ঈসা খাঁ চিন্তা করিয়া দেখিলেন, রায়-নন্দিনীর প্রেমের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করাও যা, আর স্বর্ণময়ীর কোমল তরল প্রেমপূরিত-বক্ষে শাণিত বিষদগ্ধ ছুরিকা প্রবিষ্ট করিয়া হৃৎপিণ্ড খণ্ড খণ্ড করাও তাই। সুতরাং ঈসা খাঁ স্বর্ণের হৃদয়-দানের প্রত্যাখ্যানের কল্পনা করিতেও শিহরিয়া উঠিতেছিলেন। তাঁহার বীর-হৃদয়ও এমনি করিয়া প্রেমের নিকটে কুণ্ঠিত এবং লুণ্ঠিত হইয়া পড়ে। প্রেমের কি অপরাজেয় বিশ্ব-বিজয়িনী শক্তি! ক্ষুদ্র কীট হইতে বিশ্বস্রষ্টা অনন্তপুরুষ পর্যন্ত প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। প্রেমের শাসন কি কঠিন শাসন! প্রেমের আকর্ষণ কি মোহনীয়! আজি যুবতী-প্রেমের মদিরাকর্ষণে ঈসা খাঁ প্রশান্ত চিত্তও নিশাপতি সুধাংশুর কৌমুদী-আকর্ষণে সমুদ্রের ন্যায় উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছ। অন্যদিকে জননী-প্রেমের কঠিন শাসনে সেই উচ্ছ্বসিত সিন্ধু উদ্বেলিত হইয়াও, আকাঙ্খিত ক্ষেত্রে তরঙ্গ-বাহু বিস্তার করিতে পারিতেছে না। বেলাভূমি অতিক্রম করিবার সাধ্য নাই, উহা জননী-প্রেমের কঠিন ও অভঙ্গুর পর্বতপ্রাচীরে পরিবেষ্টিত। ঈসা খাঁ অনেক গবেষণার পর বুঝিতে পারিলেন যে, জননীকে অবশেষে নিখিল-শরণ মঙ্গল-কারল বিশ্ব-বিধাতার বিপদভঞ্জন চরণে আশ্রয় লইয়া চঞ্চল চিত্ত কতকটা স্থির করিলেন। তৎপর স্বর্ণ-খচিত ‘খাস-কাগজে’ কস্তুরী-গন্ধ-বাসিত স্বর্ণ-কালিতে স্বর্ণময়ীকে লিখিলেনঃ
প্রিয়তমে!
আমার অনন্ত স্নেহাশীর্বাদ, প্রগাঢ় প্রেমানুরাগ এবং মঙ্গল-কামনা জানিবে। তোমার প্রাণ-ঢালা পত্র পাঠে তোমার হৃদয় করামলকবৎ প্রত্যক্ষ করিতেছি। হে মানসসুন্দরী! বিশ্ব প্রহলাদিনী পুস্প-কুন্তলা হৈম-কিরীটিনী ঊষা যেন তাহার গোলাপী করের বিচিত্র তুলিকায় অম্বরমন্ডল বিচিত্র বর্ণানুরঞ্জিত জলদকদম্বে বিভূষিত এবং সমুজ্জ্বল করে, তেমনি, হে আমার হৃদয়-সরোবরের স্বর্ণ-সরোজিনি! তোমার নির্মল স্বর্গীয় প্রেমের বিশ্ব-বিনোদন-কিরণে এ-হৃদয় সুশোভিত এবং পুলকিত হইয়াছে। তোমার বীণা-বাণী-নিন্দিত প্রেম-গুঞ্জরণে হৃদয়-কুসুম-যাহা মুকুলিত ছিল, তাহা প্রস্ফুটিত হইয়াছে।
প্রিয়তমা স্বর্ণময়ী!
অনেকদিন হইতেই তোমাকে স্বর্ণময়ী মূর্তির ন্যায় ভালোবেসেছিলাম। আজ সে স্বর্ণময়ী মূর্তি জীবন্ত ও সরস প্রেমময়ী, প্রীতিময়ী, কল্যাণময়ী অমৃত প্রতিমায় পরিণত। সুতরাং সে মূর্তিকে ধারণ করিয়া হৃদয়ে তুলিয়া লইতে যে আনন্দ ও উল্লাস, তাহা কেবল অনুমেয়। আমি অযোগ্য হইলেও, তুমি যে হৃদয় দান করিয়াছ তাহা সম্পূর্ণ হৃদয়ের সহিত ধারণ করিয়া পরমানন্দ লাভ করিলাম। অয়ি মনোরমে! যে হৃদয় শীতের তুষার সস্পাতে সঙ্কুচিত এবং আপনার মধ্যে আপনি লুক্কায়িত ছিল, তাহা আজ তোমার মৃত-সঞ্জীবনী প্রেম-মলয়া-স্পর্শে প্রসূনপুঞ্জ-মণ্ডিত, কোকিল-কুঞ্জন-কুহরিত, নবশস্পদল শোভিত স্বর্গ-শ্রী-বিমণ্ডিত বাসন্তী-উদ্যানে পরিণত হইয়াছে।
অয়ি হৃদয়ময়ী!
আজ হৃদয়ের প্রতি চক্ষু তোমার মোহিনী মূর্তি ধ্যানে নিমিলিত। প্রতি কর্ণ তোমার অমৃত-নিস্যন্দিনী জীবন-সঞ্চারিণী বাণী শ্রবণে উৎকর্ণ। প্রতি নাসারন্ধ তোমার কস্তুরী বিনিন্দিত সুরভি গ্রহণে প্রমোদিত। প্রতি চরণ তোমার প্রেমের কুসুমাস্তৃত-পথে প্রধাবিত। প্রতি বাহুলতিকা তোমার প্রেমালিঙ্গনে প্রসারিত। প্রতি অণুপরমাণু তোমার দিকে উন্মুখ।
অয়ি কল্যাণী!
এক্ষণে কল্যাণ প্রভু পরমেশ্বরের কল্যাণ-বারির জন্য প্রতীক্ষা কর। বসন্ত উপস্থিত হইলেও কল্যাণ-বারি বর্ষণ হয় না। বারি-বর্ষণের জন্য, কষ্টকর হইলেও কিঞ্চিৎ নিদাঘ-জ্বালা সহ্য করিতে হয়। হে সুন্দরী! নৌকা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ও সজ্জিত হইলেই ‘মরকত দ্বীপে’ অভিযান করিতে পারে না। অনুকূল বায়ু-প্রবাহের জন্য অপো করিতে হয়। হে মানসি! উপস্থিত তোমাকে সম্পূর্ণ হৃদয়ের সহিত গ্রহণ করিলাম, প্রকাশ্যে অভ্যর্থনা অভিনন্দন করিতে কিঞ্চিৎ বাধা আছে। সে-বাধা করুণাময়ের আর্শীবাদে শীঘ্রই দূরীভূত হইবে বলিয়া আশা করি। তজ্জন্য আমাদের অধীর বা নিরাশ হইবার কিছুই নাই। পিপাসা বাড়িতে থাকুক, শেষে উহা অমৃতপানে পরশ তৃপ্তিলাভ করিবে।
সম্মুখে মহররমোৎসবে তোমার সহিত দেখা করিবার জন্য ব্যগ্র রহিলাম।
ইতি-
তোমারই
ঈসা
খিজিরপুর-আসাদ-মঞ্জিল।
পত্র শেষ করিয়া ঈসা খাঁ পুনরায় পত্রের এক কোণে বিশেষ করিয়া লিখিলেনঃ
“হে প্রেমময়ি! ব্যায়াম-চর্চা এবং অস্ত্র-সঞ্চালনে পটুতা লাভ করিতে বিশেষ যত্ন করিবে, ঐ পটুতাই সেই বাধা দূরীকরণে বিশেষ সহায় হইবে।”
অনন্তর পত্রখানি একটি বহুমূল্য আতরের শিশির সহিত ক্ষুদ্র রৌপ্যবাক্সে বন্ধ করিয়া রেশমী রুমালে বাঁধিয়া শিবনাথের হস্তে সমর্পণ করিলেন। শিবনাথকে এক জোড়া উৎকৃষ্ট ধুতি, চাদর এবং একটি সুবর্ণ মুদ্রা বখশিস দিলেন।
০৬.রায়-নন্দিনী – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদঃ পরামর্শ
যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য আজ খুব সকাল সকাল কাছারি ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন। প্রতাপাদিত্য যন্ত্রণা-গৃহে একখানি রৌপ্য-সিংহাসনে বসিয়াছেন। পার্শ্বে তাঁহার মন্ত্রী শ্যামাকান্ত ও অন্যতম সেনাপতি কালিদাস ঢালী মখমল-মন্ডিত উচ্চ ক্ষুদ্রে চৌকির উপর উপবিষ্ট। দালানের দরজা বন্ধ। জানালাগুলি কেবল মুক্ত রহিয়াছে। দূরে ফটকের কাছে একজন পর্তুগীজ সিপাহি পাহারা দিতেছে।