ইতিমধ্যে দরবেশের জপ শেষ হইলে তিনি বালকদিগকে অতি মধুর স্বরে বজরার নিকটে আহবান করিয়া হাস্যমুখে নিতান্ত স্নেহের সহিত সকলের নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। বালক-বালিকারা তাঁহার মধুর আহবানে একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেল। নৌকায় যথেষ্ঠ পরিমাণে বর্তমান-কলা ও মিঠাই ছিল। তিনি প্রত্যেক বালককে পাঁচটি করিয়া কলা ও পাঁচটি করিয়া সন্দেশ পরম স্নেহের সহিত দিতে লাগিলেন। বালকদের মধ্যে সন্দেশ লইতে প্রথমে অনেকেই ইতস্ততঃ করিলেও পরে আগ্রহের সহিত তাহা গ্রহণ করিল। বালকেরা সকলেই হিন্দু। তন্মধ্যে ১৪/১৫ জন গোঁড়া ব্রাহ্মণ-সন্তান। শাহ সাহেব কদলী ও মিঠাই বণ্টন করিয়া কলা সকলকেই খাইতে বলিলেন। তাহারা মন্ত্র-মুগ্ধবৎ সেই বজরার দুই পার্শ্বে বসিয়া স্বচ্ছন্দে কলা ও সন্দেশ খাইতে লাগিল। সেই সময় অনেক হিন্দু পুরুষ ও রমণী দণ্ডায়মান হইয়া ভিড় করিয়া তামাসা দেখিতেছিল। সকলেই যেন পুত্তলিকাবৎ নীরব ও নিস্পন্দভাবে দাঁড়াইয়া সেই মহাপুরুষের দেব-বাঞ্জিত-মূর্তি ও বালকদের প্রতি জননী-সুলভ মমতা দর্শন করিতে লাগিল।
বালকদের মধ্যে একটি ছেলেকে রোগা দেখিয়া শাহ সাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার জ্বর হয় কি?” সে মাথা নাড়িয়া মৃদুস্বরে বলিল, “হু”। দরবেশ সাহেব মনে মনে কি পড়িয়া ফুঁ দিলেন এবং তাহাকে বলিলেন, “তোমার জ্বর হবে না।” বালক বলিল, “বিকালে আমার জ্বর আসবে। এ জ্বরে কোনও চিকিৎসায় ফল করে নাই।” দরবেশ বলিলেন, “আচ্ছ বাবা! বিকালে একবার এসো, তোমার জ্বর আসে কি-না দেখা যাবে। তোমাদের বাড়ী কত দূরে, “ঐ যে, আমাদের বাড়ীর তালগাছ দেখা যাচ্ছে।” একটি বালককে জ্বরের জন্য ফুৎকার দিতে দেখিয়া আর একটি বালক বলিল, “আমার একটি ছোট ভাই ক’মাস থেকে পেটের অসুখে ভুগছে।” দরবেশ বলিলেন, “বাড়ী হ’তে মাটির একটি নূতন পাত্র নিয়ে এস, আমি পানি পড়ে দিব। তোমার ছোট ভাই-এর অসুখ ভাল হয়ে যাবে।” নীলাম্বরী-পরিহিতা প্রফুল্লমুখী একটি বালিকা অনেকক্ষণ দরবেশের নিকট বসিয়া তাহার মুখের দিকে এতক্ষণ পর্যন্ত আগ্রহ ও প্রীতিমাখা দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল। কখন দরবেশ মুখ ফিরাইবেন তাহার প্রতীক্ষা করিতেছিল। এইবার দরবেশ মুখ ফিরাইলে সে তাহার দক্ষিণ হস্তের তর্জনী বাম হস্তের দুইটি অঙ্গুলীর দ্বারা চাপিয়া ধরিয়া আধ আধ স্বরে বেশ একটু ভঙ্গিমার সহিত মুখ নাড়িয়া বলিল, “আমার আঙ্গুলটা কে’টে গে’ছে, ব্যথা করছে।” দরবেশ সস্নেহে তাহার চিবুক ধরিয়া বলিলেন, “কেমন ক’রে হাত কেটেছে?”
বালিকাঃ আমার পুতুলের ছেলের বিয়ের তরকারি কুটতে কেটে গেছে।
দরবেশঃ তোমার পুতুলের ছেলে আছে? তার বিয়ে হ’য়েছে?
বালিকাঃ হ্যাঁ, আপনি দেখবেন?
দরবেশ সাহেব বালিকার মতলব বুঝিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, বিকালে নিয়ে এস, দেখব-এই বলিয়া তিনি বালিকার আঙ্গুলে ফুৎকার দিয়া বলিলেন, “তোমার বেদনা সে’রে গেছে!” বালিকা কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া আশ্চর্যের সহিত বলিল “কৈ! আর ত বেদনা করে না! বা! আপনার ফুঁতে বেদনা সে’রে গেল।”
তখন স্বর্ণপ্রসবিনী ভারতবর্ষের রম্যোদ্যান বঙ্গভূমি, আজকালকার মত রেলের কল্যাণে নদনদীর স্রোত বন্ধ হইয়া ম্যালেরিয়া প্রিয় নিকেতনে পরিণত হইয়াছিল না; তাই সেই বহু সংখ্যক বালক-বালিকার মধ্যে একটি মাত্র রুগ্ন বালক ছিল। বালক-বালিকারা সুফী সাহেবের নিকট হইতে ক্রমে ক্রমে বিদায় লইল। যে সমস্ত বয়স্ক লোক দাঁড়াইয়াছিল, দরবেশ সাহেব তাহাদিগকে স্থানীয় নানা তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিলেন। লোক-সংখ্যা কত, মুসলমান কত, কেদার রায় কেমন লোক, স্থানীয় আবহাওয়া কেমন, জিনিসপত্র কেমন পাওয়া যায়, লোকের চরিত্র, শিক্ষা ও ধর্মানুরাগ কেমন, কত সম্প্রদায়, কত জাতি, কি কি পূজা-পদ্ধতি চলিত আছে ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি উপস্থিত জনসাধারণকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। তাহারাও যথাযথ উত্তর দিতে লাগিল। কেবল কেদার রায় কেমন লোক, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই থতমত খাইয়া পরে বলিল, “ভাল লোক। অনেক লোক-লস্কর আছে; বাঙ্গালার নবাবের খাজনা দুই বৎসর হ’ল বন্ধ করেছে।”
দরবেশ সাহেব প্রশ্নোত্তর হইতে বুঝিতে পারিলেন, স্থানটি বেশ স্বাস্থ্যকর। মৎস্য ও তরিতরকারি অপর্যাপ্ত। অধিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু। সাধারণতঃ লোক সকল অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কেদার রায় ও তাঁহার ভ্রাতা চাঁদ রায় সামান্য একটু বাঙ্গালা ও ফারসী জানেন। কেদার রায় অপেক্ষা চাঁদ রায় কম নিষ্ঠুর ও উদার প্রকৃতি। কেদার রায় গণ্ডমূর্খ, হঠকারী এবং কুপমণ্ডুকবৎ সংকীর্ণ-জ্ঞান বলিয়া নিজেকে সত্য সত্যই প্রতাপশালী, বিশেষ পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজা বলিয়াই মনে করেন। বাঙ্গালার নবাব দায়ুদ খাঁর পতনে রাজ্যের বিশৃঙ্খলা ঘটায় তিনি খাজনা বন্ধ করিয়া তাঁহার প্রজামণ্ডলীর মধ্যে নিজেকে স্বাধীন নরপতি বলিয়া প্রচার করিতে কুণ্ঠিত হন নাই, তবে রাজছত্র ধারণ ও মুদ্রাঙ্কনে এখনও সাহসী হন নাই।
কেদার রায় ঈসা খাঁকে সম্মুখে ভক্তিশ্রৈদ্ধা প্রদর্শন ও হাত-জোড় করিয়া বাধ্যতা স্বীকার করিলেও তাঁহাকে স্বীয় আধিপত্য বৃদ্ধির পথের কণ্টক স্বরূপ বিবেচনা করেন। ঈসা খাঁ ও তাঁহার স্বর্গীয় পিতা উপকার ব্যতীত কেদার রায়ের কখনও অপকার করেন নাই। বলিতে গেলে ঈসা খাঁর বন্ধুভাবই তাঁহার রাজ্যরক্ষার অবলম্বন-স্বরূপ হইয়াছে। ঈসা খাঁ কেদার রায়ের হিতৈষী না হইলে, ভুলুয়ার প্রবল প্রতাপান্বিত ফজল গাজীর তরবারি ও কামানের মুখে কোন দিন শ্রীপুর শ্রীশূন্য হইয়া যাইত। ঈসা খাঁর আনুকূল্যেই কেদার রায় অন্যান্য জমিদারের বহু এলাকা হস্তগত করিতে সমর্থ হইয়াছেন।