গডফ্রেঃ হাঃ ! হাঃ ! হাঃ ! লিঙ্গ হইটে জন্ম, বেশ কটা আছে। কিন্তু আমি মনে করি, লিঙ্গ পূজা টোমাডের··· পক্ষে ভাল হয়। টোমরা পুরুষ মানুষ আছ···· টোমরা শিবের লিঙ্গটা পূজা করিটে যাইবে কেন? হাঃ ! হাঃ ! হাঃ ! লিঙ্গ পূজা!!
এমন সময় পাল্কীর মধ্যে ফিঁকরিয়ে ফিঁকরিয়ে কাঁদিবার শব্দ শোনা গেল। সেই বলিষ্ঠকায় যুবকটির তখন পাল্কীর দরজা খুলিয়া প্রদীপটা লইয়া সম্মুখে ধরিয়া বলিল, “ঠাকুরাণি! ক্রন্দন করবেন না। ভয়ের কোনও কার নাই। আমরা আপনার কোন অনিষ্ট করবো না। আমরা যশোহরের অধীশ্বর প্রবল-প্রতাপ মহারাজ প্রতাপাদিত্যের লোক। মহারাজ আপনাকে বিবাহ করবার জন্য আপনার পিতা রাজা কেদার রায়ের নিকট পুনঃ পুনঃ প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু আপনার পিতা বহু সপত্নীর ভয়ে আপনাকে প্রতাপাদিত্যের করে সমর্পণ কোর্তে রাজী হন নি; আপনি অবশ্য তাহা অবগত আছেন। তাই আপনাকে আমরা লুঠে নেওয়ার জন্য এক বৎসর পর্যন্ত সুযোগ অনুসন্ধান করছিলাম। আপনার কোনও ভয় নাই। আপনি আমাদের মহারাজের সর্বাপেক্ষা পেয়ারের রাণী হবেন। চল্লিশ রাণীর উপরে আপনি আধিপত্য কোর্বেন। আর এরূপ লুঠে নেওয়ায় আপনার পিতার পক্ষে কোন কলঙ্কের কথা নাই। স্বয়ং ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের ভগ্নী সুভদ্রা দেবীকে মহাপুরুষ অর্জুন হরণ করেছিলেন। তাহাতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের প্রতি ক্রুদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে বরং অনুরাগীই হ’য়েছিলেন।” এমন সময় দরজায় যুগপৎ ভীষণ পদাঘাত ও বীর কণ্ঠে “কোন্ হ্যায়! দরওয়াজা খোল” শ্রুত হইল। ভীষণ পদাঘাতে দ্বারের ভিতর দিকের হুড়কা ভাঙ্গিয়া দ্বার খুলিয়া গেল। সহসা কম্পিত শিখা-প্রদীপের ক্ষীণালোক সেই আগন্তকের মুখের উপর পড়ায় দস্যুরা কম্পিত হৃদয়ে দেখিল,-এক তেজঃপুঞ্জ-বীরমূর্তি, উলঙ্গ-কৃপাণ-পাণি উষ্ণীষ-শীর্ষ মুসলমান যুবক, রোষ-কষায়িত-লোচনে মন্দির-প্রবেশে উদ্যত। যুবকের প্রশস্ত ও উজ্জ্বল চক্ষু হইতে কালানলজ্বালা নির্গত হইতেছে,-“কে তুমি? তুমি এখানে কেন? পলায়ন কর, এ শিব-মন্দির, এখানে মুসলমানের আশ্রয় নাই।” দস্যুদের কথা শেষ হইবার পূর্বেই যুবকের ভীষণ তরবারি-আঘাতে একজন দস্যুর বাহুর ছিন্ন এবং অপরের স্কন্ধ ভীষণরূপে কাটিয়া গেল। তখন দস্যুগণ প্রমাদ গণিয়া সকলে ভীষণ তেজে এক সঙ্গে তাঁহার উপর বজ্রের ন্যায় নিপতিত হইবার উপক্রম করিল। যুবক কৌশলে দ্বারের বাহিরে আসিয়া একপার্শ্বে তরবারি তুলিয়া দন্ডায়মান হইলেন। আক্রমণোদ্যত-দস্যু-মন্তক দ্বারের ভিতর আসিবামাত্রই তাঁহার শাণিত কৃপাণের বজ্র প্রহারে ছিন্ন হইতে লাগিল। লাঠি ও বল্লমের দণ্ডগুলি তরবারির আঘাতে খন্ড খন্ড হইয়া ছুটিয়া পড়িল। অল্প সময়ের মধ্যেই পাঁচজন নিহত এবং সাতজন ভীষণরূপে জখম হইল। রক্তধারা আসিয়া বাহিরের বৃষ্টিধারার সঙ্গে মিশিতে লাগিল। যুবকের বীর বিক্রম এবং অস্ত্র সঞ্চালনের অমোঘতা দর্শনে অবশিষ্ট পর্তুগীজ ও হিন্দু দস্যুগণ ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। সকলে বীর যুবকের পদে নিরীহ মেষের ন্যায় আত্মসমর্পণ করিবার জন্য আকুল হইয়া উঠিল। কিন্তু গড়ফ্রে তাহার বজ্রকণ্ঠ নিনাদিত করিয়া কহিল, “কভি নেহি, আভি হাম ফটে করে গা।” সে এই বলিয়া যুবককে লক্ষ্য করিয়া পিস্তল ছুঁড়িল। যুবক চকিতে মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। পিস্তলের গুলী মাথার উপর দিয়া বোঁ করিয়া চলিয়া গেল। যুবক পর মুহুর্তে চকিতে লস্ফ প্রদান করিয়া প্রসারিত করে তরবারি আস্ফালন করিলেন। তরবারি নামিবার সঙ্গে সঙ্গেই মহাকায় গডফ্রের মস্তকটি গ্রীবাচ্যুত হইয়া পক্ক তালের মত সশব্দে ভূপতিত হইল। অবশিষ্ঠ দস্যুগণ ভয়ে আড়ষ্টপ্রায় হইয়া মন্দিরের মধ্যে কাঁপিতে লাগিল। শিব-মন্দিরে মাত্র একটি দ্বার, সুতরাং দস্যুদিগের পলায়ন করিবার উপায় ছিল না। এক সঙ্গে সকলে সকলে মিলিয়া আক্রমণ করিবারও সুবিধা ছিল না। যুবক দ্বার অবরোধ করিয়া দন্ডায়মান। দুইজনের বেশি একসঙ্গে দ্বারের ভিতরে পাশাপাশি দাঁড়ান যাইতে পারে না।
যে দ্বারের নিকটবর্তী হইতেছিল, তাহারই মস্তক যুবকের অসি-প্রহারে ভূ-চুম্বন করিতেছিল। দস্যুগণ প্রাণ-ভয়ে আতঙ্কিত হইয়া প্রদীপ নির্বাপিত হওয়ায় সমস্তই ভীষণ অন্ধকারে ডুবিয়া গেল। চতুর্দিকে কেবল অন্ধকার-আর অন্ধকার! নিজের শরীর পর্যন্তও দেখা যাইতেছে না। দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া যুবক অবিরত বারিধারায় সিক্ত হইতেছিলেন। গাছের মাথা দোলাইয়া পাতা উড়াইয়া প্রবাহিত হইতেছিল। যুবক অন্ধকারে দাঁড়াইয়া ভাবিলেন, “দ্বার উন্মুক্ত রহিয়াছে, সুতরাং অন্ধকারের মধ্যে অলক্ষ্যে আসিয়া দস্যুগণ সহসা আক্রমণ করিতে পারে।” এজন্য দরজা টানিয়া বাহির হইতে বন্ধ করায় দস্যুরা আরও ভীত হইয়া পড়িল। রাত্রি প্রভাত হইবা মাত্র অথবা বৃষ্টি ও দুর্যোগ থামিয়া গেলে আরও লোকজন আসিয়া পড়িতে পারে। তাহারা বন্দী হইলে কেদার রায় যে জীবন্ত প্রোথিত করিবেন, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তখন দস্যুরা মন্দিরের ভিতর হইতে অতীব করুণ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “হুজুর! আমাদিগকে আল্লার ওয়াস্তে মাফ করুন। আমরা নরাধম প্রতাপাদিত্যের প্ররোচনায় বড়ই অন্যায় কার্যে হস্তক্ষেপ ক’রেছিলাম। আমাদের সুমচিত শিক্ষা ও দণ্ড হয়েছে। দোহাই আপনার, আমাদিগকে রক্ষা করুন। আমরা মা কালীর নামে শপথ করছি, জীবনে কদাপি আর এমন কার্যে লিপ্ত হ’ব না।”