দ্বি-প্রহরের প্রারম্ভে সমস্ত লোক চলিয়া গেলে, হযরত মহীউদ্দীন সাহেবের ভৃত্য, খাদেম ও শিষ্যগণ আহারের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইল। শাহ সাহেবের সঙ্গে তাঁহার অনুচর আটজন, বাবুর্চি একজন, খাদেম পাঁচজন এবং মাঝি-মাল্লা কুড়িজন, মোট চৌত্রিশ জন লোক ছিল। তিনি নিজের সম্পত্তি হইতে এই সমস্ত লোকের ব্যয়ভার বহন করিতেন। কাহারও নিকট হইতে অর্থাদি কিছু লইতেন না। তবে খাদ্যদ্রব্য উপহার স্বরূপ প্রদান করিলে, তিনি গ্রহণ করিতেন। তিনি প্রায় বারমাসই রোজা রাখিতেন। রাত্রিতে সামান্য কিছু দুগ্ধ, রুটি ও ফল-মূল ভক্ষণ করিতেন। মৎস্য, মাংস স্পর্শও করিতেন না। সমস্ত রাত্রি উপাসনা ও ধ্যান-ধারণায় রত থাকিতেন। ফজরের নামাজের পরে কোরআন শরীফের এক তৃতীয়াংশ আবৃত্তি করিতেন। তৎপর মধ্যাহৃ পর্যন্ত সমাগত লোকদিগকে উপদেশ ও রোগীদিগকে পানি পড়িয়া দিতেন। তাঁহার পানি পড়ায় সহস্র সহস্র ব্যক্তি রোগ-মুক্ত হইতেছিল। তিনি যেখানে যাইতেন সেইখানেই কবিরাজ ও হাকিমগণের অন্ন মারা যাইত। তাঁহার পানি পড়ার অদ্ভুত শক্তি দর্শনে লোক আর কবিরাজ বা হাকিমের কাছে ঘেঁষিত না। দুই দিনের রাস্তা হইতে লোক আসিয়া পাড়ি পড়াইয়া লইয়া যাইত, তিনি মধ্যাহ্নে জোহরের নামাজ পড়িয়া আসরের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত তিন ঘন্টা মাত্র ঘুমাইতেন। তাঁহার নিদ্রার এই এক আশ্চর্যত্ব ছিল যে, আসরের ওয়াকত হওয়া মাত্রই তিনি জাগ্রত হইতেন। বার বৎসরের মধ্যে তাঁহার এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয় নাই। আসরের নামাজ অন্তে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত কোন কোন দিন তিনি আধ্যাত্মিক-সঙ্গীত ও গজলের চর্চা করিতেন। কোন কোন দিন গ্রন্থ রচনা করিতেন। তৎপর সন্ধ্যার প্রাক্কালে খোলা মাঠে বা নদীর ধারে ভ্রমণ করিতেন এবং সান্ধ্যোপাসনা মুক্ত আকাশের নীচেই প্রায় সম্পন্ন করিতেন। মগরের বাদ কিঞ্চিৎ বিশ্রাম ও সমাগত লোকজনদিগকে উপদেশ দিতেন। তাঁহার স্বর অতীব মিষ্ট, সুস্পষ্ট এবং গম্ভীর ছিল। উপদেশ-স্রোতৃবর্গ তন্ময়চিত্ত হইয়া পড়িত। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত লোকজনের ভিড় কমিত না। মসলা-মসায়েল, ফতোয়া-ফারাজ এবং অধ্যাত্মা-নীতি সম্বন্ধে তাঁহাকে শত শত লোকের প্রশ্নোত্তর দিতে হইত। তাহাতে তিনি বিরক্তির পরিবর্তে আনন্দ প্রকাশ করিতেন। মওলানা, মুনশী, খোন্দকার ও মুফতিগণ তাঁহার নিকট নানা বিষয়ের মীমাংসার জন্য উপস্থিত হইতেন। সকাল হইতে রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত লোকারণ্যের হলহলায় দিঙ্মণ্ডল নিনাদিত হইত। তিনি যেস্থানে অবস্থান করিতেন, সেখানে দস্তুরমত হাট-বাজার ও থাকিবার চটী বসিয়া যাইত। রাত্রি দ্বিপ্রহরে লোকজন বিদায় হইলে তিনি নৈশ-উপাসনা সমাপ্ত করিয়া ধ্যানস্থ হইতেন। ফজরের সময় এই ধ্যান ভঙ্গ হইত। ধ্যানের সময় তাঁহার সর্বাঙ্গ হইতে এক প্রকার স্নিগ্ধ জ্যোতিঃ নির্গত হইত।
ফলতঃ শাহ্ মহীউদ্দীন একজন অসাধারণ জ্ঞানী এবং তপঃপ্রভাবসম্পন্ন বিশ্ব-প্রেমিক দরবেশ ছিলেন। আরবী, ফারসী, তুর্কী ও সংস্কৃত এই চারিটি ভাষায় তাঁহার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। সমগ্র কোরআন, হাদিস, মসনবী ও হাফেজ তাঁহার মুখস্থ ছিল। ইহা ছাড়া সংস্কৃত উপনিষদ, ষড়দর্শন ও গীতা তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাঁহার সংস্কৃত জ্ঞানের অগাধ পরিচয় পাইয়া চমৎকৃত হইয়া যাইতেন। ইতিহাস, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র এবং কাব্য এই চাবি বিষয়ে তাঁহারা অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও সূক্ষ্মদর্শিতা অভিব্যক্ত হইত। তাঁহার বজরাখানি আড়াই হাজারেরও উপর গ্রন্থে পরিপূর্ণ ছিল। বাল্যকাল হইতেই বিশ্বশোষিকা-জ্ঞানপিপাসা তাঁহাকে আকুল করিয়া তুলিয়াছিল। জ্ঞান-চর্চার ব্যাঘাত হইবে বলিয়াই তিনি দারপরিগ্রহ করেন নাই এবং নিজে যৌবরাজ্য অভিষিক্ত হইয়াও রাজ-সিংহাসন কনিষ্ঠকে সমর্পন করিয়াছিলেন। তিনি আদর্শ মুসলমানের ন্যায় জ্ঞানপিপাসু, উদারপ্রকৃতি, ধর্মনিষ্ঠ ও বিশ্বহিতৈষী পুরুষ ছিলেন।
নয় মাস কাল তিনি বাঙ্গালায় আসিয়াছেন। ইহার মধ্যে তিনি ৩৫ হাজার হিন্দুকে নানাপ্রকারের ভূত-প্রেত দৈত্য-দানবের কম্পিত বিশ্বাসের মসীমলিন অন্ধকার হইতে একমাত্র সচ্চিদানন্দ আল্লাহতালার উপাসনা অর্চনায় দীক্ষা দিয়া মুসলমান সমাজভুক্ত করিয়াছেন! তাহাদের টিকি কাটাইয়া, তিলক মুছাইয়া, গলার রসি খোলাইয়া, সভ্য-পরিচ্ছদে বিভূষিত করিয়াছেন। প্রাচীন হিন্দুরা যে মুসলমান ছিলেন, ইহা তিনি বেদ ও উপনিষদ হইতে প্রমাণ করিয়া হিন্দু পণ্ডিতদিগকে চমৎকৃত করিয়া দিতেন। প্রাচীন আর্যজাতি যে সর্বাংশে মুসলমানদিগেরই ন্যায় একেশ্বরবাদী ও একজাতিভুক্ত ছিলেন, তাঁহারা যে সাকার ও জড়োপাসনার বিরোধী, এমনকি তাঁহারা যে মুসলমানদিগেরই ন্যায় পরম উপাদেয় জ্ঞানে গোমাংস ভক্ষণ করিতেন’ এবং মৃতদেহগুলিকে নিষ্ঠুর ও পেশাচিকভাবে চিতায় দগ্ধ না করিয়া পরম যত্নে গোর দিতেন, তাহা তিনি বেদ, উপনিষদ ও পুরাণ হইতে তন্ন তন্ন করিয়া দেখাইয়া দিতেন। বিধবা-বিবাহের বহু ঘটনা ও শাস্ত্রীয় বাক্য প্রদর্শনপূর্বক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে পরাস্ত করিয়া দিতেন। আধুনিক হিন্দুগণ যে আদিম অসভ্য অনার্যজাতির সংশ্রবে মৃৎ-প্রস্তর উপাসক এবং ব্যবস্থাদাতা ব্রাহ্মণদিগের স্বার্থমূলক কূট ষড়যন্ত্রে পতিত হইয়া শতধাবিচ্ছিন্ন, কুসংস্কার-সম্পন্ন এবং ধর্মভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়াছে, তাহা তিনি এমনভাবে চক্ষে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক দেখাইয়া দিতেন যে, স্বার্থাদ্ধ ব্রাহ্মণেরাও অশ্রুপাত করিত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ ইত্যাদি দেব-দেবী যে আকাশ-কুসুমের ন্যায় কবি-কল্পিত তাহা ব্রাহ্মণগণও শেষে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেন। তাঁহার জ্ঞানগর্ভ অমৃত-নিস্যন্দিনী বক্তৃতা শ্রবণে পাঁচ হাজার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় লাভ করিয়া মানবজন্মের সার্থকতা সম্পাদন করেন। মহাতপা শাহ মহীউদ্দী পাঁচ লক্ষ মুসলমানকে শিষ্যত্ব দীতি করেন। শেরেক, বেদাত প্রভৃতি কুসংস্কার যাহা হিন্দু সংস্পর্শে মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, তিনি তাহা সমূলে উৎপাটিত করেন।