মাহতাব খাঁ মনোহরপুরে পঁহুছিতেই প্রায় সন্ধ্যা হইল। মনোহরপুরে প্রতাপাদিত্যের একখানা বাড়ী ও একটি কাছারি ছিল। এতদ্ব্যতীত সেখানে গোলা ও হাটবাজার দস্তরমত ছিল। কাছারিতে ১০ জন তবকী অর্থাৎ বন্দুকধারী, ২৫ জন লাঠিয়াল, একজন জমাদার, একজন নায়েব এবং অন্যান্য কর্মচারী ১০/১২ জন ছিল। প্রতাপাদিত্যের স্ত্রীর সংখ্যা চল্লিশেরও উপর ছিল এতদ্ব্যতীত উপপত্নীও যথেষ্ঠ ছিল। মনোহরপুরে চতুর্থ রাণী দুর্গাবতী বাস করিতেছেন। তিনি পূর্বে যশোরের প্রাসাদের অধিবাসিনী ছিলেন। কিন্তু ক্রমে সন্তানাদি হওয়ায় তাঁহার যৌবনে, ভাঁটা ধরিলে প্রতাপাদিত্যের মন-মধুকর যখন দুর্গাবতীকে কিঞ্চিৎ নীরস বলিয়া মনে করিল, তখন মনোহরপুরের ক্ষুদ্র বাটীতে তাঁহাকে সরাইবার ব্যবস্থা হইল। তদ্ব্যতীত প্রতাপাদিত্য আরও একটি কারণে দুর্গাবতীকে নির্বাসিত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। দুর্গাবতী অত্যন্ত মুখরা ছিলেন, একবার রাগিয়া গেলে তাঁহার জিহবার বাক্যানলে সকলকেই দগ্ধ হইতে হইত। তাঁহার জিহবা সর্বতোভাবে নিঃশঙ্ক ও নিঃসঙ্কোচ ছিল। তাঁহার তীব্র সমালোচনা এবং বিদ্রুপ-বাণে প্রাসাদবাসিনী অন্যান্য রাণীরা অস্থির থাকিতেন। তিনি প্রতাপাদিত্যকেও অতি সামান্যই গ্রাহ্য করিতেন। দুর্গাবতী তাঁহার পরবর্তী রাণীদিগকে আপনার ক্রীতদাসী অপেক্ষাও তাচ্ছিল্য করিতেন। প্রতাপাদিত্য অবশেষে এই দারুণ সঙ্কট হইতে মুক্ত হইবার জন্য তাঁহাকে মনোহরপুরে নির্বাসিত করিয়াছিলেন।
দুর্গাবতী মনোহরপুরে আসিয়া প্রাসাদের নিত্য ব্যভিচার, অত্যাচার ও হত্যা-দূষিত বিষাক্ত বায়ু হইতে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্য বৎসরের কোনও সময় এদিকে আসিলে দুর্গাবতীর মন্দিরে অবশ্যই পদধূলি পড়িত। নতুবা তাঁহাকে একপ্রকার বৈধব্য জীবনই কাটাইতে হইত। এই দুর্গাবতীর সময়েই মাহতাব খাঁ যশোরের রাজপুরীতে প্রবেশ এবং নিজের বীরত্ব ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়া প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। সে আজ দশ বৎসরের কথা। যশোরের অন্তঃপুরে তখন দুর্গাবতীর একাধিপত্য। দুর্গাবতীর যৌবনের সুবর্ণ-শঙ্খলে প্রতাপাদিত্য তখন দুশ্চেদ্যভাবে পোষা কুকুরের ন্যায় বাঁধা ছিলেন। দুর্গাবতী মুখরা ও আধিপত্যপ্রিয়া হইলেও অত্যন্ত বদান্যা ও উদার-প্রকৃতি ছিলেন। লোকের গুণানুকীর্তনে সর্বদাই তাঁহাকে মুক্তকণ্ঠ দেখা যাইত। প্রতাপের কুৎসিৎ ব্যবহারই পরে তাঁহাকে মুখরা করিয়া তুলিয়াছিল। মাহতাব খাঁ রাণীর সৌভাগ্যের দিনে রাণীর হস্ত ও মুখ হইতে অনেক আর্থিক পুরস্কার ও বাচনিক প্রশংসা পাইয়াছিলেন বলিয়া রাণীকে তিনি মাতৃবৎ শ্রদ্ধা করিতেন। রাণীও মাহতাবকে পুত্রবৎ স্নেহের চক্ষে দেখিতেন। রাণীর মনোহরপুর নির্বাসনে এবং তাঁহার আধিপত্য চ্যুতিতে সর্বাপেক্ষা যদি কেহ দুঃখিত হইয়া থাকেন, তবে সে মাহতাব খাঁ। রাণীর একটি কন্যা এবং একটি পুত্র। কন্যার বয়স অষ্টাদশ বৎসর, নাম অরুণাবতী। পুত্র শিশু, পঞ্চম বৎসর মাত্র বয়ঃক্রম। নাম অরুণকুমার। অরুণাবতী পূর্ণ যুবতী। ভাদ্রের ভরা গাঙ্গ, কূলে কূলে রূপ উছলিয়া পড়িতেছে। বক্ষে বক্ষে প্রেমের তরঙ্গ আকুল উচ্ছ্বাসে আবর্ত সৃষ্টি করিয়াছে। চোখে মুখে প্রেমের বিদ্যুদ্দীপ্তি স্ফুরিত হইতেছে। প্রাণের পিপাসা বাড়িতে বাড়িতে এখন যেন উহা বিশ্ব-বিমোষিণী মূর্তি পরিগ্রহ করিতেছে। সুপক্ক আঙ্গুর বা রসাল আম্র যেমন বৃক্ষ-পক্ক হইলে ফাট ফাট হইয়া পড়ে, অরুণাবতীও তেমনি রসবতী হইয়া ফাট ফাট প্রায়। তাহার হৃষ্ট-পুষ্ট সবল ও সুডৌল দেহে যৌবন পূর্ণ প্রতাপে রাজত্ব বিস্তার করিয়াছে। তাহাকে দেখিলেই মনে হয় যে, রমণী বহু কষ্টে বহু সাধনায় যৌবনের প্রতাপ ও প্রভাকে আয়ত্ত রাখিতে সমর্থ হইয়াছে। যেন চন্দ্রমার সূর্বণ কৌমুদীজাল বিস্নাত ভাদ্রের সফেনতোয়া স্রোতস্বতী কূলে কূলে পূর্ণ হইয়া ফুলিয়া ফাঁপিয়া হেলিয়া দুলিয়া আবর্ত রচিয়া কল কল ছল ছল করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। এত বয়স এবং এত রূপের গৌরব থাকা সত্ত্বে অরুণাবতীর বিবাহ হয় নাই। বিবাহ না হইবার কারণ পাত্র না জোটা। গৌরব থাকা সত্ত্বে অরুণাবতীর বিবাহ হয় নাই। বিবাহ না হইবার কারণ পাত্র না জোটা। পাত্র না জুটিবার কারণ প্রতাপাদিত্যের নিদারুণ নৃশংস পৈশাচিক ব্যবহার। কথাটা একটু খুলিয়াই বলিতেছি। ইতঃপূর্বে প্রতাপ তাঁহার জ্যেষ্ঠ কন্যা শ্রীমতী বিভাবতীয় বিবাহ বাকলা চন্দ্রদ্বীপাধিপতি রামচন্দ্র রায়ের সহিত সম্পন্ন করিয়াছেন। এই রামচন্দ্র রায়ের রাজ্য অধিকার করিবার জন্য প্রতাপের নিদ্রাকর্ষণ হইত না। কিন্তু রামচন্দ্র রায় জীবিত থাকিতে বিনাযুদ্ধে রাজ্য অধিকার করা অসম্ভব। যুদ্ধ করিলে প্রতাপই জিতিবেন, তাহারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? রামচন্দ্র রায় বারভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া ছিলেন। বিশেষতঃ তাঁহারই পল্টনে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ সেনা ছিল। তাহাদের তোপের জন্য প্রতাপাদিত্য ভীত ছিলেন। অগত্যা প্রতাপাদিত্য, জামাতাকে কোন পর্ব উপলক্ষে বিশেষ সমাদার ও ধূম-ধামের সহিত একদা নিমন্ত্রণ করিলেন। রামচন্দ্র রায় শ্বশুরের নিমন্ত্রণ পাইয়া পরমাহলাদে যশোরের রাজপুরীতে আগমন করিলেন। প্রতাপাদিত্য গভীর নিশীথকালে জামাতা রামচন্দ্র রায়কে উপাংশু-বধ করিবার জন্য সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া রাখিলেন। নরাধম পাষণ্ড একবারের জন্যও উদ্ভিন্ন-যৌবনা কন্যার ভবিষ্যৎ পযর্ন্ত চিন্তা করিলেন না। কন্যা সেই নিদারুণ লোহমর্ষণ ঘটনার আভাস পাইয়া স্বামীকে সমস্ত নিবেদন করিল। রামচন্দ্র রায় রাত্রিযোগে কৌশলক্রমে প্রতাপাদিত্যের পুরী হইতে প্রাণ লইয়া কোনও রুপে পলায়ন করিলেন।” এই ঘটনার পরে কোনও রাজা কি জমিদার প্রতাপাদিত্যের সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হইতে চাহিতেন না। এ-দিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কেহই সাহস করিয়া সুন্দরবনের ভীষণ ব্যাঘ্রের ন্যায় নররক্ত-লোলুপ প্রতাপের কন্যা বিবাহের প্রস্তাব করিবারও সাহস করিত না। প্রতাপত্ত গর্ব-অহঙ্কারে রাজা ব্যতীত আর কাহাকেও কন্যা সম্প্রদানের কল্পনাও করিতেন না। কিন্তু এদিকে কন্যার দেহে যখন যৌবন-জোয়ার খরতার বেগে বহিতে লাগিল, তখন প্রতাপাদিত্য নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে মাহতাব খাঁর করে অরুণাবতীকে সমর্পনের বাসনা করিলেন। কারণ মাহতাব খাঁ অপেক্ষা উচ্চদরের পাত্র আর জুটিতেছিল না। কিন্তু মাহতাব খাঁকে সাধিয়া কন্যা দান করিতে প্রতাপের ইচ্ছা ছিল না। কোনও ঘটনা উপলক্ষ্ করিয়াই তাঁহাকে কন্যাদানের সংকল্প করিলেন। ঘটনাও জুটিয়া উঠিল। পাঠকগণ পূর্বেই তাহা অবগত হইয়াছিল। কিন্তু প্রতাপের দুর্ভাগ্যবশতঃ খাঁ সাহেব স্বর্ণময়ী-হরণে সম্মত হইলেন না।