মহর্রমের ১০ তালিখ-বাঙ্গালায় পল্লীপ্রান্তর শহর বাজার কম্পিত করিয়া মুহুর্মুহু ইমাম হোসেনের জয়ধ্বনি উচ্চারিত হইতেছে। দ্বিপ্রহরের সঙ্গে সঙ্গেই সাদুল্লাপুর হইতে এক ক্রোশ পশ্চিমে কম্পিত কারবালার বিশাল মাঠে চতুর্দিক হইতে বিচিত্র পরিচ্ছদধারী সহস্র সহস্র লোক সমাগত হইতে লাগিল। নানাবর্ণের বিচিত্র সাজ-সজ্জায় শোভিত মনোহর কারুকার্যভূষিত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ তাবুত, অসংখ্য পতাকা, আসা-সোটা, ভাস্বর বর্শা, তরবারি, খব্ধর, গদা, তীর, ধনু, সড়কি, রায়বাশ, নানা শ্রেণীর লাঠি, খড়গ, ছুরি, বানুটি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে, স্বর্ণ-সজ্জা শোভিত দুলদুল, সহস্র সহস্র অশ্বারোহী ও শত শত হস্তি-শোভিত মিছিলের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ দল চতুর্দিক্ হইতে শ্রেণীবন্ধ সুশৃঙ্খল অবস্থায় কারবালার ময়দানের দিকে ধাবিত হইল। অসংখ্য বাদ্য নিনাদে জলস্থল কম্পিত এবং দিঙ্মণ্ডল মুখরিত হইয়া উঠিল। পিপীলিকাশ্রেণীর ন্যায় জনশ্রেণী জল ও স্থল আচ্ছন্ন করিয়া নানা পথে নৌকায় কারবালার ময়দানে ধাবিত হইল। জন-কোলাহল সাগর-কল্লোলবৎ প্রতীয়মান হইতে লাগিল। পঁচাত্তরটি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ মিছিলের দশ শতাধিক তাবুতসহ বিভিন্ন গ্রাম হইতে বিভিন্ন পথে আসিয়া কারবালার ময়দানের বিভিন্ন প্রবেশপথ-মুখে অপেক্ষা করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে ঈসা খাঁ মস্নদ-ই আলীর মহর্রমের বিপুল মিছিল আড়ম্বর, প্রতাপ ও অসাধারণ জাঁকজমকের সহিত কারবালার নিকটবর্তী হইল। ঈসা খাঁর রৌপ্য-নির্মিত স্বর্ণ ও অসংখ্য মণি-মাণিক্য-খচিত সুচারু ছত্র, অসংখ্য কিঙ্কিণীজাল সমলঙ্কৃত পতাকা, দর্পণ এবং কৃত্রিম লতাপুস্প এবং নানা বিচিত্র কারুকার্য-শোভিত ত্রিশ হস্ত পরিমিত উচ্চ, বিশাল ও মনোহর তাবুত মিছিলের অগ্রভাগে একশত ভারবাহীর স্কন্ধে বাহিত হইল। ঈসা খাঁর তাবুত দেখিবামাত্রই সেই বিপুল জনতা সমুদ্র-গর্জনে “হায়! হোসেন! হায়! হোসেন!” রবে স্থাবর জঙ্গম চরাচর জগৎ যেন কম্পিত করিয়া তুলিল। মধ্যাহৃ ভাস্করের প্রখর কিরণে তাজিয়ার শোভা শতগুণে ঝলসিয়া উঠিল। তাজিয়ার পশ্চাতে দুই সহস্র অশ্বারোহী উর্দী পরিয়া বামহস্তে রক্তবর্ণ বিচিত্র পতাকা বিধূনন এবং দক্ষিণ করে উলঙ্গ কৃপাণ আস্ফালন করিয়া গমন করিল। তাহার পশ্চাতে পাঁচশত সুসজ্জিত স্বর্ণ-আন্তরণ-বিমণ্ডিত হস্তী তালে তালে সমতা রক্ষা করিয়া পৃষ্ঠে ভীষণ ভাস্বর বর্শাধারী দুই দুই জন বীরপুরুষকে বহন করতঃ উপস্থিত হইল। তৎপশ্চাৎ দুইশত বাদ্যকর ঢাক, ঢোল, ভেরী, শানাই, পটই, ডঙ্কা, তুরী, জগঝম্প, দফ্, শিঙ্গা প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যে ভূতল খতল কম্পিত করিয়া কারবালায় উপস্থিত হইল। তাহার পশ্চাতে শত শত খেলোয়াড় লাঠি তরবারি, বানুটি, সড়কির নানা প্রকার ক্রীড়া-কৌশল দেখাইতে দেখাইতে ভীমতেজে অগ্রসর হইল। তৎপর নানাজাতীয় পতাকা ও ঝাণ্ডা পুনরায় দেখা দিল। তৎপর কৃষ্ণবর্ণ অশ্বপৃষ্ঠে কৃষ্ণসজ্জায় শোভিত তেজঃপুঞ্জমূর্তি মহাবীর ঈসা খাঁ শত অশ্বারোহী-বেষ্টিত হইয়া অগ্রসর হইলেন। তৎপশ্চাতে শুভ্র পরিচ্ছদ-সমাবৃত দক্ষিণ হস্তে শ্বেত এবং বাম হস্তে কৃষ্ণ চামর-শোভিত সহস্র যুবক পদব্রজে বিলাপ এবং ব্যঞ্জন করিতে করিতে আগমন করিল। তৎপর বিপুল জনতা গৈরিক-প্রবাহের ন্যায় চতুর্দিক হইতে কারবালায় প্রবেশ করিল। ঈসা খাঁর তাবুত কারবালায় প্রবেশ করিলে, অন্যান্য মিছিলের দল নানা পথে উল্লাস ও আনন্দে ণ্ডঙ্কার করিয়া কারবালায় প্রবেশ করিল। সম্ভ্রান্ত মুসলমান-কুলমহিলাগণ তাঞ্জামে চড়িয়া সূক্ষ্ম যবনিকায় আবৃত হইয়া উৎসবক্ষেত্রের এক পার্শ্বে উপস্থিত হইলেন। অসংখ্য হিন্দু মহিলা লাল, সবুজ, বাসন্তী প্রভৃতি বর্ণের শাড়ী পরিয়া সিঁথিতে সিন্দুর মাখিয়া, নানাবিধ স্বর্ণ ও রৌপ্যালঙ্কারে বিভূষিত হইয়া, গুজরী মল, নূপুরের রুণু রুণু ঝুমু ঝুমু এবং ঝন্ ঝন্ কণ্ কণ্ শব্দে পল্লী ও প্রান্তরবে আনন্দনিক্কণ জাগাইয়া, রূপের ছাঁয় পথ আলোকিত করিয়া, কথার ঘটায় হাসির লহর তুলিয়া চঞ্চল শফরীর ন্যায় স্ত্রীলোকদিগের নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হইল। মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে সহস্র সহস্র তরণী নানাবর্ণের উড়াইয়া দাঁড়ের আঘাতে জল কাটিয়া বাইচ দিতে লাগিল। অসংখ্য বালক-বালিকা এবং যুবক-যুবতীর উৎফুল্ল মুখকমলের আনন্দ-জ্যোতিঃতে মাথাভাঙ্গার জল-প্রবাহ আলোকিত এবং চঞ্চল হইয়া উঠিল। নদীর পারেই ঘোড়দৌড়ের বাঁধা রাস্তা; তাহাতে শত শত ঘোড়া প্রতিযোগীতা করিয়া ধাবিত হইতে লাগিল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মহর্রমের শির্নী স্বরূপ নানা শ্রেণীর মিষ্টান্ন পাইয়া আনন্দ করিতে লাগিল। খেলোয়াড়গণ শত শত দলে বিভক্ত হইয়া নানাপ্রকার ব্যায়াম, অস্ত্র-চালনা এবং ক্রীড়া-কৌশল প্রদর্শন করিতে লাগিল। বিশাল ময়দানে এক মহা সামরিক চিত্তোন্মাদকর দৃশ্য! অসণিত নরনারী সেই মহা উত্তেজনাকর ক্রীড়া-কৌশল দেখিয়া মুগ্ধ ও লুব্ধ হইতেছে। মহুর্মুহু সেই বিশাল জনতা “ইমাম হোসেন কি-ফতেহ্” বলিয়া গগন-ভুবন কম্পিত করিতেছে। শত শত বালক তাম্বুর চূড়ার ন্যায় লম্বা টুপী মাথায় পরিয়া ছুটাছুটি করিতেছে। থাকিয়া থাকিয়া “হায়! হোসেন! হায়! হোসেন!!” রবে প্রকৃতির বক্ষে শোকের দীর্ঘ লহরী তুলিতেছে। দরিদ্রেরা পয়সা ও কড়ি আগ্রহের সহিত কুড়াইয়া লইতেছে। কেহ কেহ রাশি রাশি বাতাসা বর্ষণ করিতেছে। বালকের দল সেই বাতাসার লোভে হুড়া-হুড়ি, পাড়াপাড়ি করিতেছে। বিশাল ময়দানের চতুর্দিকে তাবুত লইয়া মিছিলসমূহ শ্রেণীবন্ধভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আর মধ্যস্থলে অযুত লোক লাঠি তরবারি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র লইয়া কৃত্রিম যুদ্ধ করিতেছে। গায়কগণ স্থানে স্থানে দল বাঁধিয়া করুণকণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে কারবালার দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী সঙ্গীতালাপে প্রকাশ করিতেছে। ধন্য ইমাম হোসেন! তুমি ধন্য! তোমার ন্যায় প্রাতঃস্মরণীয় এবং চিরজীবিত আর কে? ধন্য তোমার স্বার্থত্যাগ! ধন্য তোমার আত্মত্যাগ!! ধণ্য তোমার স্বাধীনতা-প্রিয়তা! শত ধন্য তোমার অদমনীয় সাহস ও শৌর্ষ! তোমার ন্যায় বীর আর কে? তোমার ন্যায় স্মরণীয়ই বা আর কে? প্রজাতন্ত্র-প্রথা রক্ষা করিবার জন্য, ধর্ম ও ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষা করিবার জন্য তোমার ন্যায় আর কে আত্মত্যাগ করিয়াছে? “মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন” এ প্রতিজ্ঞা তোমার দ্বারা পূর্ণ হইয়াছে। পুণ্যভূমি আরবের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, ইসলামের পবিত্রতম প্রজাতন্ত্র-প্রথা রক্ষা করিবার জন্য মৃত্যুর করাল গ্রাস এবং নির্যাতন ও অত্যাচারের ভীষণ নিষ্ঠুর যন্ত্রণাও তোমাকে বিচলিত করিতে পারে না। তুমি সবংশে ধ্বংস হইলে, তথাপি অন্যায়ের প্রভুত্বের নিকট মস্তক নত করিলে না। আজ অত্যাচারী এজিদের স্থান এবং তোমার স্থানের মধ্যে কি বিশাল ব্যবধান। তুমি আজ জগতের যাবতীয় নর-নারীর কণ্ঠে কীর্তিত, হৃদয়ে পূজিত। তুমি কারবালায় পরাজিত এবং নিহত হইয়াও আজ বিজয়ী এবং অমর।