প্রতাপাদিত্য সত্বরতাপূর্বক একদশ পর্তুগীজ গোলন্দাজ এবং পাঁচ হাজার পদাতিক ও তিনশত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া সহস্রাধিক নৌকা সাহায্যে নদীপথে কেদার রায়ের রাজ্যে অতর্কিত অভিযান করিলেন। কেদার রায়ের রাজ্যের প্রান্তপাল সৈন্যগণ প্রবল-প্রতাপ প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদলকে প্রতিরোধ করিতে পারিল না। প্রতাপ শাহবাজপুর হইতে স্থলপথে অতি দ্রুতবেগে বজ্র-বহ্নি-বিদ্যুৎ-সংঙ্কুল ঝটিকাবর্তের ন্যায় রাজা কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুরাভিমুখে অশ্ব ধাবিত করিলেন। সহসা প্রতাপের এতাদৃশ অগ্রগতি শ্রবণে কেদার রায় প্রথমতঃ বিচলিত, পরে রাজধানী শ্রীপুরের সমস্ত সৈন্য-সামন্ত বরকন্দাজ ও লাঠিয়াল লইয়া প্রবল তেজে প্রতাপাদিত্যের অগ্রগতি রুদ্ধ করিলেন এবং দূত পাঠাইয়া ঈসা খাঁর নিকট সাহায্যপ্রার্থী হইলেন। তিন দিবস অভিরাম যুদ্ধের পরে রাজা কেদার রায় পরাস্ত হইয়া শ্রীপুরের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। প্রতাপাদিত্য, গোলন্দাজ সৈন্যের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করিয়া দুর্গপ্রাকার ভগ্ন করিতে দুর্জয় চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সপ্তম দিবস প্রাতে ঈসা খাঁ চারি হাজার পদাতিক, পাঁচ শত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া শ্রীপুরের নিকটবর্তী হইলেন। প্রতাপাদিত্যের খ্যাতনামা সেনাপতি ঢালী সাত হাজার পদাতিক এবং নয়শত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া উদয়গড় নামক স্থানে ব্যুহ-বিন্যাস ঈসা খাঁ সেনাদলের উপর আপতিত হইলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ভীষণভাবে যুদ্ধ চলিল। লাঠি, তরবারি, বন্দুক ও তীর সমানভাবে সংহার-কার্য সাধন করিল! উভয় সেনাদল মরিয়া হইয়া বুঝিতে লাগিল। ঈসা খাঁ বিপুল প্রতাপে যুদ্ধ করিয়া প্রতাপ-বাহিনীকে পর্যদুস্ত ও বিচ্ছিন্ন করতঃ গভীর ণ্ডঙ্কারে বিঙ্মণ্ডল চমকিত করিয়া শ্রীপুরের অভিমুখে ধাবিত হইলেন। কালিদাস-পরিচালিত সেনাদল যাহাতে পুনরায় একত্র হইয়া পশ্চাদ্দিক হইতে আক্রমণ করিতে না পারে, তজ্জন্য আজিম খাঁ শূর নামক জনৈক সুদ বীর-পুরুষের অধীনে আড়াইশত অশ্বারোহী সেনা রাখিয়া নিজে ঝঞ্জাগতিতে শ্রীপুরের দিকে ধাবিত হইলেন। সমস্ত দিন ভীষণভাবে যুদ্ধ করিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে উদয়গড় হইতে কুচ করিয়া রাত্রি এক প্রহরের মধ্যে পাঁচ ক্রোশ দূরবর্তী শ্রীপুরে উপস্থিত হইলেন। তিনি শ্রীপুরের নিকটবর্তী হইয়া নিঃশব্দে রণকান্ত সৈন্যদিগকে আহারও বিশ্রাম-সুখ উপভোগ করিতে আদেশ দিলেন। কিঞ্চিৎ রাত্রি থাকিতেই দুইশত অশ্বারোহী এবং এক সহস্র পদাতিক লইয়া বজ্রের ন্যায় ভীষণ গতিতে শক্র-সেনার উপরে পতিত হইবার জন্য কুচ করিলেন। অবশিষ্ট সৈন্যদলকে সমর-সজ্জায় প্রস্তুত এবং আহবানমাত্রেই ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের শক্রকুলে আপতিত হইবার জন্য আদেশ করিয়া গেলেন।
১২.রায়-নন্দিনী – দ্বাদশ পরিচ্ছেদঃ গুরু-শিষ্য
কাপালিককুল-চুড়ামণি অভিরাম স্বামী এবং পাপাশয় কেহদাকান্ত স্বর্ণকে খুঁজিবার ছল করিয়া তাহাদের আরদ্ধ কার্য সুসম্পন্ন করিবার জন্য নৌকাযোগে সাদুল্লাপুর পরিত্যাগ করিল। হেমদাকান্তের সহকারী গুণ্ডার দল স্বর্ণকে লইয়া পূর্ব পরামর্শানুসারে ইদিলপুরের নিবিড় জঙ্গলে আশ্রয় লইয়াছিল। তখন স্বর্ণকে লইয়া নৌকাপথে বেশীদূর ভ্রমণ করিলে, পাছে কেহ কোন সন্ধান পায়, এজন্য স্বামী ও শিষ্য ইদিলপুরের নির্জন কাননেই আপনাদের পাপ অভিসন্ধি সম্পাদনের নিরাপদ আশ্রয় মনে করিয়াছিল। গুণ্ডার দল স্বর্ণময়ীকে লইয়া সেই কাননাভ্যন্তরে কুটীর রচনা করিয়া বাস করিতেছিল। তিন দিবস পরেই পাপাত্মা অভিরাম স্বামী ও হেমদাকান্ত সেই কানাভ্যন্তরে প্রবেশ করিল। তাহারা রোরুদ্যমানা এবং ক্ষিপ্তমনা স্বর্ণকে নানাপ্রকার সান্তনা তাহাদের বাক্য শ্রবণে যার-পর-নাই মর্মপীড়িতা হইল। সে কখন ক্রন্দন, কখন তর্জন-গর্জন করিয়া তাহাকে ফিরাইয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিল। কিন্তু “চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী”। স্বর্ণের মানসিক উত্তেজনা এবং উৎক্ষিপ্তভাব দর্শনে স্বামী-শিষ্য মিলিয়া তাহাকে কঠোরভাবে শঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখিল। স্বর্ণ যখন দেখিল, তাহার কষ্ট ও নির্যাতন চরমে উঠিয়াছে এবং অল্পদিনের মধ্যে পাপ-সংকল্পে সম্মত না হইলে, পাষণ্ডদ্বয় বল-প্রকাশেও কুণ্ঠিত হইবে না, তখন সে এই বিষম বিপদ হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য এক কৌশলজাল বিস্তারের কল্পনা করিতে লাগিল। মাকড়সা যেমন আশ্রয়শূন্য হইলেই নিজের দেহের ভিতর হইতে সূত্র নির্গত করিয়া জাল নির্মাণ পূর্বক আপনাকে আশ্রয়-সংস্থিত করে, মানুষও তেমনি বিপদে পড়িলেই তাহার অন্তরস্থ আত্মা তাহাকে নূতন বুদ্ধি-কৌশল উদ্ভাবনের কল্পনায় মাতাইয়া তোলে। স্বর্ণ দেখিল, অভিরাম স্বামীও তাহাতে মুগ্ধ এবং লুব্ধ। হেমদা এবং স্বামীজি উভয়েই তাহার শিকার। সুতরাং আপাততঃ একজনকে ভালোবাসার ছলনায় মুদ্ধ করিতে পারিলেই অন্যের সহিত তাহার বিরোধ উপস্থিত অনিবার্য। উভয়ের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত করিতে পারিলে, হয়ত তাহার উদ্ধার হইবার কোন পথ খুলিয়া যাইতে পারে। এই সংকল্পে স্থির-সিদ্ধান্ত হইয়া ক্রমে ক্রমে স্বামীজি এবং হেমদাকান্তের সহিত কথোপকথন করিতে ও স্বামীজির প্রতি একটু বেশী ভালবাসা দেখাইতে লাগিল। নানাপ্রকার উৎকৃষ্ট খাদ্য এবং দুস্প্রাপ্য জিনিসের ফরমায়েস করিতে লাগিল। অন্যান্য লোক থাকিলে তাহার সঙ্কোচ ও লজ্জা বোধ হয়, এই অছিলায় সমস্ত লোককে বিদায় করিয়া দেওয়াইল। এণে এই নিবিড় অরণ্যে স্বামীজি, হেমদা এবং স্বর্ণ ব্যতীত আর কেহই রহিল না।