জননীর বাক্যে ঈসা খাঁর যেন কাঁপিয়া উঠিল। সহসা কুসুমমাল্য-পরিধানোদ্যত ব্যক্তি মাল্যে সর্পের অবস্থিতি দর্শনে যেমন চমকিত হইয়া উঠে, ঈসা কাঁ তেমনি চমকিয়া উঠিলেন। তিনি স্বর্ণময়ীকে মানসপ্রতিমা সাজাইবার জন্য যে কল্পনা করিতেছিলেন, তাহা জননী-মুখ হইতে নির্গত বাক্যের বজ্র-নির্ঘাতে যেন চুরমার হইয়া গেল। ঈসা খাঁ একটু স্থির হইয়া বলিলেন, “আম্মাজান! বাস্তবিকই হিন্দু কন্যার পাণিপীড়ন দোষে ভবিষ্যতে মুসলমানদিগকে অধঃপাতে যেতে হবে মনে হয়।”
আয়েশাঃ বাছা! এতে মুসলমানের এমন অধঃপতন হবে যে, কালে মুসলমান হিন্দুর ন্যায় কাপুরুষ ও ‘গোলামের জাতি’তে পরিণত হবে।
ঈসা খাঁ:তবে কথাটা কেউ তলিয়ে দেখছে না কেন?
আয়েশাঃ দেখবে কে? স্বয়ং বাদশাহ আকবর পর্যন্ত এই পাপে লিপ্ত। হিন্দুকে সন্তুষ্ট করবার জন্য তিনিই এই প্রথা বিশেষরূপে প্রবর্তন করেছেন। তিনি ভাবছেন, এতে হিন্দুরা প্রীত ও মুগ্ধ হ’য়ে বাধিত থাকবে। ফলে কিন্তু বিপরীত ঘাটবে। এতে স্পষ্টই ভারত-সম্রাটের সিংহাসনের উপর হিন্দুদের মাতুলত্বের দাবী প্রতিষ্ঠিত হবে। হিন্দুর সাহস স্পর্ধা দিন দিন বেড়ে যাবে। ভাগিনের সম্রাট হ’লে হিন্দুদের উচ্চ উচ্চ পদ প্রাপ্তি সহজ ও সুলভ হ’য়ে উঠবে। এইরূপে দেশের রাজদন্ড পরিচালনায় হিন্দুর হস্তও নিযুক্ত হবে। অন্যদিকে বংশধরেরা মাতৃরক্তের হীনতাবশতঃ কাপুরুষ, বিলাসী এবং চরিত্রহীন হয়ে পড়বে। আমার মনে হয়, উত্তরকালে এ জন্য ভারতীয় মুসলমানকে বিশেষ কেশ ও লাঞ্জনা ভোগ করতে হবে। এরা ভারতের রাজপতাকা স্বহস্তে রক্ষা করতে পারবে না।
ঈসা খাঁ অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া নীরব রহিলেন। জননীর হিন্দু-কন্যা বিবাহের অনিষ্টকারী মত বিদ্যুৎতের ন্যায় তাঁহার হৃদয়কে স্পর্শ করিল। তিনি মনে মনে বিশেষ সঙ্কট গণিলেন।
ফাতেমাঃ আম্মাজান! তবে আমরা কখনো হিন্দু বউ আনবো না।
আয়েশাঃ কখনও না, ছিঃ!
এই বলিয়া আয়েশা খানম গৃহ হইতে বাহির হইলেন এবং তাঁহার সঙ্গে ফাতেমাও বাহির হইয়া গেল। ঈসা খাঁ একাকী বসিয়া ব্যথিতচিত্তে স্বর্ণময়ীর পত্রের কি উত্তর দিবেন, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। ঈসা খাঁ অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত অনেক ভাবিলেন-অনেক চিন্তা করিলেন; কিন্তু সে-ভাবনা, সে-চিন্তা অনন্ত সমুদ্রবক্ষে দিকহারা নৌকার ন্যায় ঘুরিতে লাগিল। স্বর্ণময়ীর প্রেমপত্রখানি শত বারেরও অধিক পড়িলেন। যৌবনে বিদ্যুদ্দীপ্ত-সৌন্দর্য তাঁহার হৃদয়-আকাশে সৌদামিনীর মত চমকাইতে লাগিল। স্বর্ণময়ীর হৃদয়ের প্রবল অনুরাধ ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের কথা স্মরণ করিয়া ঈসা খাঁ বড়ই কাতর ও মর্মাহত হইয়া পড়িলেন। তিনি স্পষ্টই বুঝিলেন যে, স্বর্ণকে তিনি প্রেমের বাহুতে জড়াইয়া না ধরিলে, স্বর্ণের জীবন ভস্মে পরিণত হইবে। রায়-নন্দিনীর পরিণাম ভাবিয়া তাহার হৃদয়খানি নিজের হৃদয়ে তুলিয়া লইয়া দেখিলেন, তিনি ব্যতীত স্বর্ণের আর কেহ নাই-কিছু নাই। তিনি ব্যতীত স্বর্ণ বসিয়া, শুইয়া, দাঁড়াইয়া চিন্তা করিলেন-কিন্তু সমস্যার কিছুই মীমাংসা করিতে পারিলেন না। ঈসা খাঁ রায়-নন্দিনীকে যখন মন্দিরে দর্শন করিয়াছিলেন-যখন তাহার সহিত আলাপ করিয়াছিলেন-তখনও স্বর্ণের সৌন্দর্য ও ভাষা তাঁহাকে আনন্দ দান করিয়াছিল। কিন্তু সে আনন্দ তাঁহার হৃদয়ের আকাঙ্খা স্পর্শ করিতে পারে নাই। তিনি ইচ্ছা করিলেই স্বর্ণকে অনায়াসেই বিবাহ করিতে পারিতেন-বারভূঁইয়ার প্রধান ঈসা খাঁ মসনদ আলীকে, কেদার রায় যে পরম আগ্রহে কন্যাদান করিয়া জামাতৃপদে বরণ করিতে কৃতার্থতা জ্ঞান করিবেন, তাহা তিনি বেশ জানিতেন; কিন্তু তখন তাঁহার মানসিক অবস্থা অন্যরূপ ছিল। প্রথমতঃ ঈসা খাঁ নিজের বিবাহ সম্বন্ধে স্থিরসংকল্প হইয়াছিল না; তাহার পর তাঁহার ইচ্ছা ছিল যে, বিবাহ করিলে কোন বীর্যবতী, বীরাঙ্গনাকেই বিবাহ করিবেন! বীরাঙ্গনা বিবাহের খেয়াল ছিল বলিয়াই, স্বর্ণময়ীকে পরম রুপবতী এবং ফুটন্ত-যৌবনা দর্শন করিলেও কদাপি তাঁহাকে বিবাহ করিবার কল্পনাও তাঁহার মস্তিস্কে উদয় হয় নাই। কারণ, হিন্দু-কন্যাতে বীরত্বের আশা নিম্ববৃক্ষে আম্র ফলের আশা সদৃশ। এজন্য স্বর্ণময়ী তাঁহার নেত্রে গগন-শোভন চিত্ত-বিনোদন তারকার ন্যায় ফুটিয়াছিল, হাসিয়াছিল এবং কিরণ বিতরণও করিয়াছিল; কিন্তু তাহাতে তাঁহার চিত্ত-বিকার জন্মাইতে সমর্থ হয় নাই। তারার সৌন্দর্য দেখিয়াই তৃপ্ত হইতে হয়। ছিঁড়িয়া গলে পরিবার কাহারও আকাঙ্খা হয় না। কিন্তু স্বর্ণের প্রাণ দিয়া লেখা প্রাণ-ঢালা প্রেমের সৌন্দর্য-মাখা, আত্মোৎসর্গের অটল বিশ্বাস ও অচল নিষ্ঠাপূর্ণ পত্র পাঠে স্বর্ণময়ীর নাক্ষত্রিক সৌন্দর্য তাঁহার নিকট হইতে ক্রমশঃ লোপ পাইতে লাগিল। তিনি যতই পুনঃ পুনঃ সেই হৃদয়ের লিপি পাঠ করিতে এবং নিজের হৃদয়-মুকরে স্বর্ণের হৃদয়ের ছবি দেখিতে লাগিলেন ততই স্বর্ণময়ী তাঁহার নিকট তারকার পরিবর্তে গোলাপে পরিবর্তিত হইতে লাগিল। অবশেষে স্বর্ণ তাঁহার সম্মুখে মনপ্রাণ-প্রীণন সুরভিপূর্ণ শিশির-সিক্ত, ঊষালোক-প্রস্ফুটিত অতি মনোরম গরিমাপূর্ণ রক্তাভ লোভনীয় বসরাই গোলাপের ন্যায় প্রতিভাত হইল। তখন তিনিও উহাকে আদর করিয়া বুকে তুলিয়া লইতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্ত হায়! ঠিক এমন সময়েই তাঁহার জননী উদ্যানের প্রবেশদ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। তিনি ইচ্ছা করিলে, সামান্য বল প্রয়োগেই এ-দ্বার উন্মোচন করিতে পারিতেন। কিন্তু জননীর হিন্দু রমণী বিবাহের যুক্তির সারবত্তায় এবং বচনের ওজস্বিতায় ঈসা খাঁর উদ্দাম হৃদয়ের প্রেম-প্রবাহ, হযরত দায়ুদের সঙ্গীত শ্রবণে তরঙ্গময়ী স্রোতস্বিনীয় ন্যায় স্তম্ভিত হইয়া পড়িল।