বিজয়নগরের চতুর্দিক সমুচ্চ সুদৃঢ় প্রাচীর এবং দুই শত হস্ত পরিমিত প্রশস্ত ও বিশ হস্ত গভীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। পরিখার গর্ভে নানাবিধ তীক্ষ্মাগ্র শেল, শূল ও লৌহদণ্ড প্রোথিত ছিল এবং প্রাচীরোপটি প্রস্তর নিক্ষেপের উপযোগী বণ্ডসংখ্যক যন্ত্র ও তোপশ্রেণী সজ্জিত ছিল। মুসলমান সৈন্য, নগরের সিংহদ্বারের নিকটবর্তী হইয়া প্রাচীর ভাঙ্গিবার জন্য একস্থান লক্ষ্য করিয়া অনবরত তোপ দাগিতে লাগিল। বিজয়নগরের পক্ষে পুর্তগীজ গোলন্দাজগণও যথাযথ তাহার উত্তর দিতে লাগিল।
পরিখা অতিক্রম করিতে না পারিলে নগর আক্রমণের বিশেষ সুবিধা নাই দেখিয়া নিজাম শাহ পরিখা উত্তীর্ণ হইবার জন্য কৌশল ও বুদ্ধি প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু সংখ্যক নৌকা নির্মাণপূবর্ক পরীখা উত্তীর্ণ হইবার জন্য চেষ্টা করা হইল। কিন্তু উহাতে কোনই সুফল ফলিল না। অবশেষে বহুসংখ্যক প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষ ও প্রস্তর নিক্ষেপপূর্বক সেতু নির্মাণের পরামর্শ স্থির হইল। তোপের আশ্রয়ে ঈসা খাঁ একদশ ধর্মযোদ্ধা লইয়া সেতু রচনা করিতে লাগিলেন। বিপক্ষের গোলা ও প্রস্তর নিক্ষেপে দলে দলে বীরপুরুষ হত হইতে লাগিলেন, কিন্তু সে-দিকে আজ কাহারও দৃকপাত নাই! অসংখ্য শবদেহে পরিখার গর্ভদেশের কিয়দংশ পরিপূর্ণ হইয়া গেল। পরিখার জল রক্তস্রোতে আরক্ত হইয়া উঠিল। বহ সাধনা এবং বহ প্রাণদানে সেতুর কতক অংশ নির্মিত হইল বটে, কিন্তু প্রাচীরের উপরিস্থ তোপখানা হইতে অজস্রধারে অব্যর্থ লক্ষ্যে গোলা ও প্রস্তর বর্ষণ হওয়ায় অবশিষ্ট অংশ নির্মাণ করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। ঈসা খাঁ এই প্রতিবন্ধকতায় আরও উত্তেজিত হইয়া ভীষণ গর্জন করিয়া উঠিলেন। বিংশতি হস্ত পরিমিত স্থান সেতু-নির্মাণ হইতে অবশিষ্ট ছিল। ঈসা খাঁ জলদগম্ভীর স্বরে সৈন্যবৃন্দকে আহবান করিয়া বলিলেন, “কে আছ আজ ধর্মপ্রাণ খোদাভক্ত সাচ্চা মুসলমান! এখনি এই সেতু হইতে আমার পশ্চাতে ঝাঁপাইয়া পড়। সাঁতার কাটিয়া এই অংশ অতিক্রম করিয়া দ্বারের মূলদেশে যেয়ে দ্বার ভাঙ্গবার চেষ্টা কর।”-এই কথা বলিয়া পাঠান-বীর উন্মত্তের ন্যায় পরিখার জলে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন।
তাঁহার সঙ্গে সহস্র সহস্র যোদ্ধা পরিখায় ঝাঁপাইয়া পড়িয়া পরপারে উত্তীর্ণ হইয়া আঁকশির সাহায্যে তীরে উঠিয়া দ্বারদেশ আক্রমণ করিলেন। সহস্রাধিক মুসলমান পরিখার জলগর্ভস্থ তীক্ষ্ণাগ্র অস্ত্রে এবং কামানের গোলার আঘাতে প্রাণত্যাগ করিলেন। ঈসা খাঁ পরিখা অতিক্রমকালে বাহুতে একটা তীক্ষ্ণাগ্র বিষাক্ত শূলের সাংঘাতিক আঘাত প্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু রণোন্মত্ত অবস্থার তিনি তাহা কিছুমাত্র অনুভব করিতে পারিবেন না। ভীষণ বিস্ফোরক প্রয়োগে সিংহদ্বার চুরমার হইয়া গেল। তখন শাণিত কৃপাণ হস্তে ‘দীন্ দীন্’ রবে মুসলমান বীরগণ ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় নগরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিল। সমর-কাণ্ড অতি প্রচণ্ড এবং লোমহর্ষণ-জনকভাবে চলিল! নাগরিক সৈন্যবৃন্দ রুদ্ধনিশ্বাসে আপনাদের বিক্রম নিঃশেষে একবার ভীষণ যুদ্ধোৎসাহ দেখাইল। কিন্ত উদ্বেলিত সাগর-প্রবাহের ন্যায় মুসলমান সৈন্যের প্রবেশ-গতি রোধ করে কাহার সাধ্য? অসংখ্য পৌত্তলিক যোদ্ধার ছিন্নমস্তকে রণভূমি দুর্গম হইয়া উঠিল। মহাবীর সোলতান নিজাম শাহ বিশ্বাসঘাতক রাম রায়ের অনুসন্ধান করিতে করিতে তাহাকে মৃতদেহপুঞ্জের মধ্যে আত্মলুক্কায়িতভাবে আবিস্কার করিয়া টানিয়া বাহির করিলেন। তাঁহার এই আত্মগোপনের ভাবে সকলেই হাস্য ও বিরূপ করিতে লাগিল। আহত হিন্দু সৈন্যগণ রাম রায়কে তিরস্কার ও অভিসম্পাত করিতে লাগিল। ঘৃণা ও লজ্জায় কাপুরুষ রাম রাজ্য সহসা মর্মে ছুরিকা বিদ্ধ করিয়া আত্মহত্যা করিলেন।
নগরবাসীগণ নিজাম শাহের আনুগত্য ও প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া পনের লক্ষ টাকা নজর প্রদান করিলেন। নিজাম শাহ দুর্গশীর্ষ হইতে ত্রিশূল-অঙ্কিত পতাকা ভূতলে নিক্ষেপ করতঃ স্বকীয় ঐসলামিক পতাকা প্রোথিত করিলেন। মোসলেম বীরগণ “আল্লাহ আকবর” রবে আকাশ-পাতাল কম্পিত করিয়া জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন। এইরূপে তালিকোট যুদ্ধে ফলে বিজয়নগর হিন্দু-শাসনের তামসী ছায়া হইতে উদ্ধার প্রাপ্ত হইয়া ঐসলামিক সুশাসনের উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হইল!
বিজয়নগরের বিজয় লাভের পরে মহাবীর ঈসা খাঁ দাক্ষিণাত্যের সোলতান ও প্রধান প্রধান সেনাপতিগণ কর্তৃক উচ্চকণ্ঠে প্রশংসিত হইলেন। তিনি যে বাহুতে বিষাক্ত শূলের আঘাত পাইয়াছিলেন, তাহারও চিকিৎসার বিশেষ বন্দোবস্ত হইল।
১৮.রায়-নন্দিনী – অষ্টাদশ পরিচ্ছেদঃ কুলগুর যশোদানন্দের ইসলামে দীক্ষা
শাহ সোলতান সুফী মহীউদ্দীন কাশ্মীরী শ্রীপুরে উপস্থিত হইবার অল্পকাল পরেই তাঁহার যশঃ-সৌরভে শ্রীপুর পূর্ণ হইয়া গেল। সহস্র সহস্র লোকের দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁহার পবিত্র কর-স্পর্শে বিলুপ্ত হইতে লাগিল। চতুর্দিক হইতে ধনী-দরিদ্র বহু মুসলমান আসিয়া তাঁহার উপদেশ-রসামৃত পান করিয়া পিপাসিত প্রাণ শীতল করিল। অনেক হিন্দুও তাঁহার অমৃতনিস্যন্দিনী বক্তৃতা এবং কোরানের ব্যাখ্যা শ্রবণে ইসলামের পবিত্র কলেমা পাঠ করিয়া আপনাদের জীবন পবিত্র করির। ফলতঃ, শ্রীপুরের রাজবাটীতে দুর্গোৎসব এবং শ্রীপুরের ঘাটে সূফী সাহেবের নিকট লোক-সমাগম ও দীক্ষার উৎসবে শ্রীপুর অহোরাত্র জন-কোলাহলে মুখরিত হইতে লাগিল। হিন্দু-ধর্মত্যাগী নব মুসলমানদের জন্য হিন্দু সমাজে বিষম আন্দোলন উপস্থিত হইল।