যুবক রাস্তার ধারে গুন্ গুন্ করিয়া গান করিতে করিতে পায়চারী করিতেছিল। বেহারা, রক্ষী ভারীরা গাছের তলায় তামাকু সেবন এবং নানা প্রকার গল্প-গুজব করিতেছিল। পশ্চিমদিক্ হইতে সহসা একটু ঠাণ্ডা হাওয়া প্রবাহিত হইয়া যুবকের বাবরী চুল দোলাইয়া গেল। যুবক পশ্চিমদিকে তাকাইয়া দেখিল, একখণ্ড কাল মেঘ গগন-প্রান্তে মাথা তুলিয়া দৈত্যের মত শ্রীঘ্র শ্রীঘ্র বাড়িয়া উড়িতেছে। মেঘের চেহারায় বুঝা যাইতেছিল যে, উহা ঝটিকা-গর্ভ।
যুবক মেঘ দেখিয়া একটু ব্যস্ত কণ্ঠে বলিল,-“শিবু! পশ্চিমে মেঘ ক’রেছে। সকালে পাল্কী তোল।” মেঘের কথা শুনিয়া সকলে গাছের নীচ হইতে বাহিরে আসিয়া দেখিল, সত্য সত্যই একখানা মেঘ দ্রুত গতিতে বাড়িয়া উঠিতেছে। শিবু মেঘ দেখিয়া যুবকের উদ্দেশ্যে বলিল,-“দাদা মশায়! মেঘ ত খুব বেড়ে চ’লেছে। পাল্কী এখন চটিতে রাখা যাক্। মেঘটা দেখেই যাওয়া যাবে।”
যুবকঃ “মেঘ আসতে আসতে আমরা অনেক দূর যে’তে পারব। যেরূপ হাওয়া দিচ্ছে, তাতে মেঘখানা উড়েও যেতে পারে।” বলিতে বলিতে হাওয়া একটু জোরেই বহিতে লাগিল এবং মেঘের উপরের অংশটা ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। তখন সকলে অনুমান করিলে যে, মেঘ আর জমাট বাঁধিতে পারিবে না।
একটু হাওয়া ব্যতীত আর কোনও আশঙ্কা নাই। তখন বেহারারা “জয় কালী” বলিয়া পাল্কী কাঁধে তুলিয়া “হেঁই হেঁই” করিতে করিতে সাদুল্লাপুরের দিকে ছুটিল। শীতল বাতাসে তাহাদের বড় স্ফূর্তি বোধ হইতেছিল। দুইটি মশাল অগ্র ও পশ্চাতে বায়ু-প্রবাহে শাঁ শাঁ করিয়া তীব্র শিখা বিস্তারপূর্বক অন্ধকার নাশ করিতেছিল। কিন্তু কয়েক রশি যাইবার পরেই কড়্ কড়্ গড়্ গড়্ করিয়া মেঘ একবার ডাকিয়া উঠিল এবং তার পর মূহুর্তেই সমুদ্রের প্রমত্ত প্লাবনের ন্যায় আকাশ-রূপ বেলাভূমি যেন আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। দিগ্মণ্ডল নিবিড় অন্ধকারে সমাবৃত হইল। মাথার উপরে ক্রুদ্ধ মেঘের স্তর ক্রমাগতই গড়াইতে ও গর্জন করিতে লাগিল। পবন হুঙ্কার দিয়া চতুস্পার্শ্বের গাছপালার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি গড়াইতে ও গর্জন করিতে লাগিল এবং দেখিতে দেখিতে চটাপটি বৃষ্টির ফোঁটাও পড়িতে আরম্ভ করিল। যুবক অশ্বারোহণে অগ্রে অগ্রে যাইতেছিল। উচ্চৈঃস্বরে সকলকে ডাকিয়া বলিল,-“ওরে, তোরা সকলে আয়! চক্রবর্তীদের শিব-মন্দির সম্মুখেই, রাস্তার ধারে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া যাবে।” বেহারা ও সর্দারেরা তাড়াতাড়ি ছুটিতে লাগিল।
০২.রায়-নন্দিনী – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ লুণ্ঠন
শিব-মন্দির প্রায় নিকটবর্তী হইয়াছে, এমন সময় চতুর্দিকে “রি-রি-রি-মার-মার” শব্দ উত্থিত হইল। সর্দার ও রক্ষীগণ প্রস্তুত হইবার পূর্বেই ভীষণ ব্যাঘ্রের ন্যায় পর্তুগীজ ও বাঙ্গালী দস্যুগণ তাহাদের উপর লাঠি ও সড়কি বর্ষণ করিতে লাগিল। বেহারারা পাল্কী ফেলিয়া, রক্ষীরা অস্ত্র ফেলিয়া, সেই ভীষণ অন্ধকারে দিগ্বিদিকে বক-তাড়িত শৃগালের ন্যায় ছুটিয়া পলাইল। অন্ধকারে আছাড় পড়িয়া, হোঁচট খাইয়া গাছের বাড়ি খাইয়া যাহারা পলাইল তাহাদেরও অনেকে সাংঘাতিকরূপে আহত হইল। পাঁচজন প্রহরী, দস্যুদের বিষম প্রহারে প্রাণত্যাগ করিল।
একজন মশালধারী মালী আক্রান্ত হইয়া, জ্বলন্ত মশালের আগুনে আততায়ীকে দগ্ধ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলে একজন পর্তুগীজ দস্যু তাহাকে তরবারির ভীষণ আঘাতে কুষ্মাণ্ডের ন্যায় দ্বিখণ্ড করিয়া করিয়া ফেলিল। কয়েকজন সাংঘাতিকরূপে জখম হইল! দূরে অশ্বারোহী যুবকের কণ্ঠ হইতে একবার আর্ত চীৎকার শ্রুত হইতেছিল। কিন্তু এই ভীষণ দুর্যোগ ও পবনের মাতামাতির হুঙ্কারে সেই আর্ত চিৎকার গ্রামবাসী কাহারও কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। বৃষ্টিও যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া মুষলধারে পড়িতে লাগিল। যেমন সূচিভেদ্য অন্ধকার, তেমনি মেঘের ঘন ভীষণ গর্জন এবং তুমুল বর্ষণ। মাঝে মাঝে চঞ্চলা দামিনীলতা ক্ষণকালের জন্য রূপের লহরী দেখাইয়া করাল ভ্রূভঙ্গীতে এই দুর্যোগের কেবল ভীষণতাই বৃদ্ধি করিতেছিল। দস্যুরাও সেই ভীষণ দুর্যোগে ত্রস্ত হইয়া পড়িল। তাহারা পাল্কীখানা তুলিয়া লইয়া নিকটবর্তী শিব-মন্দিরের বারান্দায় যাইয়া দাঁড়াইল। কিন্তু সেখানেও বৃষ্টির ঝাপ্টা তাহাদিগকে সিক্ত ও বিপর্যস্ত করিয়া তুলিল। তাহারা সেই অন্ধকারের মধ্যেই প্রস্তুরের আঘাতে রুদ্ধ দ্বারের তালা ভাঙ্গিয়া মন্দিরে প্রবেশ করিল। তারপর চকমকি ঠুকিয়া আগুণ জ্বালাইয়া মন্দিরের প্রদীপ জ্বালাইল। প্রদীপের আলোকে সমস্ত মন্দির উদ্ভাসিত হইল। মন্দিরটি নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। ভিতরের চূণকাম ধব্ধব্ করিতেছে। একটি কাল প্রস্তরের বেদীর উপরে এক হস্ত অপেক্ষা দীর্ঘ সিন্দুরচর্চিত বিল্বপত্র ও পুস্প-পরিবেষ্টিত শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। পার্শ্বে একটি কুলঙ্গীর মধ্যে পঞ্চপ্রদীপ, কোষাকোষি, কতকগুলি সলিতা প্রভূতি পূজার উপকরণ রহিয়াছে। দস্যুদের মধ্যে পনের জন শিবলিঙ্গ দেখিয়া “জয় শিব শঙ্কর বোম ভোলানাথ” বলিয়া একেবারে মাটিতে লুটাইয়া শিবলিঙ্গকে প্রণাম করিল। তারপর একজন বলিয়া উঠিল,-“বাবা ভোলানাথ! আজ তোমার আর্শীবাদেই আমরা সিদ্ধিলাভ করিয়াছি। এ দারুণ দুর্যোগে তুমি আমাদিগকে আশ্রয় দিয়াছ।” অবশিষ্ঠ পাঁচজন পর্তুগীজ দস্যু, তাহারা প্রস্তরের এই বীভৎস লিঙ্গকে ভক্তি করিতে দেখিয়া অবাক হইয়া গেল! তাহারা আরও বিবিধ প্রকারের সুন্দর ও ভীষণ মূর্তির সম্মুখে হিন্দুদিগকে গড় করিতে দেখিয়াছে বটে, কিন্তু এমন উদ্দগুলিঙ্গও যে উপাস্য দেবতা হইতে পারে, ইহা কখনও তাহাদের ধারণা ছিল না। একজন কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,-“তোমাদের এ লিঙ্গ পূজার মট্লব কি আছে?” তখন সেই বাঙ্গালী দস্যুদের মধ্য হইতে একজন হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠকায় উজ্জ্বল-চক্ষু যুবক বলিল,-“গডফ্রে! তুমি ক্রেস্তান, তুমি কি তাহা বুঝিতে পারিবে? লিঙ্গই যে পরম বস্তু, লিঙ্গই ত স্রষ্টা, লিঙ্গ হইতেই ত আমরা জন্মিয়াছি। তাই লিঙ্গ পূজা করিতে হয়।”