“দর ফসলে বাহার আগার তনে হুর শিরস্তী
পুর ময়ে কদাহ্ বমন দেহদ বরলবে কীসত,
গরচে বর্হর্ কসে সখুন্ বাশদ জীশ্ত।
সগ্ বে বমন্ আরজাঁকে বরম্ নামে বেহেশত”
মাহতাব খাঁ সুললিত স্বরে সেই নির্জন কাননে সুধাকণ্ঠ বিহঙ্গাবলীর মধুর কুজনে মধু বর্ষণ করিয়া কয়েকবার ‘রুবাইয়াত’টি গাহিলেন। অরুণাবতী ফার্সী জানিত না, কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তে মাহতাব খাঁকে জিজ্ঞাসা করিল,-“কি গাইছেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
মাহতাবঃ কি গাইব! তোমারই গান গাইছি।
অরুণাঃ আমার গান কেমন? গজলটা ভেঙ্গেই বলুন না!
“আচ্ছা তবে শোন,” এই বলিয়া-প্রস্ফুটিত শুভ্র রজনীগন্ধা মারুত হিল্লোলে যেমন করিয়া ফুটন্ত যৌবনা গোলাপ-সুন্দরীর রক্তব স্পর্শ করে, মাহতাব খাঁও তেমনিভাবে প্রণয়-সোহাগে চম্পক অঙ্গুলে অরুণাবতীর গোলাপী কপোল টিপিয়া বলিলেন, “কবি বলিতেছেন যে, আনন্দময় বসন্তকাল পুস্পিত নিকুঞ্জ কাননে যদি কোন অস্পরীবৎ সুন্দরী অর্থাৎ অরুণাবতী কোমল করপল্লবে এক পাত্র মদিরা আমার অধরে ধারণ করে, তাহা হইলে কুকুর আমা অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ, যদি আর কখনও বেহেশত কামনা করি।”
অরুণা রুবাইয়াতের ব্যাখ্যা শুনিয়া ঈষৎ সলজ্জ কটাক্ষ হানিয়া স্মিত হাসিয়া বলিল, “বটে! কবি ত খুব রসিক।”
মাহতাবঃ আর আমি বুঝি অরসিক?
অরুণাঃ কে বলল?
মাহতাবঃ ভাবে!
অরুণাঃ কি প্রকারে?
মাহতাবঃ তবে মদিরাপাত্র কোথায়?
অরুণাঃ সে যে বসন্তকালে।
মাহতাবঃ এ বর্ষাকাল হলেও এ কাননে এখনও বসন্ত বিরাজমান।
অরুণাঃ আচ্ছা, বসন্তই যেন হ’লে; কিন্ত এখানে মদিরা কোথায়? আর তুমি মুসলমান, মদ্য যে তোমার জন্য হারাম।
মাহতাবঃ কবি যে মদ্যের কথা বলেছেন, তা’ হারাম নহে।
অরুণাঃ সে আবার কোন মদ্য?
“সে এই মদ্য” এই বলিয়া মাহতাব খাঁ যুবতীকে ভুজপাশে জড়াইয়া অধরে অধর স্থাপন করিলেন। অধল-রসামৃত পানে উভযের পুলকিত শিহরিত এবং বিমোহিত হইলেন। অরুণাবতী দেখিল সমস্ত পৃথিবী যেন সুধারসে বিপ্লাবিত। সহসা একটা বুলবুল উড়িয়া আসিয়া অরুণাবতী সেই বিহঙ্গের দৃষ্টিতে লজ্জিত হইয়া আনত চুতে চুম্বনাকৃষ্ট মুখ সরাইয়া লইল। যুবতী-হৃদয় যৌবনতরঙ্গে যেমন প্রেমাকুল, লজ্জায় তেমনি সদা অবগুণ্ঠিত।
মাহতাব খাঁ সরোবরের অদূরে গোলাকারে ঘণ সন্নিবিষ্ট তালবৃ পূর্ণ এশটি উচ্চস্থান দেখিতে পাইলেন। তাল গাছগুলির ফাঁকে বেতের লতা এমন ঘন ভাবে জন্মিয়াছে যে, বাহির হইতে মধ্যস্থানের নির্মল তৃণাচ্ছাদিত স্থানটুকু সহসা দেখা যায় না। অরুণাবতীও সেইস্থানে কানন-বাসের কুটীর নির্মাণের জন্য পছন্দ করিল। একদিকের কিঞ্চিৎ বেত কাটিয়া দ্বার প্রস্তুত করা হইল। অতঃপর ছোট ছোট দেবদারু ও সুন্দরী গাছ কাটিয়া মঞ্চ প্রস্তুতপূর্বক নৌকার ছই এবং গোলপাতার সাহায্যে দুইটি রমণীয় কুটীর প্রস্তুত করা হইল। কাঁচা বেত চিবিয়া তদ্বারা বন্ধনীর কার্য শেষ করা হইল।
প্রতাপাদিত্যের নৌকা বামনী নদী হইতে ফিরিয়া না গেলে অরুণাকে লইয়া সেই ভীষণ জঙ্গল অতিক্রম করতঃ অন্যত্র যাওয়া মাহতাব খাঁর পক্ষে নিতান্ত অসুবিধা ছিল। কয়েক ক্রোশ পশ্চিমে আর একটি নদী আছে। সেখানে সহসা নৌকা পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। এদিকে নৌকা ব্যতীত কোন নিরাপদ স্থানে যাইবার সুবিধা নাই। কারণ তখন সুন্দরবনের এই অঞ্চল অসংখ্য নদী-প্রবাহে বিভক্ত ও বিধৌত ছিল। হেমন্তকাল হইতে বৈশাকের শেষ পর্যন্ত এই সমস্ত অরণ্যে লোকের খুব চলাচল হইত। নল, বেত এবং নানাজাতীয় কাষ্ঠ আহরণের জন্য বহু লোকের সমাগম হইত। কিন্তু বৃষ্টিপাত আরম্ভ ও বর্ষা সূচনা হইলেই এই সমস্ত অরণ্য জনমানব-শূন্য হইয়া পড়িত। মাহতাব খাঁ একাকী হইলে, এই বনভূমি অতিক্রম করিয়া প্রতাপের রাজ্যের বাহিরে চলিয়া যাইতেন, কিন্তু অরুণাবতীর বিপদ ও ক্লেশ ভাবিয়া সেই কাননেই আবাস কুটীর রচনা করিলেন। বিশেষতঃ অরুণাবতী এবং মাহতাব খাঁর প্রেম-উচ্ছ্বসিত হৃদয়, কিছুদিন এই রমণীয় কাননাবাসে বাস করিবার জন্যও ব্যাকুল হইয়াছিল। নৌকায় রন্ধন করিবার পাতাদি সমস্তই ছিল। প্রায় দুই মণ অত্যুৎকৃষ্ট চাউল, কিছু ডাল, ঘৃত, লবণ ও অন্যান্য মশলা যাহা ছিল, তাহাতে দুইজনের দুই মাস চলিবার উপায় ছিল। বনে হরিণ, নানাজাতীয় খাদ্য পক্ষী এবং সরোবরে মৎস্যের অভাব ছিল না। মাহতাব খাঁ প্রথম দিবসেই এক হরিণ শিকার করিয়া তাহার গোশত কাবাব করিয়া অরুণাবতী সহ পরমানন্দে উদরপূর্তি করিলেন।
অরুণাবতী মাহতাব খাঁর নিকট ইসলামের পবিত্র কলেমা পড়িয়া মুসলমান ধর্মে দীতি হইল। অপাততঃ আত্মরক্ষার জন্য উভয়েই সেই নিবিড় বনে বাস করিতে লাগিলেন।
১০.রায়-নন্দিনী – দশম পরিচ্ছেদঃ মহর্রম উৎসব
১৭ই আষাঢ় মহর্রম উৎসব। সেকালের মহররম উৎসব এক বিরাট ব্যাপার, সমারোহকাণ্ড এবং চিত্ত-উন্মাদক বিষয় ছিল। মহর্রমের সে অসাধারণ আড়ম্বর, সে জাঁক-জমক, সে ক্রীড়া-কৌশল, সে লাঠি ও তলোয়ার খেলা, সে বাদ্যোদ্যম এবং যাবতীয় নর-নারীর মাতোয়ারা ভাবের উচ্ছ্বাস, সে বিরাট মিছিল, সে মর্সিয়া পাঠ, সে শোক প্রকাশ, সে দান খয়রাৎ, মহর্রমের দশদিন ব্যাপী সে সাত্ত্বিক ভাব, বর্তমানে কল্পনা ও অনুমানের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সেকালের হিন্দু-মুসলমান, ধনী-দরিদ্র, আলেম-জাহেল, সকলেই মহর্রম উৎসবে যোগদান করিতেন। তখন বাঙ্গালা দেশে অদূরদর্শী কাটমোল্লার আবির্ভাব ছিল না; সুতরাং মহর্রম উৎসব তখন বেদাত বলিয়া অভিহিত হইত না। মহর্রমের দশ দিবস কেবল মুসলমান নহে, হিন্দুরা পর্যন্ত পরম পবিত্রভাবে যাপন করিতেন। মহর্রমের দশ দিবস চোর চুরি করিত না, ডাকাত ডাকাতি করিত না, লম্পট লাম্পট্য ত্যাগ করিত। ধনী ধনভাণ্ডার মুক্ত করিয়া গরীবের দুঃখ বিমোচন করিত। ক্ষুধার্ত অন্ন পাইত, তৃষ্ণার্ত সুমিষ্ট সরবৎ পাইত, বস্ত্রহীন বস্ত্র পাইত। ‘আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সমস্ত কার্য ফেলিয়া মহর্রম উৎসবে যোগদান করিতেন। বীরপুরুষ অস্রচালনায় নৈপুণ্য লাভ করিয়া বীরত্ব অর্জন করিবার, কারু ও শিল্পীগণ মহর্রমের তাজিয়া সংগঠনে আপনাদের সূক্ষ্ম কারুকার্যের সৌন্দর্য দেখাইবার জন্য মস্তিস্ক পরিচালনা করিবার, বালক-বালিকাগণ ‘কাসেদ’ সাজিয়া আনন্দ উপভোগ করিবার, ধনী দান-খয়রাতে লাভ করিবার, দেশবাসী গ্রামবাসী পরস্পরের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া বন্ধুত্ব লাভ করিবার, দলপতিগণ বিভিন্ন দলের পরিচালনা করিয়া নেতৃত্ব অর্জন করিবার এবং সর্বোপরি সকলেই এই দশ দিন নির্মল আনন্দ, বিপুল উৎসাহ, সামরিক উত্তেজনা,শত্রু-সংহারে উদ্দীপনা এবং মিত্রের প্রতি হিতৈষণা পোষণ করিবার সুবিধা পাইত।’ মহর্রমের দশ দিন সমারোহের দিন-উৎসাহের দিন এবং পুণ্যের দিন ছিল। সমগ্র দেশ বাদ্যোদ্যমে মুখরিত-শানাইয়ের করুণ-গীতিতে প্রাণ চতুর্দিকে উৎসাহ আনন্দে পরিপূর্ণ-মেদিনী কম্পিত-দিঙ্মণ্ডল চমকিত হইত! মিছিলের বিপুল আড়ম্বরে, তাজিয়া ও দুল্দুলের বিচিত্র সজ্জায়, কারুকার্যে, পতাকার উড্ডয়নে, অশ্বারোহীদিগের অশ্ব সঞ্চালনে কি চমৎকার দৃশ্যই না প্রতিভাত হইত! মর্সিয়ার করুণ তানে প্রাণের পর্দায় পর্দায় কি করুণ রসেরই সঞ্চার করিত! মহর্রমের দশ দিনে ইসলামের কি অতুল প্রভাবই প্রকাশ পাইত! মহাত্মা ইমাম হোসেনর অপূর্ণ আত্মোৎসর্গ ও অদম্য স্বাধীনতা-স্পৃহার উন্মাদনা গগণে গগণে পবনে নব জীবনের স্ফূর্তি ও আশায় ছড়াইত। রোগী রোগশয্যা হইতে উঠিয়া বসিত, ভীরু সাহস পাইত, হতাশ ব্যাক্তিও আশায় মাতিয়া উঠিত। উৎপীড়িত আত্মরক্ষার ভাগে অনুপ্রাণিত হইত, বীরের হৃদয় শৌর্যে পূর্ণ হইত। মহর্রমের দশ দিন দিগ্বিজয়ী বিরাট বিশাল মুসলমানজাতির জ্বলন্ত ও জীবন্ত প্রভাব প্রকাশ পাইত। মুসলমান এই দশ দিন বাহুতে শক্তি, মস্তিস্কে তেজঃ, হৃদয়ে উৎসাহ এবং মনে আনন্দ লাভ করিতেন। সমগ্র পৃথিবীতে মহর্রমের ন্যায় এমন শিক্ষাপ্রদ, এমন নির্দোষ, এমন উৎসাহজনক পর্ব আর নাই। অধম আমরা, মুর্খ আমরা, অদূরদর্শী আমরা, তাই মহর্রম-পর্ব দেশ হইতে উঠিয়া গেল। জীবন্ত ও বীরজাতির উৎসব কাপুরুষ, অলস, লক্ষ্যহীনদিগের নিকট আদৃত হইবে কেন? বীর-কূল-সূর্য অদম্যতেজা হযরত ইমাম হোসেনের অতুলনীয় আত্মোৎসর্গ ও স্বাধীনতাস্পৃহার জ্বলন্ত ও প্রাণপ্রদ অভিনয়, প্রাণহীন নীচচেতা স্বার্থন্ধদিগের ভালো লাগিবে কেন? পেচকের কাছে সূর্য, কাপুরুষের কাছে বীরত্ব বধিরের কাছে সঙ্গী, অলসের কাছে উৎসাহ করে সমাদর লাভ করে? যখন বাঙ্গালায় মুসলমান ছিল, মুসলমানের প্রাণ ছিল-বুদ্ধি ছিল-জ্ঞান ছিল-তেজঃ ছিল-বীর্য ছিল; তখন মহর্রম উৎসবও ছিল। যাহা হউক, উৎসবের কথা বলিতেছিলাম, তাহাই বলি।”