বৈশাখ মাসের নির্মেষ আকাশ, স্থির প্রশান্ত সাগরের ন্যায় পরিদৃষ্ট হইতেছে। অসংখ্য সমুজ্জল নক্ষত্র নীলাকাশে, নীল সরোবরে হীরক-পদ্মের ন্যায় দীপিয়া দীপিয়া জ্বলিতেছে। কৃষ্ণা দশমীর অন্ধকার, তাহার আলোকে অনেকটা তরল বলিয়া বোধ হইতেছে। বাতাস নিরুদ্ধ। উচ্চশির বৃক্ষের পাতা পর্যন্ত কাঁপিতেছে না। বেজায় গরম! অত্যন্ত শীতল-রক্ত ব্যক্তির গা দিয়াও দরদর ধামায় ঘাম ছুটিয়াছে। চটির পূর্ব পার্শ্বের রাস্তার অপর দিকস্থ সবুজ জঙ্গলে অসংখ্য জোনাকি অগ্নি-স্ফূলিঙ্গের ন্যায় অথবা প্রেমিক-কবিচিত্তের মধুময়ী কল্পনা বিলাসের ন্যায় জ্বলিয়া জ্বলিয়া এক চিত্তবিনোদন নয়ন-মোহন শোভার সৃষ্ট করিয়াছে। দূরে একটি উন্নত আমগাছের শাখায় বসিয়া একটি পাপিয়া তাহার সুমধুর স্বরলহরীতে নীরব নিথর পবন-সাগরে একটি অমৃতের ধারা ছুটাইয়া দিতেছিল। সেই স্বরের অমৃত-প্রবাহ, কাঁপিয়া কাঁপিয়া দূরে-দূরে-অতি সুদূরে-নীলাকাশের কোলে মিশাইয়া যাইতেছিল। কিছু পরে দূরবর্তী গ্রামের বংশকুঞ্জের মধ্যে আরও একটি পাপিয়া, আম্রশাখায় উপবিষ্ট পাপিয়াটির প্রত্যুত্তরচ্ছলে গাহিতে লাগিল। উহা স্বপ্নরাজ্যের সাগর-পারস্থ বীণাধ্বনির ন্যায় মধুর হইতে মধুরতর বলিয়া বোধ হইতেছিল। তাহার সেই ঝঙ্কারও কাঁপিয়া কাঁপিয়া শ্রুতি-মূলে প্রেম-স্মৃতি জাগাইতেছিল। সকলের তামাক সেবন শেষ হইলে যুবকটি বলিল,-“শিবু, আর দেরী করা সঙ্গত নয়। পাল্কী উঠাও। সাদুল্লাপুর এখনও প্রায় দু’ক্রোশ। অনেক রাত্রি হ’চ্ছে স্বর্ণের বোধ হয় ক্ষুধাও লেগেছে।” শিবনাথ বলিল,-“কর্তা। আমরা এতক্ষণ সাদুল্লাপুরের ঘাটে যে’য়ে পহুঁছতাম; কেবল ঘাট-মাঝির দোষেই এত বিলম্ব হ’ল। বেটা অমনতর ভাঙ্গা নৌকায় খেয়া দেয় যে, আমার ত দেখেই ভয় করে। যাবার সময় ঐ নৌকায় কিছুতেই পার হব না।”
যুবকঃ যাবার সময় ভাল নৌকা না পে’লে বেটার হাড্ডী চুর করে দিব। আজা ভাঙ্গা নৌকার জন্য ক্রমে ক্রমে পার হ’তে প্রায় দুই ঘন্টা সময় নষ্ট হয়েছে।
এমন সময় পাল্কীর দ্বার খুলিবার খস্ খস্ শব্দ শোনা গেল। যুবক মুখ ফিরাইয়া পাল্কীর দিকে চাহিয়া বলিল, “কি স্বর্ণ! বড় গরম বোধ হচ্ছে? বাইরে বেরুবি?
পাল্কীর ভিতর হইতে মধুর ঝঙ্কারে উত্তর হইল, “হাঁ দাদা! বড় গরম! সমস্ত শরীর ঘেমে ভিজে গেছে। পাল্কীর ভিতরে ব’সে ব’সে হাত পা একেবারে লেগে গেছে।”
যুবকঃ শিবু! পাল্কীর দরজা খুলে দাও। আর একখানি গালিচা ঐ ঘাসের উপর বিছিয়ে দাও। স্বর্ণ একটু বাইরে শরীর ঠাণ্ডা করুক। বড় গরম পড়েছে। স্বর্ণ একটু ঠাণ্ডা হলে তোমরা পাল্কী উঠাও।
শিবনাথ যুবকের আর্দেশ মত ভার হইতে একখানি গালিচা লইয়া গাছ হইতে একটু দূরে খোলা আকাশের নীচে, যেখানে খানিকটা জায়গা ঘাসে ঢাকা ছিল, সেইখানে বিছাইয়া দিল। তারপর পাল্কীর দরজা খুলিয়া ডাকিল, “দিদি ঠাকরুণ”! বাইরে আসুন। বিছানা পেতেছি।”
সহসা পাল্কীর ভিতর হইতে বহুমূল্য পীতবর্ণ বাণারসী শাড়ী-পরিহিতা, রত্নালঙ্কারজাল-সমালকৃতা এক উদ্ভিন্ন-যৌবনা অপূর্ব ষোড়শী সুন্দরী বহির্গত হইল। তাহার রূপের প্রভায় মশালের উজ্জ্বল আলোকও যেন কিঞ্চিৎ মলিন হইয়া পড়িল। তাহার অলক্তক-রাগরঞ্জিত রক্তকমল-সদৃশ পাদ-বিচুম্বী মঞ্জীর-শিঞ্জনে মেদিনী পুলকে শিহরিতা হইল। তাহার বিশাল নেত্রের মাধুর্যময়ী উজ্জ্বল দৃষ্টিতে দৃষ্টি-পথবর্তী দূরব্যাপী অন্ধকার তরল ও চঞ্চল হইয়া উঠিল। তাহার নিঃশ্বাসে বায়ুতে মনোহর মৃদু কম্পন উপস্থিত হইল।
যুবতী যখন পাল্কীর ভিতর হইতে নির্গত হইল, তখন মনে হইল, যেন পুস্পকুন্তলা রক্তাম্বরা বিচিত্রবর্ণশোভী-অন্বুদাঞ্চলা বিশ্ববিনোদিনী হাস্যময়ী ঊষাদেবী পূর্বাকাশের দ্বার উদ্ঘাটনপূর্বক ধরণীবক্ষে নবজীবনের পুলক-প্রবাহ সঞ্চারের নিমিত্ত, নীলিম প্রশান্ত সাগরের শ্যামতটে!!! যুবতী ধীরে ধীরে যাইয়া গালিচার উপর উপবেশন করিল। যুবতীর রূপের ছটায় সে জায়গাটা যেন নিতান্তই বিশোভিত হইয়া উঠিল। যুবতীর অঙ্গ হইতে উৎকৃষ্ট আতরের গন্ধ চতুর্দিকে ছড়াইয়া চটিটাকে আমোদিত করিয়া তুলিল। যুবতী সেখানে বসিয়া তাম্বুল-করঙ্ক হইতে তাম্বুল লইয়া কয়েকটি যুবককে দিয়া নিজেও দুই একটি চর্বণ করিতে লাগিল। চটিতে লোকজন তখন কেহ ছিল না। একখানা বাংলা ঘরে একটি মুদি দোকান। তাহাতে একজন মুদি ও একটি ছোকরা মাত্র ছিল। গরমের জন্য ছোক্রাকে ঘরে রাখিয়া মুদি বাহিরে আসিয়া গাছের নিকটে খড়ম পায়ে গামছা কাঁধে দাঁড়াইয়া বেহারা ও রক্ষীদিগের হাবভাব কৌতূহলভরে দেখিতেছিল। যেখানে চটি, তাহার নিকটেই প্রকৃতি দেবীর সুবিশাল শ্যামচ্ছত্ররূপ কয়েকটি প্রকান্ড বটবৃক্ষের নীচে একটি বড় হাট বসিয়া থাকে। হাটের দক্ষিণ পার্শ্বেই একখানি বৃহৎ ঘর। তার চারিদিকে মাটির দেয়াল। যে কেহ রাত্রিকালে এখানে আশ্রয় লইতে পারে। মুদির দোকানে চাল, ডাল, চিড়া, মুড়ী, গুড়, হাঁড়ি, খড়ি সমস্তই কিনিতে পাওয়া যায়। ইচ্ছা হইলে রান্না করিয়া খাইয়া থাকিতে পারা যায়।
নিকটে একটা বড় ইদারা আছে। মুদি কেবল গরমের জন্যই বাহিরে আসিয়াছিল, তাহা নহে। অনেক লোক দেখিয়া সে আজ অনেক চা’ল, ডা’ল, হাঁড়ি, খড়ি বিক্রয়ের আশায় আশ্বস্ত হইয়া বাহির হইয়াছিল। কিন্তু সে যখন বাহিরে আসিয়া দেখিল যে, বিক্রমপুরের প্রবল প্রতাপান্বিত রাজা কেদার রায়ের লোকজন তাঁহার কন্যা স্বর্ণময়ীকে লইয়া শ্রীপুর হইতে সাদুল্লাপুরে যাইতেছে, তখন তাহার উচ্ছ্বসিত মনটা হঠাৎ দমিয়া গেল। পাছে রাজার লোকেরা তাহার দোকান হইতে জিসিষপত্র বা লুটিয়া লয়!