অতঃপর ঈসা খাঁ অরুণাবতীর বিবাহের কথা পাড়িলেন। প্রতাপ সাশ্রুনেত্রে বলিলেন, “সেনাপতি সাহেবের সঙ্গে পূর্ব হতেই অরুণাবতীর বিবাহ দিবার জন্য আমার সংকল্প ছিল। আমার দুর্গতিবশঃই তাঁর সহিত আমার বিরোধ ও শক্রতা জন্মে ছিল, কিন্তু তিনি আজ আমাকে আসন্ন মৃত্যু হ’তে রক্ষা করেছেন। তাঁর উদারতা ও মহত্ত্বে আমি যথেষ্ট লজ্জিত এবং আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। তাঁর ন্যায় মহানুভব এবং হৃদয়বান পরমোপকারী ব্যক্তির করে কন্যাদান করতে পারলে এণে আমি পরম সুখ ও গৌরব অনুভব করব। আমার অরুণাবতী-রূপ মাধবীলতা উপযুক্ত সহকারকেই আশ্রয় করেছে।” অতঃপর প্রতাপাদিত্য বিবাহের তারিখ নির্দ্দিষ্ট করিয়া অরুণাবতীকে সঙ্গে যশোহরে ফিরিয়া গেলেন।
মাহতাব খাঁ ঈসা খাঁর সৈন্যদলে চাকুরী গ্রহণ করিলেন। প্রতাপাদিত্য রাজধানীতে প্রত্যাগত হইয়া কয়েকদিন পরে, গভীর দুঃখ এবং শোকের সহিত ঈসা খাঁ ও মাহতাব খাঁকে লিখিয়া জানাইলেন যে, বসস্ত রোগের আক্রমণে অরুণাবতী সহসা পরলোকগমন করিয়াছে। মাহতাব খাঁ এই দারুণ সংবাদে মর্মাহত হইয়া পড়িলেন। আশার জ্যোৎস্না চির আঁধারে ঢালিয়া গেল। অরুণাবতীর যে অরুণিমাজাল তাঁহার হৃদয়ে আলোক-প্রবাহ ও আনন্দের উৎস সৃষ্টি করিল। হায় প্রেম! হায় সুখ! তোমাদের আশা এমনি করিয়া মানুষের হৃদয় চিরকাল ভাঙ্গিতেছে, জ্বালাইতেছে এবং নিস্পেষণ করিতেছে। তোমাদের দুইজনের মোহে এই বিশ্ব-সংসার মুগ্ধ হইয়া ছুটিতেছে। তাহার ফলে-নিরাশা, অবিশ্বাস, অপ্রাপ্তি; তাহার ফলে-শোক, দুঃখ, বিষাদ ও হাহাকার বিশ্ব-সংসার পরিপূর্ণ হইতেছে। ঈসা খাঁ এই আকস্মিক দুর্ঘনায় যার পর ব্যথিত হইলেন। তিনি মাহতাব খাঁর প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করিয়া তাহাকে নানারূপে সান্তনা করিতে ও প্রবোধ দিতে লাগিলেন। অন্য স্থানে তাঁহার বিবাহের প্রস্তাব করিতে চাহিলেন। কিন্তু মাহতাব খাঁ আর বিবাহ করিবেন না বলিয়া দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেন।
১৪.রায়-নন্দিনী – চতুর্দশ পরিচ্ছেদঃ তালিকোট যুদ্ধের সূচনা
খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে দাক্ষিণাত্যে পাঁচটি স্বাধীন খণ্ডরাজ্য ছিল। এই পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে বিজয়নগর নামক সর্বপ্রধান রাজ্যটি হিন্দু রাজ্য এবং আহমদনগর, বিদর, বিজাপুর, গোলকুণ্ডা এই চারটি মুসলমান-রাজ্য ছিল। বিজয়নগরের হিন্দু রাজারা বরাবর মুসলমান-রাজ্য চতুষ্টয়ের সহিত মৈত্রী ও সৌহার্দ্য স্থাপন করিয়া দিন দিন প্রতিপত্তি ও সম্ভ্রম বৃদ্ধি করিতেছিলেন। বিজয়নগরের রাজারা সর্বদাই মুসলমানদিগের সন্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করিয়া চলিতেন। সুতরাং এই রাজ্যের হিন্দু-রাজত্ব লোপ করিয়াবার জন্য নিত্য-জয়শীল কোনও মুসলমান বীরপুরুষ কদাপি উদ্যোগী হন নাই। কিছুকাল পরে মুসলমান নরপাল চতুষ্টয়ের মধ্যে ভয়ানক গৃহ-বিবাদের সূচনা হইল। এই গৃহ-বিবাদের পরিণামে দাক্ষিণাত্যের সোলতানেরা পরস্পরের বল ক্ষয় করিয়া কথঞ্চিৎ দুর্বল হইয়া পড়িলেন। এই সময়ে বিজাপুরের সোলতানের সহিত বিজয়নগরের রামরায়ের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। এই সংঘর্ষ লোকক্ষয়কর যুদ্ধে পরিণত হয়। আহমদনগরের সোলতান রাম রায়ের পক্ষ অবলম্বন করতঃ বিজাপুরের দর্প চূর্ণ করিবার জন্য সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে উপনীত হন। বিজয়নগর এবং আহমদনগরের সম্মিলিত বিপুল বাহিনীর বীর্য প্রতাপে বিজাপুরের সোলতান শোচনীয়রূপে পরাজিত হন। এই বিজয় লাভে এবং মুসলমান সোলতানগণের অনৈক্য দর্শনে রাম রায় নিতান্ত স্পর্ধিত, অহঙ্কৃত এবং মুসলমানের সর্বনাশ সাধনে বিশেষ উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। দাক্ষিণাত্যে মুসলমান ও ইসলামের আধিপত্য এবং প্রভাব নাশ করিবার জন্য বিপুল সৈন্য গঠন করিতে থাকেন। ওলন্দাজ ও পর্তুগীজদিগের সাহায্যে একদল সুদক্ষ গোলন্দাজ সৈন্য গঠন করেন। গোপনে তোপ-কামান ও বন্দুক প্রচুর পরিণামে প্রস্তুত ও সংগ্রহ করিতে থাকেন। বিজয়নগরাধিপতি যে মুসলমান ধ্বংসের জন্য এরূপ দুরাকাঙ্খার বশীভূত হইবেন, দাক্ষিণাত্যে মুসলমান সোলতানেরা কদাপি তাহা স্বপ্নেও চিন্তা করেন নাই। তাঁহারা তখন ঘোরতার গৃহ-বিবাদে লিপ্ত। বিজয়নগরের বিপুল সংখ্যক হিন্দু অধিবাসী, মুসলমানের চিরনির্বাসন ও সবংশে ধ্বংস কল্পনা করিয়া আনন্দে উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠে। তাহাদের উন্মত্ততা পরিশেষে সংহারক মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া বিজয়নগরের মুসলমান সংহারে প্রবৃত্ত হয়। বিজয়নগরে নানাদেশীয় কয়েক সহস্র মুসলমান ব্যবসায়-বাণিজ্য উপলক্ষে বাস করিতেন। একদা গভীর রাত্রিতে হিন্দুরা দল বাঁধিয়া তাহাদিগকে সংহার করিতে থাকে। মুসলমানেরা সর্বত্র উৎপীড়িত এবং কিয়দংশ নিহত হইয়া ক্রোধে প্রদীপ্ত অগ্নির ন্যায় জ্বলিয়া উঠে। সকলেই অস্ত্রশস্ত্র ধারণ করিয়া গাজীর বেশে সজ্জিত হন। মুসলমান রমণীরাও তরবারি হস্তে আত্মরক্ষায় প্রবৃত্ত হন। মুসলমানদিগের উদ্দীপ্ত তেজে হিন্দুরা ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত হইয়া পড়ে। এই সময়ে দুর্গ হইতে দলে দলে সৈন্য আসিয়া মুসলমানদিগকে হত্যা করিতে আরম্ভ করে। সমস্ত নগরবাসী হিন্দু ও হিন্দুসৈন্যের দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত হইয়া মুষ্টিমেয় মুসলমান নরনারী সমূলে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। কতিপয় অনিন্দ্যসুন্দরী মুসলমান যুবতীকে বন্দী করিয়া কৃতঘ্ন রাম রায় তাহাদের সতীত্ব নাশে উদ্যত হন। যুবতীরা আত্মহত্যা করিয়া নরাধম পিশাচের হস্ত হইতে ধর্মরক্ষা করেন। অতঃপর মসজিদসমূহ চূর্ণ করিয়া তাহার স্তুপের উপর ত্রিশূল-অঙ্কিত পতাকা উড়াইয়া দিতেও কুণ্ঠিত হন না। এখানে বলা আবশ্যক যে, স্বীয় রাজধানীর মুসলমানদিগকে প্রথমেই আক্রমণ ও ধ্বংস করিবার বাসনা তাঁহার ছিল না। প্রথমতঃ সোলতানগণকে একে একে পরাস্ত করিয়া দাক্ষিণাত্যে হইতে ঐসলামিক শক্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করিতে ও পরে যাবতীয় মুসলমান হত্যা করাই তাঁহার অভীষ্ট ছিল। কিন্তু উন্মত্ত নাগরিক ও উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদিগের উদ্দাম উত্তেজনায় প্রথমতঃ তাঁহার রাজধানীই মুসলমান রক্তে রঞ্জিত হইল।