হইবেন? যদি না হন, কিংবা হায়! যদি ইচ্ছা না করেন, তবে কি হইবে? হায়! আমি যাঁহার পদে জীবন-যৌবন ডালি দিয়া বসিয়াছি, তাঁহাকে আমি পাইব না! তাঁহার চরণে আমাকে সমর্পণ করা হইবে না। কিন্তু যাহাকে আমি জানি না-চিনি না-চাই না, আমাকে নাকি তাহার হস্তেই দেওয়া হইবে। বিধাতঃ! ইহাই যদি ধর্ম হয়, তবে আর অধর্ম কাহাকে বলে? ইদিলপুরের শ্রীনাথ চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহের কথা নাকি পাকাপাকি হইয়াছে, অথচ আমি তাহার বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত অবগত নহি, ইহা অপেক্ষা স্ত্রী জাতির ভীষণ অত্যাচার আর কি হইতে পারে? হায়! হিন্দুজাতির বিচারে কি স্ত্রীলোকের আত্মা নাই!-বিচার নাই! নিজের সুখ-দুঃখ বোধ নাই! স্ত্রীলোক কি জড় পদার্থ কিংবা খেলার দ্রব্য, যে তাহার রুচি, অনুরাগ, ইচ্ছা এ-সমস্ত সম্বন্ধে কিছুই বিবেচনা করা হয় না-জিজ্ঞাসা করা হয় না! হা বিধাতঃ! ইচ্ছা এমন জাতিতে স্ত্রীলোক কেন জন্মে? যদি জন্মে তবে বাল্যেই মরে না কেন? যদি না মরে, তবে তাহার রুচি, অনুরাগ, বিচারশক্তি হরণ করা হয় না কেন?
থা’ক সে সব। এক্ষণে কোন পন্থা অবলম্বন করিব? হায়! কি কুক্ষণেই ঈসা খাঁর সেই চাঁদ বদন দর্শন করিয়াছিলেন। হায়! কিছুতেই যে সে মুখের শোভা, সে বিস্ফোরিত আঁখির মধুময়ী দৃষ্টি, সে কণ্ঠের অমৃত-নিস্যন্দিনীবাণী ভুলিতে পারি না। সে-হৃদয় যেন অফুরন্ত প্রেমপারাবার, তাহাতে ডুবিলে যেন সমস্ত জ্বালা জুড়াইয়া যায়। সমস্ত আকাঙ্খা পূর্ণ হয়। তাহাকে পাইলে আর কিছুই পাইতে বাকী থাকে না। তাঁহার কথা স্মরণে কত আনন্দ, কত উল্লাস। সে নাম স্মরণেও হৃদয়ে পরতে পরতে সুধা বঞ্চিত হয়! হায়! তেমন সুন্দর, তেমন প্রিয়, আনন্দকর আর কে? এইরূপ দুশ্চিন্তায় রায়-নন্দিনী দিন যাপন করিতে লাগিল।
আশ্বিন মাস যাইয়া কার্তিক মাস যায়। স্বর্ণময়ীর বিবাহের জন্য আয়োজন হইতে লাগিল। অগ্রহায়ণ মাসের ২৭শে তারিখে বিবাহ। রাজবাড়ীর দাস-দাসী, ভৃত্য, কর্মচারী, স্ত্রী ও পুরুষ সকলের মুখেই আনন্দ। সকলের মুখেই বিবাহের কথা। যতই বিবাহের দিন নিকটবর্তী হইতে লাগিল, স্বর্ণ ততই নিদাঘ-তাপ-দগ্ধ গোলাপের ন্যায়, শুঙ্ক এবং কর্দমে পতিত কমলের ন্যায় মলিত হইতে লাগিল। কি উপায় অবলম্বন করিলে, এ বিবাহ-পাশে হইতে উদ্ধার পাওয়া যাইবে, তাহা ভাবিয়া ভাবিয়া আকুল হইল। ঈসা খাঁকে প্রাণ-মন সমর্পণ করিয়া, তাঁহাকে হৃদয়-সিংহাসেন বরণ করিয়া বসাইয়া,-অন্যকে পাণিদান করিবে? না। না! তাহা কখনও হইবে না। এমন ব্যভিচার, এমন বিশ্বাসঘাতকতা, এমন অধর্ম কিছুতেই করিতে পারিবে না। তৎপরিবর্তে মৃত্যুতে আলিঙ্গন করা শতগুণে শ্রেয়ঃ। স্বর্ণ ভীষণ দুর্ভাবনায় দিনদিন বিবর্ণ ও বিশুঙ্ক হইতে লাগিল। তাহার পিতা, ঈসা খাঁর প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের পরে, ঈসা খাঁর মানসিক মতিগতি বা কি দাঁড়াইল, তাহাও জানিতে পারিল না। স্বর্ণের এই গভীর মনোবেদনা, চিত্তের অস্থিরতা, সরলা নাম্নী একজন সখী ব্যতীত আর কেহই জানিত না। স্বর্ণ তাহাকে জীবনের সুখ-দুঃখভাগিনী জানিয়া প্রাণের কথা মর্ম-ব্যথা সমস্তই অকপটে তাহার নিকট প্রকাশ করিত।