তিনি দেশের নানা স্থানে বহু ইন্দারা ও দীঘিকা খনন করেন। শুধু তাহাই নহে, গ্রাম্য রাস্তা নির্মাণ, মসজিদ, মাদ্রাসা স্থাপন ইত্যাদি বহু জনহিতকর সৎকার্যে তিনি প্রভূত অর্থ ব্যয় ও পরিশ্রম করিতেন। তিনি প্রত্যেক সভায় সমাগত হিন্দু-মুসলমানকে প্রাগুক্ত সংকার্যসমূহের জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করিতে বলিতেন। শ্রোতৃমণ্ডলী তাঁহার কথায় আনন্দের সহিত অর্থ দান করিত। এইরূপে নয় মাসে তিনি প্রায় লক্ষ টাকা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই টাকা সমস্তই পূর্বোক্ত সদনুষ্ঠানসমূহে ব্যয় করিয়াছিলেন। মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় স্বহস্তে তিনি ভিত্তি-প্রস্তর প্রতিষ্ঠিত করিতেন। ইদারা ও পুস্করিণী খননে দশ কোদাল করিয়া মাটি অগ্রে নিজে উঠাইতেন। রাস্তা নির্মাণেও সর্বাগ্রে নিজে মাটি কাটিয়া দিতেন। তাঁহারা এই প্রকার প্রবল লোকহিতৈষণার সকলেই মুগ্ধ হইয়া যাইত। হিন্দুরা তাঁহাকে দেবতা বলিয়া পূজা করিত।
তিনি প্রত্যহ অপর্যাপ্ত পরিমাণে যে সমস্ত ফল, মূল, চা’ল ডা’ল, তরিতরকারি, মৎস্য, খাসী, মোরগ, দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মাখন ও বস্ত্র উপহার পাইতেন, তাহা দীন-দুঃখী অনাথদিগকে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে বিতরণ করিতেন এবং কোন স্থান হইতে যাইবার পূর্বদিন মহাসমারোহপূর্বক সকলকে ভোজ দিতেন। ফলত, গঙ্গা যেমন হিমালয় হইতে নির্গত হইয়া বঙ্গের সমতলভূমিতে সহস্র শাখা বিস্তারপূর্বক সহস্র জল-প্রবাহে জমী উর্বরা করিয়া, মাঠে মাঠে সোনা ফলাইয়া, তৃষ্ণার জ্বারা দূরীভূত করিয়া, দেশের জঞ্জালজাল ভাসাইয়া লইয়া, পূণ্য-পূর্ণ তরণী বহিয়া, বায়ুকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ করিয়া, সমস্ত দেশে স্বাস্থ্য-শান্তি ও আনন্দ ছড়াইয়া কল কল নাদে আপন মনে বহিয়া যাইতেছে, মহাত্মা শাহ মহীউদ্দীন সাহেবও তেমনি প্রেম-পুণ্য-সত্যের আলোক-উজ্জ্বল উদার হৃদয় ও বিশ্বহিত-কামনায় সৌরভ-পূর্ণ মন লইয়া কাশ্মীর হইতে বাঙ্গালায় আসিয়া তরুচ্ছায়া-শীতল গ্রাম ও নগরে নবজীবন, নবআনন্দ ও নবপুলকের স্রোত গৃহে গৃহে প্রবাহিত করিতেছিলেন।
১৭.রায়-নন্দিনী – সপ্তদশ পরিচ্ছেদঃ তালিকোটের যুদ্ধ
বর্ষান্তে শরতের প্রারম্ভে দিঙ্ঘমণ্ডল পরিস্কৃত এবং ধরাতল সুগম হইলে, দাক্ষিণাত্যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সমর-দুন্দুভি বাজিয়া উঠিল। তালিকোটের প্রশস্ত ক্ষেত্রে উভয় বাহিনী পরস্পর বিজিগীষু হইয়া সম্মুখীন হইল। আহমদনগর, বিদর, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সোলতানদিগের সৈন্যের সহিত নানাস্থান হইতে স্বজাতীয় হিতাভিলাষী ইসলামের গৌরবাকাঙ্খী যুবক যোদ্ধৃগণ আসিয়া যোগদান করিলেন। বীরকুলচূড়ামণি সোলতান হোসেন নিজাম শাহ দেওয়ান মুসলিমবাহিনীর সেনাপতিত্ব গ্রহণ করিলেন। এই ভীষণ আক্রমণোদ্যত হইয়া অবস্থান করিবার পরে, একদা প্রত্যুষে একদল হিন্দু সৈন্য মুসলিম বাহিনীর এক অংশ আক্রমণ করিল। এই আক্রমণের ফলে সেইদিন উভয় পক্ষে ভীষণ সমর ঝটিকা প্রবাহিত হইল। মুসলমান সৈন্য জেহাদের নামে এবং হিন্দু সৈন্য রাজ্য-রক্ষা-কল্পে মত্ত হইয়া যুদ্ধ করিতে লাগিল। হায়, হস্তী এবং বীরপুরুষদিগের পদভরে পৃথিবী কম্পিত হইল। তরবারির চাঞ্চল্যে, বর্শার দীপ্তিতে অসংখ্য বিদ্যুদ্বিকাশ হইতে লাগিল! তোপের গর্জনে চতুর্দিক প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। অশ্বারোহী, পদাতিন এবং গোলন্দাজ সৈন্যগণ অসাধারণ রণ-কৌশল প্রকাশ করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিল। সমস্ত দিবসের ভীষণ যুদ্ধেও কোন পক্ষের জয়-পরাজয় নির্ণয় হইল না।
এইরূপ ক্রমাগত তিন দিবস ভীষণভাবে সময় চলিল। চতুর্থ দিবস মোসলেমবাহিনী বিপুল বিক্রমে হিন্দুদিগকে আক্রমণ করিল। গাজিগণ “আল্লাহু আকবর” রবে মুহুর্মুহু আকাশ-পাতাল কম্পিত করিয়া ব্যাঘ্রেরর ন্যায় দুর্ধর্ষ বিক্রমে শক্র-সৈন্য সংহার করিতে লাগিল।
বৈশাখ-বাত্যা-তাড়িত সমুদ্রের ন্যায়, রণক্ষেত্র ভয়াবহ আকার ধারন করিল। সহস্র সহস্র হিন্দু সৈন্য আহত ও নিহত হইয়া ভূপতিত হইতে লাগিল। অপরাহৃকালে মুসলমানের বীর্যপ্রতাপ রোধে অসমর্থ হইয়া হিন্দু সৈন্য পশ্চাতে হটিতে লাগিল। তাহারা ধীরে ধীরে পশ্চাতে হটিয়া একটি উচ্চাবচ ভূমিতে যাইয়া স্থির হইল।
পরদিবস প্রত্যুষে বিজয়নগরের সৈন্যদল সে-স্থান হইতেও বিতাড়িত হইল। তৎপর দিবস বিজয়নগর হইতে বহু সংখ্যক নূতন তোপের আমদানি হওয়ায় হিন্দুসেনা সাহসী হইয়া তেজের সহিত পর্তুগীজ গোলন্দাজগণ অবিশ্রান্ত গোলা নিক্ষেপে মুসলমান পক্ষের বহু ক্ষতি সাধন করিল। হোসেন নিজাম শাহ্ ক্রোধে সিংহের ন্যায় গর্জন করিয়া একদল যোদ্ধাকে প্রাণের মমতা ত্যাগ করিয়া তোপের উপর পড়িয়া, তোপ কাড়িয়া লইতে বলিলেন। বঙ্গীয় পাঠান-বীর ঈসা খাঁ তোপের উপর পড়িবার জন্য ৫০ জন আত্মোৎসর্গকারী বীরপুরুষকে আহবান করিলেন। তাঁহার আহবানে অধীনস্থ দুই সহস্র যোদ্ধার প্রত্যেকেই শহীদ হইবার জন্য লালায়িত হইয়া তোপ কাড়িয়া লইবার জন্য উদ্যত হইলেন। ঈসা খাঁ তাঁহাদের রণোন্মত্ততা দর্শনে অতিমাত্র উৎসাহিত হইলেন এবং সকলকে নিরস্ত করিয়া বঙ্গীয় যুবকদিগের মধ্য হইতে বিনা বিচারে পঞ্চাশজনকে গ্রহণপূর্বক বিদ্যুৎদ্বেগে তোপ লক্ষ্য করিয়া ঘোড়া ছুটাইলেন। বাজপক্ষী যত দ্রুত চটকের উপর বা নেকড়ে বাঘ যত সত্বর মেষপালের উপর উৎপতিত হয়, ঈসা খাঁ বাঙ্গালী যোদ্ধৃগণকে লইয়া তদপেক্ষাও তীব্র বেগে, ভীষণ ঝটিকাবর্তের ন্যায় মুক্ত কৃপাণ করে “আল্লাহু আকবর” রবে গোলন্দাজ সেনার উপরে পতিত হইলেন! গোলার আঘাতে ৪৩ জন্য সৈনিক এবং পঁয়ত্রিশটি অশ্বদেহ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেল। সাতজন মাত্র বীর করাল কৃপাণ করে তোপখানার উপর পতিত হইয়া তরবারির ক্ষিপ্র প্রহারে তোপ-পরিচালক গোলন্দাজগণকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিলেন। সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় তোপখানা রক্ষা করিবার জন্য চতুর্দিক হইতে সৈন্যদল আসিয়া ভীষণ বিক্রমে তাহাদিগের প্রতি অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিল। সপ্তজন মুসলমান গাজী রুদ্ধশ্বাসে চরম বিক্রমে তরবারি চালাইতে লাগিলেন। দুইজন বিশেষ আহত এবং অবশিষ্ট পাঁচজন শরীরের স্থানে স্থানে আঘাত প্রাপ্ত হইয়াও ক্ষুদ্র শৈলের ন্যায় অসংখ্য ভীষণ আক্রমণরূপ নদীর প্রবাহকে গুরুতর বাধা প্রদান করিলেন। ওদিকে মুসলিম বাহিনীর অগ্রগামী দলের সৈন্যদল আসিয়া পড়ায় হিন্দু সেনা তোপখানা পরিত্যাগ করিয়া বৃকতাড়িত শৃগালের ন্যায় পশ্চাদগামী হইল। মুসলমান সেনা তখন তোপের মুখ ফিরাইয়া হিন্দু সেনাকে লক্ষ্য করিয়া তোপ দাগিতে লাগিল। চতুর্দিকে বজ্রনির্ঘোষ-নিনাদিত বনভূমির ন্যায় ভীতিসঙ্কুল হইয়া উঠিল। তোপের গোলার অভাব হওয়ায় সোলতান নিজাম শাহ রাশি রাশি পয়সা পুরিয়া তোপ দাগিতে আদেশ করিলেন। তাহাতে গোলা অপেক্ষা অধিকতর সূফল ফলিল। পয়সাগুলি বিচ্ছুরিত হইয়া চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হওয়ায় বহুসংখ্য হিন্দু সেনা আহত এবং নিহত হইল। তাহার ফলে অবশিষ্ট সৈন্য-ব্যুহ ভগ্ন করিয়া নগরাভিমুখে পলায়ননপর হইল। মোসলেম সেনা পলায়নপর হিন্দু সেনার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়া তাহাদিগকে হত্যা করিতে লাগিল। হিন্দু সেনা নগরে প্রবেশ করিয়া নগরদ্বার রুদ্ধ করিল এবং নগর পরিবেষ্টন করিয়া যে পরিখা ছিল, তাহার সেতু তুলিয়া ফেলিল।