আজ আশ্বিনের পঁচিশ তারিখ। দুর্গা পূজার ষষ্ঠী। বাঙ্গালার পাখী-ডাকা ছায়া-ঢাকা পল্লীর শান্ত শীতল বক্ষে আনন্দের স্রোত শতধারায় প্রবাহিত! বালক-বালিকারা নানা প্রকার রঙ্গীন বস্ত্রে বিভূষিত হইয়া আনন্দে নৃত্য করিয়া বেড়াইতেছে। কেহ কেহ বা উদ্যানে মালঞ্চে, গৃহস্থের বাটীর প্রাঙ্গণে ফুলের সাজি লইয়া ফুল তুলিতেছে। গ্রামে গ্রামে জোড়-কাঠিতে ঢাক বাজিতেছে। প্রবল প্রতাপ রাজা কেদার রায়ের বাসস্থান শ্রীপুরে আজ আড়ম্বরের সীমা নাই। আজ কেদার রায়ের বাড়ীতে মহাসমারোহ। বাড়ীর উদ্যান সংলগ্ন প্রকাণ্ড মণ্ডপদালানে দুর্গা প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। ত্রিশটি প্রকাণ্ড স্তম্ভের উপর মন্দির সংস্থাপিত। কেদার রায়, বিজয়নগরনিবাসী একজন ইরানী মুসলমান ইঞ্জিনিয়ারের দ্বারা এই মন্দির গঠন করিয়াছেন। ইহা প্রাচীন ধরনের ভিতরে অন্ধকারপূর্ণ ক্ষুদ্র দ্বারবিশিষ্ট মন্দিরের ন্যায় নহে। মসজিদের নিদর্শনে ইহা অনেকটা উন্নত আদর্শে প্রস্তুত। থামগুলি বেশ উচ্চ এবং দ্বার ও জানালা প্রশস্ত। এই মন্দিরেই শ্রী শ্রীমতি দুর্গাদেবীর সিংহ-বাহিনী দশভুজা প্রকাণ্ড মূর্তি, গণেশ, লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতী ও অসুরের সহিত প্রতিষ্ঠিত।
মন্দিরের সম্মুখে প্রশস্ত নাট-মন্দির। নাট-মন্দির বিবিধ সজ্জায সজ্জিত। উহাতে ঝাড়, ফানুস, লন্ঠনের সঙ্গে সুপক্ক কলার কাঁদী ও রঙ্গীন কাগজের ফুলের ঝাড়ও ঝুলিতেছে। দিল্লীর চিত্রকরদের অঙ্কিত কয়েকখানি সুন্দর পটও সোনা-রূপার কাঠাম বা ফ্রেমে শোভা পাইতেছে। দলে দলে লোক পূজা-বাড়ীতে আসিতেছে ও যাইতেছে। নানা স্থান হইতে ভারে ভারে ফলমূল তরিতরকারি অনবরত আসিতেছে। মন্দির দক্ষিণ-দ্বারী। মন্দিরের পূর্ণ-পার্শ্বে একটি প্রকাণ্ড ফল-ফুলের বাগান। সেই বাগানের পূর্বে একটি ইষ্টক-মণ্ডিত পথ। যে পথের নীচেই স্বচ্ছ-সলিলা ইচ্ছামতী কল কল করিয়া দিবারাত্রি আপন মনে প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে।
নদীর ঘাট অনেক দূর পর্যন্ত সুন্দররূপে বাঁধান। নৌকাযোগে নানা স্থান হইতে নানা দ্রব্য আসিয়া ঘাটে পৌঁছিতেছে। আর ভারীরা তাহা ক্রমাগত ভুঁইয়া বাড়ীতে বহন করিয়া হইতেছে। ঘাটে কয়েকখানি পিনীস, বজরা ও ডিঙ্গি বাঁধা রহিয়াছে। ঘাটে রাজবাড়ী ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য বাটীর বহু স্ত্রীলোক স্নান করিতেছে। এলায়িত-কেশা, সিক্ত-বস্ত্রা পদ্মমুখী শ্রীমতীদের মুখে বাল তপন তাহার কিরণ মাখাইয়া সৌন্দর্যের লহরী ফুটাইয়া তুলিয়াছে। কোন রমণী গ্রীবা হেলাইয়া দীর্ঘ কুন্তলরাশি সাজিমাটী ও খৈল-সংযোগে পরিস্কার করিতেছে। কোন নারী কাপড় ধুইতেছে। বালিকার দল পা নাচাইয়া জল ছিটাইয়া সাঁতার কাটিতেছে। যুবতীরা ঈষৎ ঘোমটা দিয়া আব জলে নামিয়া শরীর মর্দন করিতেছে এবং মাঝে মাঝে আড়চক্ষে সম্মুখ দিয়া নৌকায় কাহারা যাইতেছে, তাহা দেখিয়া লইতেছে। প্রবীণরা ঘাটে বসিয়া কেহ কেহ সূর্যপূজার মন্ত্র আওড়াইতেছে। কেহ কেহ পিতলের ঘটি ও কলসী মাজিয়া এমন ঝকঝকে করিতেছে যে, উহাতে সূর্যের ছবি প্রতিবিম্বিত হইয়া ঝলমল করিয়া সোনার ন্যায় জ্বলিতেছে। হায়! মানুষ নিজের মনটি যদি এমন করিয়া মাজিত, তাহা হইলে উহাতে বিশ্ব-সূর্য পরমেশ্বরের জ্যোতিঃপাতে কি অপূর্ব শোভাই না ধারণ করিত! মানুষ নিজের ঘটি-বাটী, এমনকি জুতা জোড়াটি যেমন পরিস্কারর রাখে, মনকে তেমন রাখে না। অথচ মানুষই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান।
কোন যুবতী স্নানান্তে কলসী কক্ষে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতেছে। ঘাটের দক্ষিণ-পার্শ্বে কতিপয় পুরুষও স্নান করিতেছিল। একটি প্রফুল্ল মূর্তি ব্রাহ্মণ পৈতা হাতে জড়াইয়া মন্ত্র জপ করিতেছে। তাহার পার্শ্বে ফুটন্ত গোলাপের মত একটি শিশু স্নানান্তে উলঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়া আঙ্গুল চুষিতেছে এবং এক দৃষ্টে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের জপ, মন্ত্র-ভঙ্গী এবং জল ছিটান দেখিতেছে। বোধ হয়, তাহার কাছে এ-সমস্তই অর্থশূন্য অথচ কৌতুকাবহ মনে হইতেছে। সে এক এক বার মনে মনে ভাবিতেছে যে, তাহার ঠাকুরদাদা জল লইয়া এক রকম খেলা করিতেছে! কিন্তু পরক্ষণেই তাহার মুখের গাম্ভীর্য বালকের ধারণা নষ্ট করিয়া দিতেছে। এ-সংসারে গাম্ভীর্যের প্রভাবেই অনেক হালকা জিনিস গুরু এবং গুরু জিনিসও গাম্ভীর্যের অভাবেই হালকা হইয়া পড়ে।
শ্রীপুরের ঘাটে দুর্গোৎসবের ষষ্ঠীর দিনে প্রাতঃকালে যখন এই প্রকার রমণীদিগেন স্নানের হাট বসিয়াছে, সেই সময়ে একখানি সবুজবর্ণ অতি সুন্দর প্রকাণ্ড বজরা, একখানি পিনীস ও একখানি বৃহদারের ডিঙ্গিসহ আসিয়া ঘাটে ভিড়িল।
বজরায় খুব বড় একটি ডঙ্কা ছিল। বজরা কুলে লাগিবা মাত্রই একজন লোক সেই ডঙ্কা পিটিতে লাগিল। ডঙ্কার আওয়াজে সমস্ত গ্রামখানি যেন প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। অনেক বাড়ীতেই তখন পূজার ঢাক বাজিতেছিল। ডঙ্কার আওয়াজে ঢাকের শব্দ তলাইয়া গেল। ডঙ্কার তুমুল ধ্বনি শুনিয়া ছেলের দল এবং অনেক কৌতুহলী ব্যক্তি বজরার দিকে ছুটিল।
বজরার মধ্যে একটি প্রশস্ত কক্ষে একখানি ব্যাঘ্রর্মাসনে এক তেজঃপুঞ্জ মূর্তি দিব্যকান্তি দরবেশ বসিয়া তসবী জপিতেছিলেন। তাঁহার মুখমণ্ডল জ্যোতির্ময়, গম্ভীর অথচ ঈষৎ হাস্যময় এবং প্রশান্ত। তাঁহার চেহারার লাবণ্য, দীপ্তি এবং প্রশান্ততা দেখিলেই তিনি যে একজন প্রতিভাশালী পিরহান, তাহার উপরে একটি সদরিয়া এবং মাথায় শ্বেতবর্ণ পাগড়ী। পরিধানে পা’জামা। এই সামান্য বস্ত্রেই তাঁহাকে বেশ মানাইয়াছে। তাপসের বয়স পঞ্চাশের উপর নহে। তাঁহার সর্বাঙ্গের গঠন সুন্দর, দোহারা। মুখে অর্ধহস্ত পরিমিত দীর্ঘ মসৃণ কৃষ্ণশ্মাশ্রু শোভা পাইতেছে। গ্রীবাদেশের চতুস্পার্শে বাবরীগুলি ঝুলিয়া পড়িয়াছে। দুই পার্শ্বের জোলফ প্রভাত বায়ুতে ঈষৎ আন্দোলিত হইতেছে। যেন দুইটি কালো সর্প দুই পার্শ্বে ঝুলিয়া পড়িয়া দোল খাইতেছে। যে আসিতেছে, সেই তাঁহারা সম্মুখে আসিয়া মস্তক নত করিতেছে। তাঁহাকে দেখিয়া কেহ অগ্রসর হইতেও পারিতেছে না, পিছাইতেও পারিতেছে না। চঞ্চলমতি কলহপ্রিয় ছেলে মেয়েরা যাহারা মুহূর্ত পূর্বে ভীষণ কোলাহলে প্রভাত আকাশ মুখরিত করিয়া তুলিয়াছিল, তাহারাও দরবেশের দিকে মুখ তুলিয়া কেহ তাকাইতেও পারিতেছে না। জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁহার পরিচয় জানিবার জন্য বজরা সংলগ্ন ডিঙ্গীতে যাইয়া একজন লোককে জিজ্ঞাসা করিল। তাহার মুখে ব্রাহ্মণ জানিতে পারিল যে, দরবেশের নাম শাহ সোলতান সুফী মহীউদ্দীন কাশ্মীরী। তিনি কাশ্মীরের কোনও রাজপুত্র। রাজসিংহাসন ত্যাগ করিয়া দীর্ঘকাল শাস্ত্রালোচনা ও তপস্যা দ্বারা সিদ্ধি লাভ করতঃ ধর্ম-প্রচার উপলক্ষে কিয়র্দ্দিন হইল নিন্ম-বঙ্গে আগমন করিয়াছেন।