খা সাহেব আসন গ্রহণ করিতে কালিদাস সমস্ত কথা সংক্ষেপে বুঝাইয়া বলিলেন। খাঁ সাহেব বলিলেনঃ “পাত্রী কি মহারাজের প্রতি আসক্তা?”
কালিঃ না, তাহলে কি আর এত গোলযোগ হয়? সেরূপ হলে ত অনায়াসেই কার্যসিদ্ধি হ’ত। তা হ’লে আর আপনাকে ডাকবার আবশ্যক হ’ত না।
খাঁঃ তবে ত এ কার্য বড়ই কলঙ্কের।
কালিঃ কোন পক্ষে
খাঁঃ মহরাজের পক্ষে তাকে জোর করে আনলে সে কি মহারাজকে শাদী করবে?
কালিঃ জোর করে শাদী করাব। শাদী না করে বাঁদী ক’রে রাখব।
খাঁঃ কাজটা বড়ই ঘৃণিত। এ কাপুরুষের কার্য।
প্রতাপের হৃদয় স্বর্ণময়ীর জন্য উন্মুত্ত। সুতরাং খাঁ সাহেবের কথাগুলি তাঁহার কর্ণে বিষদগ্ধ শল্যের ন্যায় প্রবেশ করিল। আর কেহ হইলে হয়ত প্রতাপ তখনি মাথা কাটিবার আদেশ দিতেন। কিন্তু খাঁ সাহেব ক্ষমতাশালী বীরপুরুষ বলিয়াই তাহা হইল না। তবুও প্রতাপ বিরক্তি-ব্যঞ্জন স্বরে বলিলেনঃ “খাঁ সাহেব! আপনাকে ধর্মের উপদেশ দেবার জন্য ডাকা হয়নি।”
খাঁঃ আমিও তা বলছি না। কিন্তু কিসের জন্য ডেকেছেন মহারাজ?
প্রতাপঃ স্বর্ণময়ীকে এনে দিতে হবে।
খাঁঃ কেমন ক’রে।
প্রতাপঃ লুঠ ক’রে।
খাঁঃ মহারাজ! মাফ করুন, এমন কার্য ধর্ম সইবে না।
প্রতাপঃ আবার ধর্মের কথা?
খাঁঃ তবে কি ধর্ম পরিত্যাগ করব?
প্রতাপঃ প্রভুর আজ্ঞা পালনই ধর্ম।
খাঁঃ অধর্মজনক আজ্ঞাও কি?
প্রতাপঃ আজ্ঞা পালন দিয়া কথা, তাতে আবার ধর্মাধর্ম কি?
খাঁঃ মহারাজ! তবে কি আপনি ধর্মাধর্ম মানেন না?
প্রতাপঃ প্রতাপাদিত্য অমন ধর্মের মুখে পদাঘাত করে।
খাঁঃ তওবা! তওবা!! এমন কথা বললেন না, মহারাজ! সামান্য প্রভুত্ব পেয়ে আত্মহারা হবেন না। পরকাল আছে-বিচার আছে-জীবনের হিসাব-নিকাশ আছে-দীন-দুনিয়ার বাদশাহ খোদাতা’লা নিত্য জাগ্রত। তিনি সবই দেখেছেন।
প্রতাপঃ ওসব কোরান-কেতাবের কথা রেখে দিন। ওটা মুসলমানদেরই শ্রবণযোগ্য। আমি হিন্দু, ও-সব মানি না।
খাঁঃ কেন, হিন্দুশান্ত্রে কি কোরানের উপদেশ নেই?
প্রতাপাদিত্য বড়ই জ্বলিয়া গেলেন। তাঁহার ধৈর্যের বন্ধন ছিন্ন হইয়া গেল। রাগিয়া বলিলেনঃ “ও-সব শাস্ত্র দরিয়ার ঢালো। আমার শাস্ত্র স্বর্ণময়ী, আমার ধর্ম স্বর্ণময়ী। আমি তাকেই চাই। যেমন ক’রেই হোক তাকে এনে দিতে হবে।”
খাঁঃ মহারাজ! আমি মুসলমান, আমি বীরপুরুষ। তস্করের ন্যায় লুঠে আনতে পারব না। ওটা দস্যুর কার্য। স্ত্রীলোকের প্রতি অত্যাচার কাপুরুষের পক্ষেই শোভা পায়।
প্রতাপঃ কিন্তু আমার অনুরোধ তা একবারের জন্য করতেই হবে।
খাঁঃ মহারাজ, অনুগতকে মাফ করবেন।
প্রতাপঃ খাঁ সাহেব! মার্জনা করবার সময় থাকলে, কখনই আপনাকে আহবান করতাম না। যেমন ক’রেই হোক স্বর্ণময়ীকে আনতেই হবে। বীরপুরুষকে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য অনেক সময় দস্যু-তস্কর সাজতে হয়। তা’তে কলঙ্ক নেই। খাঁ সাহেব! আপনি ত সামান্য সেনাপতি, অত বড় অবতার রাসবিধ্বংসী রামচন্দ্র ইন্দ্রজিকে ছন্মবেশে কাপুরুষের মত বধ করেছিলেন। বীর-চূড়ামণি অর্জুন নপুংসক শিখন্ডীকে সম্মুখে রেখে ভীস্মকে পরাস্ত করেছিলেন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিত দ্রোণাচার্জকে পরাস্ত করা জন্য “অশ্বত্থামা হত ইতি গজ” রুপ মিথ্যা কথা বলতে কুণ্ঠিত হননি। পুরানে এরুপ রাশি রাশি দৃষ্টান্ত আছে। স্বর্ণময়ীকে নিয়ে আসতে পারলে প্রাণের দুহিতা অরুণাবতীকে আপনার হস্তেই সমর্পণ করব। আপনি আমার শ্রেষ্ঠ জামাতা হবেন।
খাঁঃ মহারাজ! যোড় হস্তে মার্জনা প্রার্থনা করি। সমস্ত পৃথিবীর রাজত্ব পেলেও এবং স্বর্গের অস্পরীরা চরণ-সেবা করলেও মাহতাব খাঁর দ্বারা এ-কাজ সম্পন্ন হওয়ার নহে। অন্য যে পারে করুক।
প্রতাপঃ কি! এত বড় আস্পর্ধা? আমি বলছি তোমাকে এ-কাজ করতেই হবে।
খাঁঃ মহারাজ! কখনই নয়। আপনার চাকুরি পরিত্যাগ করলাম।
প্রতাপঃ সাবধান! ও জিহবা এখনই অগ্নিতে দগ্ধ করব, কার সাধ্য নিজ ইচ্ছায় আমার চাকুরী পরিত্যাগ করে! তোমার মত খাঁকে শিক্ষা দিতে প্রতাপের এত নিমেষ সময়ের আবশ্যই।
খাঁঃ মহারাজ! আমি আর আপনার ভৃত্য নহি। সুতরাং বিবেচনা ক’রে কথা বলবেন।
প্রতাপাদিত্য এবারা জ্বলিয়া উঠিলেন, পা হইতে পাদুকা খুলিয়া খাঁর দিকে সজোরে নিক্ষেপ করিলেন। মাহতাব খাঁ শুন্য-পথেই পাদুকা লুফিয়া লইয়া “কমবখত বে-তমিজ শয়তান” বলিয়া প্রতাপাদিত্যের মুখে বিষম জোরে কয়েক ঘা বসাইয়া দিয়া গৃহ হইতে দ্রুত বহির্গত হইয়া গেলেন। মাহতাব খাঁ পাদুকা-প্রহারে প্রতাপাদিত্যের নাক-মুখ হইতে দরদর ধারায় রক্ত ছুটিল। সকলে ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় হাঁ হাঁ করিয়া খাঁ সাহেবের দিকে রুখিয়া উঠিল। প্রতাপাদিত্য “ছের উত্তার লাও, ছের উতার লাও” বলিয়া ক্রোধে গর্জিতে লাগিলেন। সেনাপতি সাহেব তখন ভীষণ গর্জনে আকাশ কাঁপাইয়া “কিছি কা মরণেকা এরাদা হ্যায় তো, আও” বলিয়া কোষ হইতে ঝন্ ঝন্ শব্দে তরবারি আকর্ষণ করতঃ ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। খাঁ সাহেবের প্রদীপ্ত জ্বালাময়ী করালী-মূর্তি ও অগ্নি-জিহব তরবারি দর্শনে সকলের বক্ষের স্পন্দন পর্যন্ত যেন থামিয়া গেল। মাহতাব খাঁ ধীর-মন্থর গতিতে কৃপাণ-পাণি অবস্থায় ফিরিয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেই মূহুর্তেই যশোর ত্যাগ করিলেন।
০৭.রায়-নন্দিনী – সপ্তম পরিচ্ছেঃ মনোহরপুরে
মাহতাব খাঁ রাগে ও ঘৃণায় নগর হইতে নৌকা ছাড়িলেন। তাঁহার মনে হইতেছিল যত শীঘ্র যশোরের এলাকার বাহিরে যাইতে পারেন, ততই মঙ্গল। যশোরের বায়ুমণ্ডল যেন তাঁহার কাছে বিষাক্ত বলিয়া ক্রোধ হইতেছিল। বিশেষতঃ প্রতাপাদিত্যের লোকজন আসিয়া অনায়াসেই তাঁহাকে আবদ্ধ করিতে পারে। তিনি বীরপুরুষ হইলেও একাকী কি করিতে পারেন! তাঁহাকে ধরিতে পারিলে প্রতাপাদিত্য যে হাত-পা বাঁধিয়া জ্বলন্ত চিতায় দগ্ধ করিবেন, সে-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। সুতরাং তিনি মাল্লাদিগকে খুব দ্রুত নৌকা বাহিতে আদেশ করিলেন। খাঁ সাহেব যে প্রতাপাদিত্যের রাজ্য ত্যাগ করিয়া যাইতেছেন, মাঝি-মাল্লারা অবশ্য তাহা জাতিন না। তাহাদের জানিবার কথাও ছিল না। তাহারা জানিলে অবশ্য আসিত না। কারণ এইরূপ কার্যে প্রতাপাদিত্যে যে তাহাদের শরীরের চর্ম ছাড়াইয়া তাহাতে লবণ মাখিয়া দিবেন, তাহা তাহারা বেশ জানিত। সেনাপতি কোন দরকারবশতঃ মনোহরপুরে যাইতেছেন বলিয়া মাঝিরা বিশ্বাস করিতেছিল।