তাহার উপর কড়া হুকুম, যেন রাজাদেশ ব্যতীত কাহাকেও প্রবেশ করিতে দেওয়া না হয়। প্রতাপাদিত্যের চক্ষু মদ্যপানে রক্তবর্ণ। তাঁহার শরীর বেশ বলিষ্ঠ এবং অসুরের ন্যায় পেশীসম্পন্ন। চক্ষুর দৃষ্টির অন্তর্ভেদী অথচ নির্মম। মুখমণ্ডলে বীরত্বের তেজ নাই; কেবল ক্রুরতা ও নিষ্ঠুরতা বিরাজমান। চেহারায় লাবণ্যের পরিবর্তে তীব্র কামুকতার চিহৃ দেদীপ্যমান। তাঁহাকে দেখিলে যুবপৎ ভীতি এবং ঘৃণার উদ্রেক হয়। প্রতাপাদিত্যের বয়স ৫৫ বৎসর হইলেও তাঁহার ইন্দ্রিয়পরায়ণতার কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। একজন কবিরাজ দিবারাত্র তাঁহাকে কামাগ্নি-সন্দীপন রস, কামেশ্বর মোদক, চন্দ্রোদয় মকরধ্বজ ইত্যাদি কামেন্দ্রিয়-উত্তেজন ঔষধ সরবরাহ করিবার জন্য নিযুক্ত রহিয়াছে। সুন্দরী স্ত্রীলোকের অনুসন্ধানের জন্য একদল গোয়েন্দাও নিযুক্ত আছে। প্রতাপাদিত্য যেমন কামুক, তেমনি নিষ্ঠুর। বঙ্গের সরস কোমল ভূমিতে তাঁহার ন্যায় মহাপাষন্ড, নৃশংস ও নর-পিশাচ, অতীতে বিজয় সিংহ, রাজা কংস এবং উত্তর কালে দেবী সিংহ ও নবকৃষ্ণ ব্যতীত আর কেহ জন্মগ্রহণ করিয়াছে বলিয়া মনে হয় না।
প্রতাপাদিত্য কক্ষের নীরবতা ভঙ্গ করিয়া দিলেনঃ “কমলাকান্ত! এতদিনে ত বসন্তখুড়োর নিপাত করতে সমর্থ হ’লাম। কিন্তু কেদার রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ীকে নিয়ে এখনও ত কেউ ফিরল না!”
মন্ত্রীঃ মহারাজ! আপনি বসন্তপুরে গিয়েছিলেন বলে তত্ত্ব সুবিধা হয়নি। স্বর্ণময়ীকে যারা লুঠতে গিয়েছিল, তারা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এসেছে।
প্রতাপঃ কি! অকৃতকার্য হয়ে ফিরল!
মন্ত্রীঃ আজ্ঞে হাঁ, অকৃতকার্য হয়ে।
প্রতাপঃ ডাকো তাদের।
মন্ত্রী তখন তাহাদিগকে ডাকিবার জন্য সিপাহীদের ব্যারাকে লোক পাঠাইলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে রামদাস, রাধাকান্ত, হরি, শিবা, মাধা প্রভূতি আসিয়া মাটিতে লুটাইয়া প্রতাপকে দণ্ডবৎ করিল। তৎপর দাঁড়াইয়া কাঁপিতে লাগিল।
প্রতাপঃ কেদার রায়ের কন্যা কোথায়?
রাধাকান্তঃ মহারাজ! তাকে ঈসা খাঁ ছিনিয়ে নিয়েছে।
প্রতাপঃ তোদের ঘাড়ে মাথা থাকতে?
রাধাঃ আমাদের অবশিষ্ঠ সকলেই মারা পড়েছে। আমাদের দোষ নেই। অপরাধ মার্জনা করুন।
প্রতাপ ব্যাঘ্রের ন্যায় ভীষণ গর্জন করিয়া কহিলেন, “যা এখনই তোদের একেবারে মার্জনা করছি।” এই বলিয়া জল্লাদের সর্দারকে আদেশ করিলেন যে, “এদের গায়ে আলকাতরা মেখে আগুনে পোড়াও।”
বলা বাহুল্য, পাঁচটি প্রাণী অর্থ ঘন্টার মধ্যে এইরুপ নিষ্ঠুরভাবে ভস্মীভূত হইয়া পৃথিবী হইতে উড়িয়া গেল।
প্রতাপ ইহাদিগকে ভস্ম করিবার আদেশ দিলেন; কিন্তু নিজের পৈশাচিক কামানলে আহুতি দিবার জন্য স্বর্ণময়ীর চিন্তায় চঞ্চল ও উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার ব্যাকুলতা দেখিয়া শ্যামাকান্ত বলিলেন, “মহারাজ! ব্যস্ত হবেন না। আগামী আষাঢ়ের মহররম-উৎসব উপলক্ষে সৈন্য পাঠিয়ে স্বর্ণময়ীকে লুঠে আনবার জোগাড় করছি।”
সেনাপতি কালিদাস ঢালী বলেন, “এই পরামর্শই ঠিক। মহররম উপলক্ষে সাদুল্লাপুরে মহোৎসব হয়ে থাকে, নানাদেশ হ’তে লোক-সমাগম হয়। সেই সময় যাত্রীবেশে বহুসৈন্য প্রেরণ করতে পারব। একবার ধরে ‘ময়ূরপঙ্খী’তে তুলতে পারলেই হয়। একশ’ দাঁড়ের ময়ূরপঙ্খী কা’রও ধরবার সাধ্য হবে না।”
প্রতাপঃ কিন্তু কেদার রায় এক্ষণে খুব সাবধান হয়েছে। স্বর্ণময়ীকে রক্ষ করবার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত রক্ষী রাখবে। সাদুল্লাপুরের মিত্রদের লোকজনের অভাব নাই।
শ্যামাঃ সেই যা’ একটু ভাবনা। প্রথমে একটা দাঙ্গা হবে।
প্রতাপঃ সে কি দাঙ্গা? সে যে দস্তরমত যুদ্ধ বাঁধবে। এই ত চর-মুখে শুনলেম যে, সাদুল্লাপুরের মিত্র-বাড়ীতে স্বর্ণময়ীর রক্ষাকল্পে দুইশ’ সিপাহী কেদার রায় পাঠিয়েছেন।
কালিদাসঃ তা হোক। আমাদের মাহতাব খাঁ সেনাপতি সাহেব যদি যান, তা হলে আমরা দুইশত সিপাহি নিয়েও হাজার লোকের ভিতর হতে কেদার রায়ের কন্যাকে ছিনিয়ে আনতে পারবো।
প্রতাপঃ (একটু হাসিয়া) কেন, তুমি একাকী সাহস পাও না কি?
কালিঃ সাহস পাব না, মহারাজ! কিন্তু জানেন ত, সাবধানের মার নেই। খাঁ সাহেব আমার চেয়ে সাহসী এবং কৌশলী। বিশেষতঃ, সিপাহীরা তাঁর কথায় বিশেষ উৎসাহিত হয়। তিনি সঙ্গে থাকলে কার্যসিদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।
প্রতাপঃ তবে তাঁকে ডাকান যাক।
কালিঃ আজ্ঞা হাঁ তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে হচ্ছে।
প্রতাপাদিত্য তখনই সেনাপতি মাহতাব খাঁকে ডাকিবার জন্য লোক পাঠাইলেন। অর্ধ ঘন্টার মধ্যে খাঁ সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। খাঁ সাহেবের বয়স ত্রিশের উপরে নহে। দেখিতে অত্যন্ত রুপবান ও তেজস্বী। চরিত্র অতি পবিত্র, মূর্তি গম্ভীর অথচ মনোহর। তাঁহার চাল-চলনে ও কথা-বার্তায় এমন একটা আদব-কায়দা ও আত্মসন্মানের ভাব ছিল যে, সকলেই তাঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা ও সন্মান করিত। প্রতাপাদিত্যের মত পাপিষ্ঠ প্রভূত্ত তাঁহাকে দেখিতে সম্ভ্রম করিতেন। প্রতাপ, খাঁ সাহেবের সহিত কদাপি কোনও কুপরামর্শ করিতে সাহসী হন নাই। তাঁহার সহিত হাসি-ঠাট্রা করিতে পর্যন্ত সাহস পাইতেন না। তাঁহাকে দেখিলেই যেন লোকে সভ্য-ভব্য হইয়া পড়িত। অথচ তিনি অত্যন্ত মিতভাষী ও সরল প্রকৃতির লোক ছিলেন। প্রতাপাদিত্যের আহবান বা নিজের বিশেষ গরজ ব্যতীত খাঁ সাহবে কদাপি দরবারে আসিতেন না। ফল কথা, প্রতাপ ও খাঁ সাহেবের মধ্যে প্রভূ-ভৃত্যের ব্যবহারে ছিল না। বিজাতির কাছে কেমন করিয়া আত্মসন্মান রক্ষা করিয়া চাকুরী করিতে হয়, খাঁ সাহেব তাহা ভালোরূপেই জানিতেন।